ঢাকা: শিক্ষকসহ নানা পেশাজীবীদের আন্দোলন চলছে, বেতন-ভাতা, সম্মান ইত্যাদি নিয়ে। আন্দোলনের প্রকৃতি যা হয়, এখানেও সেরকমই হচ্ছে।
আমাদের আন্দোলন দুর্বার আন্দোলন অবশ্যই সেটা মুখে। কারণ বিবিধ ।
এক- আমরা তো ক্লাসে কথা চর্চাই করি। ওগুলো বলে তুবড়ি ফাটানো খুবই সহজ।
দুই- বর্তমান সরকার আমাদের। আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে করতে হয়। আমরা কি তবে নিজেদের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করবো ?
তিন- বর্তমান সমিতিগুলো প্রায় সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই সরকার পক্ষকে সমর্থন করে।
এখন সরকারের অন্য সবাইকে গালাগাল করলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহান, তিনি জানলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এ রকম একটা বক্তব্য দিয়েই নেতাদের আন্তরিক বক্তব্য শেষ করতে হয়, হয়েছেও।
একদিকে সাধারণ শিক্ষকগণ বুঝলেন বাহ, আন্দোলন চলছে। অন্যদিকে সরকারও সে অর্থে অখুশি হলেন না, প্রধানমন্ত্রীকে তো সবাই শেষ ভরসা মানছেন।
এখন সমস্যা তাহলে কোথায়? যে কোনও আন্দোলনের একটা গন্তব্য আর কিছু উদ্দেশ্য বা পথ থাকতে হয়। আন্দোলনের কিছু পন্থা থাকে, প্রক্রিয়ামত সেগুলো নিয়ে নেতৃবৃন্দ সামনের দিকে অগ্রসর হন।
নীতি, বিবেক, মানবতা বিবেচনায় রেখে দিকনির্দেশনা তৈরি হওয়া বাঞ্চনীয় হয়, কারণ এটা শিক্ষক আন্দোলন। শিক্ষকদের আন্দোলন দারুন বিবেচনাপ্রসূত হবে, স্বাভাবিক।
কিন্তু হয় না ! অভিযোগ আছে, তারা শুধু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ক্লাস এগুলো বন্ধ করে আন্দোলন করেন, এখনও করছেন। রাস্তায় নেমে মানুষ পুড়িয়ে এরা আন্দোলন করেন না, করার সক্ষমতাও রাখেন না। এজন্য অনেক জ্ঞানী-গুণীরা ক্লাস-পরীক্ষা সব ঠিকমত নিয়েই পরে শিক্ষকদেরকে আন্দোলন করতে পরামর্শ দেন, শিক্ষকরা আপত্তি করেন না। তারা কথা শোনেন এবং অনেকদিন ক্লাস পরীক্ষা ব্যাঘাত না ঘটিয়ে শুধু চিৎকার করেন, মানববন্ধন করেন, মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন।
মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী দিনের পর দিন সমানুপাতিক হারে কিছু একটা হওয়ার আশ্বাস দেন , আর এক সময়ের এরশাদের মন্ত্রী, বর্তমান অর্থমন্ত্রীর নানা সময়ে ব্যস্তানুপাতিক হারে শিক্ষকদের জ্ঞান বিষয়ক জটিল মনোদৈহিক সন্দেহ পোষণ পূর্বক বক্তব্য রাখার পর শিক্ষকরা সরাসরি কমপ্লিট শাটডাউন আন্দোলনের হুমকি দেন। এর আগেও অবশ্য ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সেটি নেয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ,বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের রোষাণলে পড়ে এবং ফেডারেশনের অগ্নিমূর্তিতে ভীত বিহ্বল হয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিল করে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে অটল হয়। ফেডারেশন তখন এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে আমলারা কারসাজি করেছে, তারা খুবই জটিল, এসব। সরকার চায় কিন্তু যেহেতু আমলা নির্ভর সরকার, কিছু করতে পারে না । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মা-বাপ, উনি বিষয়টা জানেন না। জানলে সব হয়ে যাবে। তো, তারা দেখা করতে গেলেন, সাক্ষাৎ পেলেন না। বরং সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেন, বললেন, অনেক নাকি দিয়েছেন, একটু বেশিই দিয়েছেন। শিক্ষকরা কষ্ট পেলেন কিন্তু ধারণা করলেন যে কেউ তাঁকে ভুল বুঝিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সাধারণত এ রকম কথা বলেন না। আমরাও তখন ভাবলাম যুদ্ধাপরাধী বিচার ও দেশ শাসনের বহুবিধ ষড়যন্ত্র কাটিয়ে সমৃদ্ধির দেশ গঠনে অগ্রগতির সীমানা নির্ধারণে যেহেতু তিনি অনেক দৃঢ়হস্ত, বিরক্তি থেকেও এ রকম কথা অনেক সময় হয়ে যেতে পারে। সরকার তো আমাদের, বিরোধীদের সুযোগ দেয়া যাবে না। দেখা যাক কি হয় ! নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে। আশ্চর্য হলেও সত্যি, কিছুই কিন্তু ঠিক হয়নি, বেতন বেড়েছে অনেক। এ এক অদ্ভুত ডিলেমা !
কিন্তু সাসপেন্স যে কম এমন নয়। আমলাদের গঠিত কমিটি, সিনিয়র মন্ত্রীদের নিয়ে কমিটি, ইত্যাদি হয়েছে। ফরাশ উদ্দিনের পে কমিটির সুপারিশ আমলারা রাখেনি, মন্ত্রীদেরটাও নয়। স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করেছেন, পরে তিনি আমলাদের উপর চটেছেন ইত্যাদি পত্রিকার পাতায় দেখেছি। খুশি হয়েছি। এবার তাহলে তিনি বুঝেছেন। কিন্তু আবার শুনলাম তিনি বলেছেন, অনেক দিয়েছেন। অর্থ পাওয়ার পর শিক্ষকরা নাকি অযথা প্রেস্টিজ নিয়ে ভাবছেন ! শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তো বটে এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভের জায়গা তিনি স্পষ্ট করেছেন, বলেছেন এঁরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়, অনেক বাড়তি আয় করেন। হুমকি দিয়েছেন, ৯টা থেকে ৫টা অফিস করতে হবে, চাকরির বয়স ৬৫ থেকে কমিয়ে ৫৯ করা হবে ইত্যাদি। ভয় পাওয়া স্বাভাবিক, আমরা পেয়েছি ।
এখন ! শিক্ষক নেতারা তো আছেন বিপাকে। সারাদিন জননেত্রীর নাম জপ করে তাঁর এ রকম বক্তব্য তাদের মানে লেগেছে, আমরা একটু হতচকিত হয়ে পড়েছি। অবশ্য একটা বিষয় গবেষকের দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছি, এখন আর কেউ শিক্ষা বা অর্থকে বকাবকি করে না। যেহেতু নেতারা কাউকেই কিছু বলার ক্ষমতা রাখে না, সাধারণ শিক্ষকরা অনেকেই এদের দালাল বলে থাকে, যদিও অতি গোপনে বলে, আমি কিন্তু শুনেছি। সে যা হোক , আমি কখনই বলি না সেটাও বলে রাখছি ।
কারণ আছে কিন্তু ! শিক্ষক নিয়োগ হওয়ার প্রক্রিয়া খুবই রাজনৈতিক, যদিও মধ্যবিত্ত বাবা-মা সন্তানদেরকে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে লেজুড় রাজনীতি বিযুক্ত থাকার পরামর্শ দেন। ওরা ভালো ফল করতে যতটা না কষ্ট করে পরবর্তীতে মাস্টার হতে, রাজনৈতিক পরিচয় দাঁড় করাতে এরচে বেশি সময় ব্যয় করে, অনেক কাঠ খড় এমনকি মাঝে মাঝে দামী তেলও পোড়াতে হয়। এখন উপাচার্য পদটিও সময়বিচারে রাজনৈতিক হওয়ায় নিয়োগ,পদোন্নতি রাজনীতিবিযুক্ত হওয়ার সুযোগ কম। যোগ্যতা, ভালো ফল ইত্যাদি বিক্রিয়ায় শিক্ষক হতে গিয়ে সমীকরণ মেলাতে রাজনীতি দারুণ প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে, এ প্রক্রিয়ায় কোনও কোনও লিপ্সু শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকবার কথা নয়, খুব একটা দেখাও যায় না। শিক্ষক রাজনীতি এভাবে দূষিত হতে থাকে বলে অনেকে মনে করলেও কখনও রাজনীতি করেন এমন শিক্ষকদের এ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট বক্তব্য থাকে না, নেই ।
যেমন তাদের নিজেদের বিষয়ে স্পষ্ট কোনও দাবি থাকতে নেই, থাকেও না। প্রথম থেকেই সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনের দিক নির্দেশনার কথা জোরালোভাবে বলতে কাউকে শুনিনি, হয়তো আমার কানে ছোটবেলা থেকেই একটু সমস্যা থাকায় এমনটি ঘটেছে। কিন্তু চোখ আমার অনেক ভালো, আমি দেখতে পাই। দেখলাম যে বড়-ছোট নিয়ে টানাটানি, আমলা নাকি শিক্ষক কারা আসলে মেধাবী ইত্যাদি। বাস্তবে প্রমাণ পেলাম আমলারাই মেধাবী এবং সৃজনশীল। শিক্ষকরা কি যেন ফার্স্ট ক্লাস নিয়েই পড়ে আছেন । সে যা হোক। পদ অবনমন -অতিক্রমণ ইত্যাদি বিষয়াবলী সুচারূভাবে সম্পন্ন করে নিজেদের আধিপত্য বেশ ভালোভাবে বজায় রেখে যারা শক্তির অসম্ভব খেলায় মাতেন, হাসেন। তারা সৃজনশীল বটে । ক্লাসে প্রথম হওয়াই যে জীবনের শেষ সত্য নয় এটা যারা জাতিকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে পারেন, তারাই তো জীবনের পরীক্ষায় প্রথম । আমাদের শিক্ষক নেতারা ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে সচিবদের সমকক্ষ হতে গিয়েছেন, গোল পাকিয়েছেন। আমরা সরকারের প্রতিশ্রুত পদ্ধতিতেই স্বতন্ত্র স্কেল চাই, এ কথা বললেই সব শেষ হত। কিন্তু না, আমরা চাই সিনিয়র সচিব হতে, মুখ্য সচিব হতে । শিক্ষকের দৃষ্টি কেন কেরানির দিকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তা ভেবে পান না বরং বলেন যে ড. আনিসুজ্জামানের সাথে কি কারও তুলনা চলে। না, সত্যি সত্যিই চলে না !
কাজেই তুলনার কোনও রাজনৈতিক মর্মার্থ আছে বলে মনে হয় না, বরং দরকার, সরকার যে বিষয়টা বুঝে নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো সেটা কার্যকর করার জন্য বলা। যেহেতু নির্বাচনী এজেন্ডায় শিক্ষকদের জন্য পৃথক পে স্কেল বিষয়টা ছিলো, ধরেই নেয়া যায় সরকার বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টা বোঝেন, এখানে আর ভুল বোঝানোর অবকাশ নেই। বৃথাই আমলাদের দোষারোপ করার মানে কিন্তু ত্রিবিধ । এক- সচিবরা মন্ত্রীদের চেয়ে বেশি বোঝেন, দুই- সচিবরা মন্ত্রীদের পাত্তা দেন না, তিন-উপরের যে কোনটা সত্য হলে সরকার আর জননির্ভর নেই, আমলা নির্ভর। যদি সত্যি এটাই হয়ে থাকে তাহলে সময় এখন হয়ত সাময়িক ভালো, সামনের দিনগুলো কতটা ভালো অপেক্ষা করা ছাড়া বলা যাবে না ।
বৈষম্য থাকলে তুলনা আসে। ক্ষোভ জমে, জন্মে। ক্ষোভ থেকে বিক্ষোভও হয়। সেটা কার প্রতি, কখন অর্জুনের তিরের মত ছোটে, বহু দেশের অনেক ক্ষমতাশালী রাজারা টের পাওয়ার আগেই ঘটনা শেষ হয়েছে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ফসল বলেই হয়ত মুক্তিযুদ্ধের দল সাফল্য ও সমৃদ্ধি নিয়ে দেশ শাসন করছে । আশা, সরকারের সমাধানের জন্য বসে থাকা শিক্ষক নেতারা দাবি বোঝাতে সমর্থ হোক, আন্দোলন করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ আর কত। শুনেছি সামনেই ছাত্রদের বিসিএস। পাস করে তারা দ্রুত চাকরি করবে, সংসার দেখবে এবং অন্যান্য প্রয়োজন মেটাবে এটাই স্বাভাবিক ।
পরিশেষে বলতে হয় এই প্রযোজন বিষয়ক একটি তত্ত্বের কথা । আব্রাহাম মাসলো এই তত্ত্বের জনক। তিনি বলেছেন যে মানুষের প্রথম প্রয়োজন শরীরবৃত্তীয়,এটি পূরণ হলে সে নিরাপত্তার কথা ভাবে, সেটি হলে পরে মনস্তাত্ত্বিক, তারপর আত্মসম্মান বা সেল্ফ এসটিম এবং এর পরের শেষ স্টেজ আত্ম উচ্চতার ধারণা। শিক্ষকরা প্রেস্টিজ নিয়েই পড়ে আছে , এটা আমারও ভালো লাগেনি।
যেহেতু তাদের পরীক্ষা, ক্লাস, খাতা দেখা, থিসিস সুপারভাইজ, ইন্টার্ন, সেমিনার, শিক্ষা সফর, উচ্চশিক্ষা, বই লেখা ইত্যাদি কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকবার কথা। আন্দোলন করলে শিক্ষার্থীদের তো বটেই নিজেদেরও অনেক ক্ষতি হয়। অবশ্য সরকার দ্রুত দাবি মেনে নিলে কারও কোনও ক্ষতি হয় না । বর্তমান সরকারের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আরও একটা বিশাল শক্ত পিলার যোগ হয় মাত্র। রাস্তাঘাট ব্রিজের উন্নয়ন হয়তো দেখা যায়, কিন্তু বিল্ডিং এর ফাউন্ডেশন দেখা যায় না বলেই সেটা অগ্রাহ্য করা টেকসই উন্নয়নের জন্য কতটা বিচেনাপ্রসূত, ভাবনা ব্যতিরেকে বলা একটু কঠিন বটে !
বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন, অবহেলাবশত: শিক্ষায় উপযুক্ত বিনিয়োগের অভাবে গল্পের সেই খরগোশের মত মাঝপথে ঘুমিয়ে পড়ুক, শিক্ষক হিসেবে তো বটেই নাগরিক হিসেবেও কামনা করি না। আর শুধু প্রেস্টিজ আদায়ের জন্যই আন্দোলন হোক, এটাও চাই না !
জয় বাংলা !
রাজীব মীর,সহযোগী অধ্যাপক,গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৬
আরআই/