আগেও বলেছি, বাংলাদেশে ভারতীয় বাংলা সিনেমা আসার দরকার আছে। যৌথ প্রযোজনার নামে হলেও এসব ফিল্ম আসুক।
কলকাতার সিনেমা দেখলেই মন ভালো করে দেয়। কলকাতার সিনেমা পরিচ্ছন্ন। এই পরিচ্ছন্ন বলতে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার দৃশ্য নয়। পরিচ্ছন্ন বলতে, মার্জিত ভাষা, পরিচ্ছন্ন বাংলা।
বাংলাদেশের বাংলা সিনেমায় বাংলা ভাষা নাই। বাংলাদেশে সিনেমায় কুট্টি ভাষার প্রাধান্য। ইউটিউবে একটি সিনেমার ট্রেলার দেখলাম, একজন বলছে, তর পাও ভাইঙ্গা দিমু। তর, পাও, ভাইঙ্গা, দিমু এ শব্দগুলা আসলে কোন ভাষার প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলার? অবশ্যই বাংলা নয়। ঢাকাইয়া ভাষাও নয়। ঢাকাই সিনেমার প্রায় শতভাগ সিনেমা কুট্টি ভাষায় হচ্ছে। কুট্টি ভাষা তেজগাঁও, মুগদা, মান্ডার বস্তিবাসী মানুষের ভাষা।
আরেকটা সিনেমায় দেখলাম, নায়িকা বলছে, "আমি যে তরে কত ভালাবাসি তুই বোঝস না?' এটা কি একটা প্রেমের ভাষা? আপনি, আমি বা অন্য কেউ এভাবে, এ শব্দে তার প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করে। বস্তির গলায় ৫০ টাকা দামের চেন ঝুলানো ছেলেটাও তার প্রেমিকার সামনে প্রমিত বাংলায় কথা বলে। তারাও স্মার্ট।
আর ঢাকাই সিনেমার পরিচালকরা আনস্মার্ট রয়ে গেলেন।
পরিচালক শুধু সেই সমাজ বা সেই শ্রেণীর মানুষের কথাই বলতে পারেন, যে সমাজে তিনি বেড়ে উঠেছেন। সেই সমাজে প্রত্যক্ষণ থেকেই তিনি ফ্রেমে গল্প বাঁধেন। কোন পরিচালক যদি পাঁচ তারকা হোটেলে কখনো না থাকেন, কোন কর্পোরেট অফিসে না গিয়ে থাকেন, তাহলে তার সিনেমার পাঁচ তারকা হোটেল হবে তার দেখা ভাতের হোটেলের মতো, তার সিনেমায় দেখানো কর্পোরেট অফিস হবে তার পাড়ার আওয়ামী লীগ- বিএনপি অফিসের মতো। তিনি শুধু তা-ই সিনেমায় দেখাতে পারেন, যা তিনি দেখেছেন। ঢাকাই সিনেমার পরিচালকরা দরিদ্র।
খেয়াল করলে দেখবেন তাদের সিনেমায় দেখানো শিল্পপতিটিও কেমন যেন দরিদ্র। চেহারায়, পোষাকে, কেমন যেন গরিবী ছাপ। কথা প্রসঙ্গে আরেকটি কথা মনে পড়ল। ঢাকাই সিনেমায় মাঝে মাঝে আন্ডারওয়ার্ল্ড এর ডন হিসেবে যাদের দেখানো হয় তাদের বড় জোর গলির পাতি মাস্তান মনে হয়। হেরোইঞ্চি বা গাজা বিক্রেতা মনে হয়। আন্ডারওয়ার্ল্ড এর ডনদের এই দুর্দশা দেখলে খুব মায়া হয়।
তবে ঢাকাই সিনেমায় মোরশেদুল ইসলাম, হুমায়ূন আহমেদ, আরো দু’একজনও সিনেমা বানিয়েছেন। শুদ্ধ বাংলার সিনেমা। তবে তারা কোনভাবেই ঢাকাই সিনেমার প্রতিনিধিত্ব করেন না। তারা যা বানান, সেগুলো মুক্তির আগেই টিভিতে চলে যায়।
ঢাকাই সিনেমার সংলাপে কুট্টি ভাষা কত আগে ঢুকেছে জানি না। তবে বছর কয় আগে সিনেমায় এ ভাষার অনুপ্রবেশ নিয়ে একটি পত্রিকায় "ভাষার আগুনে দু ফোটা ঘি" শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা। এরপর চলচ্চিত্রে ভাষা দূষণের জন্য অন্যতম অভিযুক্ত মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী পাল্টা প্রতিবাদ জানিয়ে একটি লেখা লিখেন। তখন পর্যন্ত তিনিই অভিযুক্ত এই ভাষা অনুপ্রবেশে। তার যুক্তিগুলো আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছিল। সিনেমা সব ভাষার সব সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবে। সিনেমায় চরিত্রটি তার চরিত্রের উপযোগী ভাষা ও শব্দেই কথা বলবে। সিনেমায় ভাষা চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। যুক্তি এমনি ছিল (আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে)।
মোস্তফা সারোয়ার যে অংশটাকে শিল্পিত উপায়ে তুলে এনেছেন তার পরে অনেকে তাকে অনুকরণ করতে গিয়ে পরিবেশ নষ্ট করে ফেলেছেন। চলচ্চিত্রে বা নাটকে আঞ্চলিক ভাষা তুলে আনার মতো শিল্পমনা সৃষ্টিশীল মেধাবী পরিচালক আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে নেই।
এখন পুরো ঢাকাই সিনেমা শিল্প অদ্ভুত এক ভাষা দখল করে ফেলেছে। ঢাকাই সিনেমায় শুদ্ধ, প্রমিত বাংলা নাই। আমরা দীর্ঘদিন ধরে রেডিওতে বাংলিশ ব্যবহারে আপত্তি করে আসছিলাম। কিন্তু টিভি বা সিনেমা আমাদের দিচ্ছে কী? তারা কি শতভাগ শুদ্ধ বাংলা দিতে পারছে?
আমাদের সিনেমার অধ:পতনে ভাষা বড় একটি বিষয়। সত্তর থেকে নব্বই দশকে সিনেমার ভাষার যে শানিত উচ্চারণ ও আবেদন ছিল কালক্রমে সেটার কুট্টি ভাষায় পতন হয়েছে। মানুষ নিজ ভাষার চেয়ে উন্নত ও মধুর শব্দ বহুল ভাষার সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়। কুট্টি প্রমিত বাংলার চেয়ে অনুন্নত। তাই স্বাভাবিকতই এই ভাষায় কেউ আকৃষ্ট হচ্ছে না। ফলে সিনেমা বিমুখ হচ্ছে মানুষ।
এই মাধ্যমের অস্তিত্বের জন্য শুদ্ধ বাংলার মধুর প্রয়োগ জরুরি।
মনোয়ার রুবেল: তরুন কলামিস্ট ও অনলাইন এক্টিভিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
জেডএম