বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে তিন ডজনের অধিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। সম্প্রতি সরকার তাদেরকে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এ দেশের ভূমিজ সন্তান বাঙালি এবং ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সব সদস্যের কাছে আমার একটি বিনীত প্রশ্ন/প্রস্তাব, তিন দশক আগে বার্মার তৎকালীন স্বৈরাচারী সামরিক একনায়কের সীমাহীন অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে মানবেতর জীবনযাপনকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কি মানবিক বিবেচনায় এ দেশের আদিবাসী বলে স্বীকৃতি দেওয়া যায়? অথবা বাংলাদেশী হিসেবে? নিশ্চয়ই দেশপ্রেমিক পাঠকমাত্রই এ প্রস্তাবে আঁতকে উঠছেন, দ্বি-মত পোষণ করছেন। কারণ তারা এ দেশে শরণার্থীমাত্র। তারা যদি এ দেশের নাগরিক বা আদিবাসী না হন তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরাও এককভাবে বাংলাদেশের আদিবাসী নন। কারণ রোহিঙ্গারা যেমন বাধ্য হয়ে এ দেশে এসেছেন বিংশ শতাব্দীতে, তেমনি চট্টগ্রাম বিভাগের সব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ঠিক একই অঞ্চল আরাকান থেকে এবং বাধ্য হয়ে এ অঞ্চলে এসেছেন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে। কয়েক শতকের ব্যবধান মাত্র। পার্থক্য এই যে, রোহিঙ্গারা বাঙালি ও বাংলাদেশী হওয়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা এককভাবে নিজেদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চাচ্ছেন। কিন্তু তারা এ দেশের আদিবাসী নন। প্রকৃত প্রস্তাবে তারা এক একটি ক্ষুদ্র জাতি। স্ব স্ব গৌরবময় পরিচয়ে বাংলাদেশী। এ দেশের বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অংশীদার হয়েছেন।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা, বিশেষত বৃহৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত এগারোটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ তৎকালীন আরাকান রাজ্য ও ভারত থেকে এবং উত্তরাঞ্চলের সব উপজাতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ইত্যাদি অঞ্চল থেকে কর্মপোলক্ষে বা পরাজিত শক্তি হিসেবে যখন এ দেশে আসেন, তখন কি এ দেশ বিরানভূমি ছিল? কোনো জনবসতি ছিল না? তারা যে এ দেশে আগত, তা ঐতিহাসিকভাবে সুপ্রমাণিত। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা দুই ভাগের কম কিন্তু ভারতে তা শতকরা আট-এর বেশি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গ ও বাঙালির ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের এবং তাদের উৎপত্তি ও বিকাশ এ দেশের মাটিকে কেন্দ্র করেই। প্রাচীন বাংলার রাজধানী পুন্ড্রুবর্ধনপুর, পাহাড়পুর, জগদ্দল বিহারসহ অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্র, গৌড় ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাসরত প্রাচীন জনগোষ্ঠীকে এ দেশে আগত আর্যরা ‘অনার্য বা নিষাদ’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছে। এ দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী তাদের কাছে ছিল হীন ও অন্ত্যজ, হিন্দুধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জাতি-বর্ণ প্রথায় এরা ছিল অস্পৃশ্য। প্রাচীনকালের পরিব্রাজকদের কাছে এরাই ‘পাখির মতো কিচির-মিচির ভাষায় কথা বলা’ জনগোষ্ঠী। এরাই এ দেশের মূল বাসিন্দা বা আদিবাসী। তাহলে জেনে এবং বুঝে ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করে এ দেশের যারা ভূমিজ সন্তান নয় বরং বহিরাগত, তাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চাওয়ার মূল রহস্য কোথায়?
প্রাগৈতিহাসিককালের অখ- ভারতে বর্তমান সার্কভুক্ত দেশসমূহে বসবাসরত সকল নরগোষ্ঠীর সকল গ্র“প বা মানবগোষ্ঠী বসবাস করছিলেন। সবাই ভারতের আদিবাসী। ভারত এদের আদিবাসী ও তফসিলি উপজাতি বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিকট অতীতে এ দেশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন দেশ বা রাজ্যে বিভক্ত ছিল। অনেক এলাকা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক জনপদ বাচক শব্দে পরিচিতি লাভ করে। যেমন বঙ্গ। বঙ্গ জনপদবাচক ভূখ- স্বাধীন দেশ হিসেবে এবং এখানকার বাসিন্দারা বাঙালি বলে আত্মপ্রকাশ করলেও অনেকের ক্ষেত্রে তা হয়নি। অনেক জনপদের স্বাধীন সত্তা বিলীন হয়েছে, অনেক ক্ষুদ্র জাতি সবল জাতির কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেদের একীভূত করেছে। সুতরাং পানি ঘোলা করার জন্য আদিবাসী-দাবি উত্থাপন করে বিতর্ক জিইয়ে রাখা জাতি ও দেশগঠনমূলক কোনো কর্ম নয়। সকল ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ, ব্রিটিশ শাসকদের লিখিত রিপোর্ট এবং নিকট অতীতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবীদের লেখা প্রবন্ধ-বই, নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎকার, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর কাছে চাকমাদের প্রদত্ত লিখিত স্মারকলিপি এবং ১৯৯৭ সালে বর্তমান দলীয় সরকারের সাথে সম্পাদিত শান্তি চুক্তিতেও উপজাতি কথা লিখিত হয়েছে। তারা অকপটে বলেছেন, আমরা পাহাড়ি জাতি, জুম্ম জাতি, উপজাতি পরিচয়ে গর্ববোধ করি।
স্মরণাতীতকাল থেকেই বহু নৃগোষ্ঠী ও জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ এবং এ দেশের সামগ্রিক জনপ্রবাহ। হিন্দু জাতি-বর্ণ প্রথার নিম্নস্তরে অবস্থান করা লক্ষ লক্ষ মানুষ মুসলমান হয়েছেন। যেমন পাঙন, লাওয়া, বিনদ মুসলিম এবং বেদিয়া সম্প্রদায়ের বাঙালি মুসলিম। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে কোঁচ, কৈবর্ত, হাজং, হো, রাজবংশী ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মানুষ হিন্দু ধর্মমত গ্রহণ করে নিজেদের স্বাধীন সত্তা বিলীন করেছে। এরাই এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। সুতরাং বিভিন্ন সময় এ দেশে আগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নরগোষ্ঠীর আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবি কতটুকু যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।
বর্তমানে এ দেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী-উপজাতি-আদিবাসী শব্দ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অশান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসকদের চালু করা ইংরেজি ট্রাইবাল শব্দের বাংলা পরিভাষা হিসেবে উপজাতি কথাটি ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করে। আগে এ নিয়ে আপত্তি না থাকলেও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা বর্তমানে বলছেন, ‘আমরা কোনো জাতির উপ-অংশ নই’। তাদের আপত্তির মুখে সরকার ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠী বলে স্বীকৃতি দিলেও তারা নিজেদের আদিবাসী দাবি করছেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অথবা শান্তি বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য যদি তর্কের খাতিরে বাঙালিরা তাদের আদিবাসী বলে মনে করেন, তবে উভয় পক্ষই আদিবাসী। একপক্ষকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বিবদমান দু পক্ষের মধ্যে এক পক্ষের দাবি মেনে নিলে বাঙালিদের দাবি ও যুক্তি অসাড় হয়ে যাবে, মনে হবে বাঙালিদের দাবি সঠিক ছিল না। হয়তোবা অদূর ভবিষ্যতে স্বীকৃত আদিবাসীরা বিশেষ উদ্দেশ্যে বলবেন, বাঙালিরা এ দেশে বহিরাগত, কারণ এদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নাই। তাই এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও নীতিনির্ধারকদের অধিকতর সতর্ক হতে হবে। সরকারের বর্তমান অবস্থান সঠিক। কারণ যে কোনো স্বতন্ত্র মানবগোষ্ঠীকে নরগোষ্ঠী বা নৃ-গোষ্ঠী বলে। নৃবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানে উপজাতি বা আদিবাসী বলে আলাদা কোনো শব্দ বা প্রত্যয় নাই। বরং রেস বা নরগোষ্ঠী বা নৃ-গোষ্ঠী স্বীকৃত প্রত্যয়।
জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালকে আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা করে। তখন থেকে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে এমন দেশে আদিবাসী দিবস উদযাপিত হলেও বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তা পালিত হয়নি এ কারণে যে, এ দেশে আদিবাসী নাই। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা যে এ দেশে আদিবাসী নন এ বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য আমরা : ১. সমাজতাত্ত্বিক, ২. ঐতিহাসিক, ৩. ভাষাতাত্ত্বিক ও ৪. আন্তর্জাতিক ঘোষণার আলোকে আলোচনা করব।
১. সমাজতাত্ত্বিকভাবে সাধারণত আদিবাসী বলতে আমরা তাদেরই বুঝি যারা প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে সে অঞ্চলের আদি বাসিন্দা বা ভূমিজ সন্তান। যারা কোনো ভূখ- বা জনপদের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সে স্থানের বাসিন্দা। যারা আদিম সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং আদিম সংস্কৃতির কোনো কিছুই ত্যাগ করেনি (আদিম সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হলো, শিকার ও সংগ্রহভিত্তিক অর্থনীতি, প্রাকৃতিক শ্রমবিভাগ, লিখিত ভাষা ও বর্ণমালা না থাকা এবং ইঙ্গিতে কথা বলা, অবাধ যৌনাচার ও গোষ্ঠী বিবাহ, লজ্জার চেতনা না থাকা, কাঠামোবদ্ধ পরিবার না থাকা, নিজস্ব সরকার ও বিচার ব্যবস্থা, প্রকৃতিপূজা ইত্যাদি), সভ্যতার আলোকবর্তিকা যাদের দোরগোড়ায় পৌঁছায়নি, যারা অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ।
সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানি উপজাতিরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছে। অনেক জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যগুলোর সামান্য অংশ পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। রাজশাহী বিভাগীয় শহরে উপজাতীয় কালচারাল একাডেমীর পরিচালক পদে চাকরিরত অবস্থায় পিএইচডি গবেষণাকর্ম সম্পাদনের জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজের সময় গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সাথে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। খ্রিস্টান মিশনারিদের অবাধ ও নিরন্তর ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়ার কারণে অনেক উপজাতি শতভাগ খ্রিস্টান হয়েছে। যেহেতু ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের আলোকে একজন মানুষের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে বা নির্ধারিত হয়, সেহেতু খ্রিস্টান উপজাতিরা চিরায়ত সংস্কৃতির অনেক কিছুই শতভাগ ত্যাগ করেছেন। রাজশাহীর পাহাড়ি উপজাতির লোকেরা নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পারেন না, জানেন না। খ্রিস্টান মিশন বাদ্যযন্ত্র ও হাড়িয়া পানকে হারাম ঘোষণা করেছে। শুধু নাচ আর গান মানেই কিন্তু সংস্কৃতি নয়।
সভ্যতার আলোকবর্তিকায় উদ্ভাসিত হয়ে এবং সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টায় প্রায় সব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ বাংলাদেশের সরকারি- বেসরকারি চাকরির সব ক্ষেত্রে অবাধে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করছেন। অনেকেই সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করছেন।
২. ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত বৃহৎ পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র ১১ টি নৃ-গোষ্ঠী মঙ্গোলয়েড নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ, উপজাতীয় লেখকদের নিজস্ব গ্রন্থ পর্যালোচনায় প্রমাণিত যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ সব নৃ-গোষ্ঠী আরাকান, ত্রিপুরা, মিজোরাম ইত্যাদি অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে এ দেশে এসেছেন। চাকমারা বিজয়গিরি নামক একজন যুবরাজের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে আরাকান ও চট্টগ্রামের একটি অংশ দখল করেন। এ দেশের চাকমারা মনে করেন, তারা বিজয়গিরির সেই আরাকান বিজয়ী সৈন্যদের বংশধর। ১৭১৫ সালে চাকমা রাজা জলিল খাঁন বা জালাল খাঁন (১৭১৫-১৭২৪) সর্বপ্রথম চট্টগ্রামে মোগল কর্তৃপক্ষের সাথে ১১ মণ কার্পাস তুলা উপহার দিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করেন। ১৭৩৭ সালে সেরগুস্ত খাঁন (১৭৩৭-৫৮) আরাকানের পক্ষ ত্যাগ করে মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং দেওয়ান পদ লাভ করেন। মারমারা ১৭৫৬ সালে আরাকানে আশ্রয় লাভ করেন। ১৭৭৪ সালে রামু, ঈদগড়, মাতামুহুরী এবং সর্বপ্রথম ১৮০৪ সালে বান্দরবান শহরে বসতি স্থাপন করেন। ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা বোদপায়ার সেনাবাহিনী স্বাধীন আরাকান রাজ্য দখল করলে হাজার হাজার শরণার্থী কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী পালিয়ে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। এ দেশে দ্বিতীয় বৃহৎ উপজাতি সাঁওতালসহ অন্যান্য গোষ্ঠী এ দেশে এসেছেন সাঁওতাল বিদ্রোহের পর। অনেকে এসেছেন ব্রিটিশ আমলে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে। বর্তমানে এরা সবাই এ দেশের স্থায়ী নাগরিক বা বাংলাদেশী।
৩. ভাষাতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় জানা যায়, বাংলা ভাষার প্রধান উপকরণ হলো যথাক্রমে ক. দেশজ অর্থাৎ আদিম অনার্য, যা কি-না আর্য-পূর্ব (অষ্ট্রিক, কোল, মুন্ডা, দ্রাবিড়, তিব্বত, ব্রাক্ষ্মণ উপকরণ), খ) বহিরাগত আর্য উপকরণ এবং গ. বিদেশী উপকরণ। এই ত্রিবিধ উপকরণের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার মূল কাঠামো। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন বিশ্লেষণ করে সাধারণভাবে স্বীকৃত মত হলো, এই ভাষা হাজার বছরের প্রাচীন।
পক্ষান্তরে উত্তরাঞ্চলের সব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যেমন সাঁওতাল, উঁরাও, মুণ্ডা, মাহালি, পাহাড়ি, মাহাতো, পাহান, রাজবংশী, কোঁচ, কৈবর্ত ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা মূলত কথ্য ভাষা, লিখিত ভাষা নয়। অর্থাৎ এরা বর্ণহীন পরিবারের সদস্য। অধিকাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মুখের ভাষাকে লিপিবদ্ধ করে লিখিত রূপ দেবার মতো কোনো অক্ষরই উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর নেই।
চাকমারা আরাকানি-বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলে, এ কারণে ভাষাবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন চাগমা-বাংলা। মারমারা বর্মী এবং ত্রিপুরারা বোডো সম্প্রদায়ের ভাষার বর্ণ গ্রহণ করলেও অন্যান্য সাতটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো বর্ণ নেই। সাঁওতালরা অষ্ট্রিক ভাষার অন্তর্গত অষ্ট্রো-এশিয়াটিক উপ-শাখার মুণ্ডারী ভাষায় কথা বলে। সাঁওতাল ছাড়াও অষ্ট্রিক ভাষা পরিবারের মুণ্ডারী ভাষায় মুণ্ডা, হো, কোল, বিরজা, বিরহোড়, কুরকু, কারমালী, ভূমিজ প্রভৃতি উপজাতীয় মানুষেরা কথা বলে।
সাঁওতালী ভাষায় বাংলাভাষা পরিবারের বহু শব্দের সংমিশ্রণ ঘটেছে। ক্ষেত্রবিশেষে বাংলা ভাষায় স্থান করে নেওয়া বিদেশী শব্দ যেমন ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, উর্দু, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ ইত্যাদি শব্দ সাঁওতালি ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। অনেকক্ষেত্রে সাঁওতালরা সামান্য পরিবর্তন করে বা উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে বিকৃতভাবে উচ্চারণ করে বাংলা ভাষার অনেক শব্দ ব্যবহার করে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীসমূহ জাতি হিসেবে চূড়ান্ত বিকাশের জন্য অক্ষর আবিষ্কার বা ব্যবহার করতে শেখেনি। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, এরা যাযাবর বৈশিষ্ট্যের মানুষ। এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস না করার কারণে এদের ভাষা পূর্ণাঙ্গরূপে বিকশিত হয়নি বা পরিপূর্ণতা পায়নি। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে তারা যে অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেছে, বাস্তব প্রয়োজনে তারা সে অঞ্চলের মানুষের প্রধান বুলি ও ভাষার শব্দসম্ভার থেকে প্রয়োজনীয় শব্দ গ্রহণ করে নিজস্ব ভাষায় ব্যবহার করেছে। যেমন আরবি শব্দ অক্ত, ফারসি শব্দ বাবা, বাজার, আরসি, আর্জি ইত্যাদি গ্রহণ করেছে।
সাঁওতালরা এ দেশের ভূমিজ সন্তান নয়, এর অন্যতম প্রমাণ হলো এ দেশে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত খাঁটি অনার্য শব্দ সাঁওতাল ভাষায় নেই। এ দেশের খাঁটি বাংলা দেশী শব্দ অর্থই হলো অনার্য শব্দ। বাংলা ভাষায় অষ্ট্রিক শব্দের পাশাপাশি অনেক দ্রাবিড় শব্দ যেমন বগুড়া, শিলিগুড়ি অর্থাৎ ড়া, গুড়ি যুক্ত নাম দ্রাবিড় ভাষাগত। বাংলার বিভিন্ন ধরনের দেশীয় পাখি কাক, দোয়েল, পানকৌড়ি, শালিক ইত্যাদি এবং বহু প্রাণী যেমন কাঠবিড়ালী, ইঁদুর, খাটাশ ইত্যাদি অনেক শব্দ অনার্য বা এদেশী শব্দ। উপজাতিদের ব্যবহার্য শব্দের সাথে এসব নামবাচক শব্দের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
বাংলা ভাষার সঙ্গে সাঁওতাল ভাষার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাভাষায় বহুল ব্যবহৃত অনেক শব্দের ব্যবহার সাঁওতালি ভাষায় নেই। অসংখ্য শব্দের মধ্যে বোঝার জন্য বিভিন্ন গঠনরীতির কিছু শব্দ তুলে ধরা হলো। যেমন: কর-কর, খন-খন, গন-গন, মচ-মচ, ভাত-টাত, জাত-পাত, আবোল-তাবোল, চোট-পাট ইত্যাদি বহুল প্রচলিত শব্দ সাঁওতালরা ব্যবহার করে না। সাঁওতালরা মানবশরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাঙালি নাম গ্রহণ করেনি। কিন্তু এ দেশের ফলমূল, দেশী মাছ, পাখির নাম হবহু গ্রহণ করেছে। পশুদের মধ্যে সচরাচর দৃশ্যমান পশুর নাম আলাদা কিন্তু বিদেশী পশুর (উট-জেব্রা) বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বিদেশী নাম গ্রহণ করেছে। খাদ্য-খানা ইত্যাদির নাম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আলাদা, তবে এ দেশীয় সবজি যেমন-পটল, ছোলা, বরবটি, ঝাল, পান, মূলা ইত্যাদি নাম সাঁওতালরা হুবহু গ্রহণ করেছে। পাগার, পান ও বরোজ প্রত্যয়টি শুধু উত্তর বাংলা বা পুন্ড্রুবর্ধনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। সাঁওতালী ভাষায় পান ও বরোজ শব্দটি নেই। অর্থাৎ সাঁওতালরা যখন উত্তরাঞ্চলে আগমন করেছে, তখনই শব্দ দুটি গ্রহণ করেছে।
এছাড়া রক্ত বা আত্মীয় সম্পর্কীয় সম্বোধন রীতি, সাতদিনের নাম, সংখ্যা ও গণনা রীতি দু সম্প্রদায়ের আলাদা। পক্ষান্তরে বাংলা মাসের অধিকাংশ নাম সাঁওতালরা হুবহু বা সামান্য বিকৃত উচ্চারণে (ভাদর, আশিন) ব্যবহার করছে। বহুমাত্রিক শব্দ বিশ্লে¬ষণে বর্তমান লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত ধারণা এই যে, এ দেশের আদিবাসী অনার্য জনগোষ্ঠীর উত্তরপুরুষ হিসেবে বাঙালিরা তাদের মুখের ভাষা অনার্য ভাষা পরিবর্তন করেনি, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু বিদেশী শব্দ গ্রহণ করেছে বটে কিন্তু সাঁওতালি শব্দ গ্রহণ করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং সাঁওতালরাই যখন তাদের আদি বাসস্থান সাঁওতাল পরগনা ত্যাগ করে এ দেশে আসে, তখন জীবনযাত্রার প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে এ দেশের বুলি, প্রচলিত ফল, পশু, মাছ, পাখি ইত্যাদি বিষয়সংশ্লি¬ষ্ট নাম গ্রহণ করেছে। বাংলা মাসের নাম, সংখ্যা, স্থানীয় ফল-মূল ইত্যাদির নাম বাংলাদেশ, আসাম, উড়িষ্যা, বিহার ইত্যাদি অঞ্চলে এক নয়। এ পর্যালোচনা থেকেও প্রমাণিত হয় যে, সাঁওতালসহ অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মানুষ এ দেশে আগত, তারা বাংলাদেশের ভূমিজ সন্তান নয়। এ কারণে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর আদিবাসী বলে দাবি করাও যুক্তিসঙ্গত নয়।
৪. আন্তর্জাতিক ঘোষণা : ইউনেস্কো ১৯৬৪ সালে মস্কোতে জাতিসমস্যার জীবতাত্ত্বিক সমস্যাবলি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে সিদ্ধান্ত হয় যে, বর্তমান বিশ্বের সব মানুষ ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ নামক একটিমাত্র প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত এবং একই মূল থেকে উদ্ভূত। তবু বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে বংশ-পরম্পরাগত গুণ থাকায় অন্য গোষ্ঠী থেকে পৃথক। এই এক একটি গোষ্ঠীকে রেস বা জাতি বলে। অর্থাৎ মানুষের একটি বিরাট দলের লোকজনদের মধ্যে যখন পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া কতকগুলো সাধারণ দৈহিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তখন সেই দলকে জাতি বলা হয়। সে অর্থে বাংলাদেশের সব নৃ-গোষ্ঠীই এক একটি জাতি, ক্ষুদ্র জাতি। এরা ক্ষুদ্র জাতি। এর কারণ অনেক গোষ্ঠী খুবই ক্ষুদ্র, যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিনধ জাতিগোষ্ঠীর পরিবার সংখ্যা মাত্র ২২ এবং জনসংখ্যা শতাধিক।
জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালকে আদিবাসী বর্ষ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসীর সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে, Indigenous people are such population groups as we are, who from old age times have inhabited the lands when we live, who are awere of having a characters of our own, with social tradition and means of expression that are linked to the country inhabited from our ancesters, with a language or our own and having certain essential and unique characteristics which confer upon us the strong conviction of belonging to a people, who have an identity in ourselves and should be thus regarded by others (1993).
আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থা আইএলওর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্মেলনে আদিবাসী চিহ্নিত করা হয়েছে এভাবে, Peoples in independent countries who are regarded as indiginous on occount of their decent from the populations which inhabited the country or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonisation or the establishment of present state bounderies and who irrespective of their legal status, retain some or all of their social, cultural and political institutions (1989).
অর্থাৎ ‘আদিবাসী বা দেশজ মানবসমাজ, জনগোষ্ঠী অথবা জাতিসত্তার পরিচিতি পাবার অধিকারী তারাই, যাদের প্রাক-আগ্রাসন ও প্রাক-সাম্রাজ্যবাদী অধিকারের আগে থেকেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, যা তারা নিজ বাসভূমিতে তৈরি করেছিলেন। যারা তাদের বাসভূমিতে অথবা কিয়দংশে পাশাপাশি বসবাসকারী অন্যান্য মানবকুল থেকে নিজের একটি বিশেষত্বময় পৃথক সত্তার অধিকারী মনে করেন। যারা আজ সমাজের প্রতিপত্তিশালী না হয়েও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য তাদের নিজস্ব গোষ্ঠীসত্তা, সাংস্কৃতিক কাঠামো, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও বিধিব্যবস্থা রেখে যেতে চান একটি বিশেষ মানবসমাজের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য। ’
এ সংজ্ঞার শর্তই হলো, যাদের প্রাক-আগ্রাসন ও প্রাক-সাম্রাজ্যবাদী অধিকারের আগে থেকেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, যারা প্রতিপত্তিশালী ও শাসকগোষ্ঠীর (non dominant sectors of society) সদস্য নয়। কিন্তু ইসলাম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ, হিন্দু ধর্ম বা ধর্মের মানুষ অবশ্যই প্রতিপ্রত্তিশালী বা শাসকগোষ্ঠী। সুতরাং কোনো প্রকৃতি-উপাসক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ যখনই ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান-হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম হবে তখন সে শাসকগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আদিবাসী সংজ্ঞার আওতায় পড়বে না।
বাংলাদেশ ও ভারতের উপজাতীয় লেখক, অন্য জাতিগোষ্ঠীর সর্বজন গ্রহণযোগ্য বুদ্ধিজীবী এবং ব্রিটিশ প্রশাসক ও মিশনারিদের লিখিত বিভিন্ন ক্লাসিক্যাল গ্রন্থসূত্রে প্রমাণিত হয় যে, এ দেশে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী তথা উপজাতি জনগোষ্ঠীর আগমন হয়েছে নিকট অতীতে। কিন্তু প্রাচীন ভারতের গ্রন্থ সূত্রে (ঐতরেয়, ঋগবেদে) প্রমাণিত এ দেশ এবং দেশজ জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালির অস্তিত্ব হাজার-লক্ষ বছরের প্রাচীন। ’৪৭-পূর্ব অখ- ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আদিবাসী বলে পরিচিত এই জনগোষ্ঠীই ‘আর্য পূর্ব ভারতের আদিম বাসিন্দা’।
কাজেই বুঝা যায়, আদিবাসীরা নিজ নিজ দেশের মূল বাসিন্দা এবং জনপদ সৃষ্টির প্রথম থেকেই স্থানীয় মাটির সাথে তাদের নৃতাত্ত্বিক সম্পর্ক সুগ্রথিত। এ অর্থে এ দেশের বাঙালিরাই (হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ) এ দেশের মূল বাসিন্দা। হিন্দু জাতিভেদ প্রথার নিম্নস্তরে অবস্থিত দলিত সম্প্রদায়ের মানুষরা প্রকৃত আদিবাসী। অনার্য জনগোষ্ঠী এবং প্রকৃত উপাসক জনগোষ্ঠীর উত্তরপুরুষ হিসেবে বাংলাদেশের শতকরা সত্তর ভাগ মানুষ ধর্মান্তরিত মুসলিম। এরাই এ দেশের আদি-বাসিন্দা। সুতরাং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি অবশ্যই প্রশংসনীয়। জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করবে এমন অনাবশ্যক বিতর্ক সৃষ্টি না করে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে সবার মনোনিবেশ করা উচিত। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা যদি এ অভিধায় সন্তুষ্ট না হন তবে তাদের জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় কি-না তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং দেশের নীতিনির্ধারকমহল ভেবে দেখতে পারেন।
লেখক আঞ্চলিক পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক পরিচালক, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, রাজশাহী। ই-মেইল : [email protected]
[বিশেষ দ্রষ্টব্য : এই মতামত লেখকের নিজস্ব। আমরা এই বিভাগে সব ধরনের মত মুক্তভাবে প্রকাশ করতে চাই। আগ্রহীদের আমন্ত্রণ। -সম্পাদক]
বাংলাদেশ সময় ১৮০০ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১১