ঢাকা, রবিবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

আন্ডার কনস্ট্রাকশন: নির্মাণাধীন সময় ও পরিসরের দলিল

ফাহমিদুল হক, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৬
আন্ডার কনস্ট্রাকশন: নির্মাণাধীন সময় ও পরিসরের দলিল

আন্ডার কনস্ট্রাকশন বহুস্তরিক এক চলচ্চিত্র, এজন্য এটি গুরুত্বের দাবিদার। আন্ডার কনস্ট্রাকশন নারীর চলচ্চিত্র, শ্রমিকের চলচ্চিত্র; এজন্যও এটি দর্শক-সমালোচকের মনোযোগ পেতে পারে।

আন্ডার কনস্ট্রাকশন একটি ক্লাসিক সাহিত্যকর্মকে বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফেলে সাহিত্যকর্মটির নতুন ব্যাখ্যা হাজির করে। এই উত্তর কাঠামোবাদী প্রবণতা মূল চরিত্রগুলোকেও সুনির্দিষ্ট কোনো পরিণতির দিকে নিয়ে যায় না, চরিত্রগুলো একরৈখিকও নয়; শক্তি ও সীমাবদ্ধতাসহ এক অসমাপ্ত ঘটনাচক্রে, বড় উত্থান-পতন ছাড়াই অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হতে থাকে চরিত্রগুলো। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো চলচ্চিত্রটি সমসাময়িক। বাংলাদেশের শিল্পপ্রয়াসী চলচ্চিত্রগুলো ইতিহাসকে যতটা ধারণ করতে চায়, সময়কে ততটা নয়। ঘর-বাহির চিত্রায়ণে দেখা গেলেও তা বিশিষ্টভাবে কোনো শহর, কোনো সময়, কোনো বিশেষ সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করতে চায় না। গত দুই-তিন দশকে বাংলাদেশ যে বিশেষ চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে, অনেক মানুষের শহর হিসেবে ঢাকার যে বিস্তার, ভোক্তাসংস্কৃতির যে বিকাশ, মানুষের পেশা-জীবনযাপন যে ব্যাপক পরিবর্তন, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যে অভিবাসন – এইসব সমসাময়িক পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে তো বটেই, শিল্পপ্রয়াসী কিংবা স্বাধীন চলচ্চিত্রে সেভাবে উঠে আসে না। শিল্পকর্মে যেমন শাশ্বত গল্প থাকতে পারে, তেমনি সময়কে ধারণ করে ভাষ্যনির্মাণের একটা দায়ও শিল্পের থাকে। তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’তে অনেকটা কিংবা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘পিঁপড়াবিদ্যা’য় সমসাময়িক বাংলাদেশকে অবশ্য কিছুটা পাওয়া যায়। আর পাওয়া গেল রুবাইয়াত হোসেন নির্মিত ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’-এ।  

আন্ডার কনস্ট্রাকশন-এর মূল চরিত্রে রয়েছে রয়া নামের এক থিয়েটার অভিনেত্রী। তবে তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য দু’জন নারীরও গল্প এটা। এ দুজন হলো রয়ার মা, এবং তার গৃহকর্মী ময়না। রয়ার স্বামী ধনী, ফলে টানাপোড়েনের মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো স্বামী-স্ত্রী উভয়কে চাকরি করতে হয় না। সে মনোযোগ দিয়ে থিয়েটার করার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু চলচ্চিত্র শুরুই হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী হিসেবে তার অভিনীত শেষ শো দিয়ে। তার বয়স হয়ে যাচ্ছে বলে নন্দিনী হিসেবে তার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে নতুন একটি মেয়ে। চলচ্চিত্রের শুরুতেই তাই আমরা বিষণ্ন রয়াকে দেখি। শো-শেষে ফেরার পথে সিগন্যালে পথশিশুরা তার কাছে ফুল বিক্রি করতে গিয়ে ‘‌আন্টি’ সম্বোধন করে। ফলে বাসায় ফিরে বিষণ্ন রয়া ময়নাকে জিজ্ঞেস করে তাকে আন্টির মতো দেখায় কিনা, এবং বাথরুমের আয়নায় নিজের শরীরের প্রতি তাকিয়ে বর্ধমান বয়সটাকে বোঝারও চেষ্টা করে। স্বামী সামির মনে করে এবার তাদের সন্তান নেওয়া উচিত। মার কাছে দেখা করতে গেলেও মার উপদেশ, এসব নাটক-ফাটক ছেড়ে বাচ্চা নিতে পারো না? থিয়েটারের কর্ণধার রাসেল ভাই জানায়, ইউরোপে বসবাসকারী একজন বাংলাদেশি কিউরেটর ইমতিয়াজ ঢাকায় আসছে, তার বিশেষ আগ্রহ আছে রক্তকরবীকে ইউরোপে নিয়ে যাবার ব্যাপারে। এই আন্তর্জাতিক সংস্করণে রয়াকেই নন্দিনী করতে হবে। কিন্তু ১২ বছর একই চরিত্রে কাজ করার পরও, রবীন্দ্রনাথের চিত্রিত নন্দিনী চরিত্র রয়ার কাছে পুরোপুরি গ্রহণীয় নয়। সে আর নন্দিনী চরিত্রে কাজ করতে উৎসাহী নয়। রাসেল ভাইও এক পর্যায়ে উপদেশ দেয়, থিয়েটার ভালো না লাগলে রয়ার মন দিয়ে সংসার করা উচিত। তবে ইমতিয়াজ সত্যি সত্যি ঢাকায় আসলে, রয়ার থিয়েটার ক্যারিয়ার নতুন মোড় নেয়। নন্দিনী চরিত্র নিয়ে রয়ার ভিন্ন ভাবনা ইমতিয়াজের পছন্দ হয়। সুন্দরী, ভালবাসাসঞ্চারী, পরিহতকর নন্দিনীকে ভেঙ্গে নন্দিনীকে একজন গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে আর রক্তকরবীর যক্ষপুরী হিসেবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিকে রয়া হাজির করে। এর আগেও এক লেখায় রয়া যক্ষপুরীর সঙ্গে ফুলবাড়ি কয়লাখনির সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিল। বলাবাহুল্য প্রাচীনপন্থী ও বিশুদ্ধবাদী রাসেল ভাইয়ের এইসব ভাঙ্গাগড়া পছন্দ হয় না, তবে ইমতিয়াজের পছন্দ হয়। ফলে আন্তর্জাতিক সংস্করণের পরিচালনার ভারও রয়ার হাতে ন্যস্ত হয়। ইমতিয়াজের কাছ থেকে এই শৈল্পিক বিনির্মাণে সায় পেয়ে রয়া আনন্দিত হয় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগটিকে জীবনের সেরা অর্জন মনে করে। ইমতিয়াজের সঙ্গে দ্রুত তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অন্যদিকে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতা বাড়তে থাকে।  

রয়ার মা রক্ষণশীল; স্বামীপরিত্যক্তা হলেও মনে করে একদিন রয়ার বাবা ঠিকই ফিরে আসবে, হিজাবি মহিলাদের সঙ্গে তার ওঠাবসা, রয়ার পোশাক-বেশভূষায় তার আপত্তি। মেয়ে নাটক করে আর ছেলে বিদেশে গিয়ে শুয়োরের মাংস খায়, এসব নিয়ে তার খেদের অন্ত নেই। মেয়েকে এই খোঁটা দিতেও তার বাধে না যে, যারা নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করে, মানুষ তাদের বেশ্যা বলে। স্পষ্টতই মেয়ে ও মায়ের সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন আছে। তবে মা একাই বসবাস করেন, নিজে নিজে চলতে তিনি স্বচ্ছন্দ।

ময়না সদ্যকৈশোর পেরুনো তরুণী। তার ওপরে রয়ার সংসারের ভার ন্যস্ত। তবে লিফটম্যান সবুজ মিয়ার সঙ্গে  তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে ও সে গর্ভবর্তী হয়ে পড়ে। ময়নার কাছ থেকে এখবর জানার পর লিফটম্যানের সঙ্গে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে রয়া সবুজকে থাপ্পড় মারে, প্রতিশোধ হিসেবে সবুজ ময়নাকে নিয়ে চলে যায়। তারা বিয়ে করে বস্তিতে বসবাস শুরু করে। ময়না গার্মেন্টসে চাকরি শুরু করে। ময়না চলে যাবার পর রয়া বিপদে পড়ে, ময়নার অনুপস্থিতিতে একা সংসার সামলানো যেমন কঠিন হয়ে ওঠে, তেমনি ময়নার সঙ্গে মমত্ববোধ ও বন্ধুত্বের সম্পর্কটিও ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে ময়নার বিয়ের উপহার হিসেবে স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে রয়া বস্তিতে যায়। ময়নাকে ফিরে আসতে বলে। কিন্তু ময়না নিজের সংসারে থাকতে বেশি আগ্রহী। পরেরবার রুপার পায়েল গর্ভবতী ময়নার পায়ে নিজ হাতে পরিয়ে দেয় রয়া।

আরও একজন নারী চরিত্রকে আমরা দেখি, সে হলো রয়ার আপাত আধুনিকা বান্ধবী। সে মনে করে, মা হওয়া সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার, সেও রয়াকে পরামর্শ দেয় মা হবার জন্য। বিদেশে পিএইচডি স্থগিত করেছে সে মা হতে গিয়ে। আবার মা হওয়ার পরে তার শরীরের গঠন আলগা হয়ে গেলেও সে যাবতীয় উদ্যোগের মাধ্যমে  দ্রুত নিজের শরীরকে আগের স্থানে ফিরিয়ে আনতে চায়। সকল উপায়ে সে জীবনকে উপভোগ করতে চায়। ইমতিয়াজ রয়ার প্রতি আগ্রহী বুঝতে পেরে তাকে খুব উৎসাহী দেখায়। তার ভাষায় সে একইসঙ্গে ‘পাওয়ার পাম্পিং’ এবং ‘ব্রেস্ট ফিডিং’ চালিয়ে যাবার মানুষ।

এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন নারীরা, পরিচালনা ও চিত্রগ্রহণ এবং অন্যান্য অনেক দায়িত্ব নারীরাই পালন করেছেন। বিভিন্ন বয়স-পেশা ও মতাদর্শের  নারী এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় থিম। তবে প্রধান নারী চরিত্র রয়ার সঙ্গে অন্যদের সম্পর্কের ভিত্তিতে কাহিনী বিন্যস্ত হয়েছে। কিন্তু নারীবাদী চলচ্চিত্র বলতেই যেমন স্বাধীনচেতা নারীর বৈপ্লবিক ভূমিকার কথা আমাদের মাথায় আসে, তেমন নয় রয়ার চরিত্র। তার মধ্যে কিছু সুবিধাবাদিতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, স্বামীর ওপর নির্ভরশীলতার ব্যাপার রয়েছে। মার ভাষায়, রয়া স্বামীর টাকায় ‘ফুটানি’ দেখায়। ময়নার জন্য তার মায়া কিছুটা স্বার্থনির্ভর, কিছুটা আন্তরিক। ময়না সবুজের সঙ্গে চলে গেলে, কিছুদিন পর রয়া তার বস্তিতে যায়। স্বর্ণালঙ্কার উপহার হিসেবে দেয়, পাশাপাশি ময়নাকে ফিরে আসতে বলে। ময়না ফিরে আসে না। পরে আরেকবার ময়নার রূপার পায়েল নিয়ে যায় রয়া, নিজহাতে পায়ে পরিয়ে দেয়। ময়নাকে রয়া ঘরে পড়াতোও। কিন্তু ময়নাও খুঁজতে চেয়েছে নিজস্ব আত্মপরিচয়। পরের বাসায় কাজ করার মধ্যে সম্মান নেই। তাই সবুজ মিয়ার সঙ্গে বিয়ে করে সংসার করা, বাচ্চা ধারণ করাটাই তার আত্মপরিচয়ের অবলম্বন। পরে সে গার্মেন্টসে শ্রমিকের কাজও নেয়। এভাবেই সে জীবনের মানে খুঁজতে চেয়েছে। সে এও জানে, রয়ার দেয়া গয়না রয়ার কাছেই রেখে দিতে হবে, নয়তো দরিদ্র স্বামী সেটা নিয়ে বিক্রি করে দিতে পারে। অন্যদিকে রয়ার মা রক্ষণশীল ধর্মীয় অনুশাসনের জীবন যাপন করে, প্রথাগত নারীর মতো পরিত্যাগ করে যাওয়া স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, কিন্তু নিজে নিজে চলার মতো আর্থিক সামর্থ্য ও মানসিক দৃঢ়তা তার আছে। যেসব হিজাবি মহিলাদের সঙ্গে তার ওঠাবসা, তাদের দিয়ে তিনি সেলাইয়ের কাজ করান, নিজের ও তাদের রোজগারের ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ সব চরিত্রকেই পরিচালক শক্তিমত্তা ও দুর্বলতাসমেত সৃষ্টি করেছেন, একারণে চরিত্রগুলো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। তবে থিয়েটারের প্রতি রয়ার নিষ্ঠা, শিল্পের বিশ্লেষণে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার চেষ্টা, এবং নানান দ্বিধা-দ্বন্দ্বের শেষে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারার সক্ষমতা চরিত্রটিকে পূর্ণতার দিকে ধাবিত করে। সে স্বামীর সঙ্গে সন্তান নেবার চুক্তি বাতিল করে, অসুস্থ মার চিকিৎসার জন্য মার সঙ্গে ভাইয়ের কাছে লন্ডনে যাবার দায়িত্ব উপেক্ষা করে, তার কাজের জন্য সে স্বামীর ভাষায় ‘স্বার্থপর’ হয়ে ওঠে। অবশ্য তার এই অবস্থায় পৌঁছানোর বিষয়টি চলচ্চিত্রে স্পষ্ট করা হয় নি। চলচ্চিত্রের একেবারে শেষে রয়া রক্তকরবীর সংলাপ রিহার্সেল করতে থাকে যা থেকে বোঝা যায় সে প্রতিজ্ঞা করছে, সব শক্তি সংগ্রহ করে সে  ‘রাজা’র মুখোমুখি দাঁড়াবে। এতে হয়তো তার মৃত্যু হবে, কিন্তু তার মৃত্যুই রাজাকে তাড়া করে ফিরবে। তার কোনো হাতিয়ার না থাকতে পারে, কিন্তু তার মৃত্যুই হাতিয়ার হয়ে তাকে জিতিয়ে দেবে। এই প্রতীকী সংলাপ অবশ্য দর্শককে ধন্দে ফেলতে পারে যে, তবে কি রয়া পরাস্ত হবে? মৃত্যু কিংবা পরাজয় নিশ্চিত শেষ পর্যন্ত লড়াই করাটাই একমাত্র আশাবাদের জায়গা?
       
এই চলচ্চিত্রের অন্যতম কৃতিত্ব রক্তকরবীর যক্ষপুরীকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিকে তুলনা করতে পারা। জার্মান চলচ্চিত্রকার ফ্রিৎজ ল্যাঙের ‘মেট্রোপলিস’ চলচ্চিত্রের কথাও আমাদের মনে পড়তে পারে প্রসঙ্গক্রমে। আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে যে শ্রমশোষণ, শ্রমিক মানুষের ক্রমশ যন্ত্রবৎ হয়ে পড়ার বিষয়গুলো রক্তকরবীর যক্ষপুরীতে যেমন আছে, তেমনি বাংলাদেশের তৈরীপোশাক শিল্পেও আছে। যার শ্রম শোষণ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, তার সুরক্ষা-নিরাপত্তার আয়োজন কত তুচ্ছ! ফলে রানা প্লাজার ঘটনা চলচ্চিত্রের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে, রয়ার নন্দিনী হয়ে উঠেছে কোনো মনোহর বাঙালি নারী নয়, একজন বস্ত্রবালিকা। বস্তুত অধুনা বাংলাদেশের পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে এই তৈরীপোশাক শিল্প ও সস্তা শ্রম অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সেটি ধারণ করার মধ্য দিয়ে এই চলচ্চিত্রটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে প্রায়ই ভারতীয় চলচ্চিত্রের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়, বা বলা যায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিষয় ও শৈলী ভারতীয় চলচ্চিত্র দ্বারা আচ্ছন্ন, তখন এ ধরনের প্রচেষ্টা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নিজস্ব অবয়ব গড়ে তুলতে অবদান রাখে।

এই চলচ্চিত্র কোনো চূড়ান্ত সমাপ্তি টানে না কোনো কিছুতেই, সবকিছুই থাকে নির্মাণাধীন, আন্ডার কনস্ট্রাকশন। একটা উত্তরাধুনিক ভঙ্গি যেন। এই থিমকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বারবার ব্যবহার করা হয়েছে আখ্যানের বাহিরের (নন-ডাইজেটিক) একটি প্রসঙ্গ – নানান কনস্ট্রাকশনের কাজের দৃশ্য কাহিনীর ভাঁজে ভাঁজে প্রবিষ্ট করনো হয়েছে। কখনো নারী শ্রমিকরা কনস্ট্রাকশন সাইটে কাজ করছে, কখনো কোনো ভবনে রঙ করা হচ্ছে কিংবা টাইলস কাটা হচ্ছে, কিংবা কখনো চিত্রে ধারণ করা হয়েছে নির্মাণাধীন পুরো বিল্ডিংই। এই নন-ডাইজেটিং ইনসার্সন চরিত্রের পরিস্থিতি যেমন বর্ণনা করে, তেমনি এটি পুরো শহরকেই প্রতীকায়িত করে। এই প্রতীকায়ন বলতে চায়, ঢাকা শহর কিংবা বাংলাদেশ দ্রুত গড়ে উঠছে, কিন্তু তার পূর্ণ বিকাশ এখনও হয় নি, সবকিছুই নির্মাণাধীন।

আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে পরিচালক প্রতীকায়নের চেষ্টা করেছেন পরিচালক। এরমধ্যে অন্যতম হলো বিছানায় স্বামীকে অজগরেবেশে আবিষ্কার করা, কিংবা ইমতিয়াজের সঙ্গে ঘুমানোর পরে বাথটাবে রয়ার পোষা গোল্ডফিশ ও কচ্ছপের সন্তরণ। অ্যাকুরিয়ামে হাত দিয়ে পানি আন্দোলনের পর ভয়ঙ্করদর্শন মাছের হঠাৎ নড়াচড়ার সঙ্গে যথাযথ সাউন্ড ইফেক্ট দর্শকের মনে অভিঘাত হানতে সক্ষম। তবে মামুলি হয়েছে একটি স্বপ্নদৃশ্য যেখানে ময়নাকে দেখা যাচ্ছে গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে; সেলাই করতে গিয়ে ময়না বলছে, আফা আমার হাত আটকাইয়া গেছে, আমারে বাইর করেন! এমনিতে রয়ার চরিত্রে শাহানা গোস্বামী, মার চরিত্রে মিতা চৌধুরী আর ময়নার চরিত্রে রিকিতা নন্দিনী ভালো অভিনয় করেছেন। কিন্তু ঐ দৃশ্যটি রিকিতার অভিনয় কিংবা দৃশ্যধারণ, সেলাই মেশিনে হাত আটকে যাবার মতো বিষয়ের যে নাটকীয়তা, তা ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইমতিয়াজের চরিত্রে রাহুল বোস কিংবা স্বামীর চরিত্রে শাহাদৎ হোসেনের খুব বেশি কিছু করার ছিল না, কিন্তু তারা তাদের কাজটুকু ঠিকই করেছেন। আর শুদ্ধবাদী রাসেল ভাইয়ের চরিত্রে তৌফিকুল ইসলাম ইমনও মানানসই ছিলেন। অর্থাৎ অভিনয়ের জায়গায় এই চলচ্চিত্রটি ভালোমতোই উৎরে গেছে। মার্টিনা রাডওয়ানের অ্যালেক্সা অ্যারি ক্যামেরা ঢাকার নানান ল্যান্ডস্কেপ, গাড়িঘোড়া কিংবা ঘরের অ্যাকুরিয়ামের গোল্ডফিশ – কৃতিত্বের সঙ্গেই সবকিছু ধারণ করেছে। তবে মার্টিনার ক্যামেরার একটা অনানুষ্ঠানিক ঢঙ রয়েছে, ইমেজ দিয়ে দর্শকের চোখ মুগ্ধতায় আবিষ্ট করতে চান নি তিনি। হয়তো কাহিনীবিন্যাসের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করতে গিয়ে এটা করা হয়েছে। যেহেতু এটি কেবল ঠাসবুনোটের গল্পের চলচ্চিত্র নয়, বরং বক্তব্যের চলচ্চিত্র, তাই ক্যামেরাকেও পালন করতে হয়েছে ব্যাখ্যাকারক বা প্রশ্নকারকের ভূমিকা। অর্ণবের আবহ সংগীত, সুজন মাহমুদের শব্দ পরিকল্পনাও সচেতন শ্রবণেন্দ্রিয়কে সজাগ করবে। অবশ্য সুজন মাহমুদের সম্পাদনা চলনসই থেকেছে, চমকও চোখে পড়ে না, ত্রুটিও তাল কাটে না। দুয়েকটা শটের সেলাই সঠিকভাবে হয়েছে কিনা বোঝা মুশকিল। যেমন ইমতিয়াজের অনুমোদনের পরে, রাসেল ভাইয়ের সঙ্গে রক্তকরবীর বিনির্মাণ নিয়ে তর্কের পরে রয়াকে দেখা যায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে কিছু একটা দেখছিল, আড়চোখে সে দেখে রাস্তার পাশে বানর নাচ দেখানো হচ্ছে। এর পরের দৃশ্যে দেখা যায় কেনা কাপ নুডুলস দিয়ে ডিনার সারছে সামির ও রয়া। অসহিষ্ণু সামির বলে, আর কতদিন এসব খেয়ে থাকবো? এরকম পৃথক দুটো প্রসঙ্গের মাঝখানে বানর নাচের ব্যাপারটি একটা প্রতীক বলেই অনুমান হয়, কিন্তু এটা সঠিক জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে কিনা সন্দেহ রয়ে যায়।      
  
তৈরীপোশাক শ্রমিকদের ‘রাজার এঁটো’ হিসেবে বর্ণনা নিশ্চয়ই চমকপ্রদ। একটা অভিযোগ তোলা দরকার যে, বাংলাদেশের তৈরীপোশাক শিল্পকে পরিচালকের ভাবনা চলচ্চিত্রে যতটা তাত্ত্বিকভাবে উঠে এসেছে, ততটা শ্রেণির প্রশ্নকে সামনে রেখে আসে নি। সমসাময়িক রানা প্লাজার ঘটনা, মোল্লাদের মিছিল থেকে নাস্তিকদের ফাঁসি চাওয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসেছে বটে, কিন্তু এই সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনা শাহবাগ আন্দোলন এবং হেফাজতের উত্থানের প্রসঙ্গ পরিচালক এড়িয়ে গেছেন। শাহবাগ-হেফাজতের সময়ে রয়ার মতো স্বাধীনতাকামী নারী ও থিয়েটারকর্মীর ভাবনা কী, তা অজানাই থেকে গেল।    

ফাহমিদুল হক: চলচ্চিত্র সমালোচক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

বাংলাদেশ সময়: ০০৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৬
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।