ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সোনালী চেতনার সৌম্য অভ্যুত্থান || মাহমুদ মেনন

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৬
সোনালী চেতনার সৌম্য অভ্যুত্থান || মাহমুদ মেনন

সোনালী চেতনার সৌম্য অভ্যুত্থান
সার্থক অনিমেষ অনন্ত এ জনম
ভেঙে জিঞ্জীর, পরাধীনতা
স্বাধীনতা, আমার স্বাধীনতা ।

কবি স্বাধীনতায় সোনালী চেতনা দেখেছেন।

আমার আমাদের সবার স্বাধীনতায় এই সোনালী চেতনা বর্তমান। স্বাধীনতা অর্জনের সেই কঠিন সময়ে জন্ম লাভের সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু চেতনায় চির জাগরুক স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠত্ব।

স্বাধীনতার সব কথা আমার মায়ের মুখে শোনা। পরে বইপত্রে, সংবাদে, লেখনিতে স্কুলে, কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আর কর্মজীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারকদের সঙ্গে কাজ করে করেই গড়ে উঠেছে আমার স্বাধীনতার চেতনা। এসব থেকে জাগ্রত যে চেতনা তার রঙ সোনালী।  

বাংলাদেশর স্বাধীনতা যেমন প্রোথিত মায়ের মুখে বাংলাভাষার নিশ্চয়তায়, তেমনি আমার স্বাধীনতার চেতনা মায়ের মুখে শোনা বুলি থেকে উৎসারিত। বাবার মুখে মুখে গেয়ে শিখেছি- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। গেয়েছি ওভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি।

আমি মনে করি, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মে দেশের প্রতিটি মানুষের ভেতরে স্বাধীনতার চেতনা সৃষ্টি, লালন, জাগ্রত করে তোলা আর সর্বোপরি সেই চেতনার বাস্তবায়নে, জীবনের পথ চলায় সেই চেতনা ধারনে বাবা-মায়ের এই ভূমিকাকে সম্মানিত করতে হবে, ঐতিহ্যমণ্ডিত করতে হবে।

প্রতিটি মা’ই তার সন্তানকে স্বাধীনতার গল্প বলবেন, স্বাধীনতাকে, মহান মুক্তিযুদ্ধকে গৌরবান্বিত করবেন। আর তার মধ্য দিয়েই স্থায়ী রূপ নেবে সোনালী চেতনা। আর তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়াবে।

৭০ থেকে ৮০’র দশকের শেষাবধি যাদের জন্ম তারা সবাই স্বাধীনতার কথা সেই সব মায়ের মুখে শুনতে পেরেছে যারা স্বাধীনতা অর্জনের সেই উত্তাল দিনগুলোকে দেখেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন যারা বিজয়ের স্বাদ উপলব্দি করতে পেরেছেন। একটি পরাধীন আর একটি স্বাধীন দেশের তফাৎটুকু বুঝতে বা জানতে পেরেছেন। তাদের কাছ থেকেই একটি প্রজন্ম জেনেছে কেমন করে হানাদারেরা এদেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করেছে, কেমন করে তারা চড়াও হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর, কেমন করে গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়েছে, আগুনে পুড়েছে। কেমন করে সম্ভ্রম হারিয়েছে মা, বোন। কেমন করে কত রক্ত, কত সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা।

আমার নিজের বাড়ি বরিশালের কীর্তনখোলা নদীপাড়ের গ্রাম চরবাড়িয়ায়।

প্যারা ট্রুপ করে পাকি বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়া, রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করতে করতে গ্রামে ঢুকে পড়া, বাড়ির পর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, এক ট্রেঞ্চের মধ্যে ব্রাশফায়ারে ২২ জনকে মেরে ফেলা, গঞ্জ থেকে সারাদিনের খাটুনি খেটে ঘরফেরতা নিরীহ রিক্সাচালককে হত্যা, শিক্ষিতদের ধরে নিয়ে যাওয়া, ভাইয়ের জন্য বোনের সাহসী উদ্যোগ, বোনের জন্য ভাইয়ের আত্মত্যাগ, শান্তি কমিটির কর্মকাণ্ড, , গ্রামের পথে প্রান্তরে পরে থাকা লাশ, বাড়ির পর বাড়ি খালি করে গ্রামবাসীর পলায়ন, আর তারই মধ্যে সাহসী যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া এসবই ছিলো এই একটি গ্রামে।

তখনও জন্ম হয়নি। কিন্তু মনে হয় ঘটনাগুলো যেনো চোখের সামনেই ঘটেছে। যেনো দেখতে পাচ্ছি সবুজ মাঠে খাকি পোশাকধারী পাকি সেনাদের উদ্ধত লাফিয়ে পড়া। দেখতে পাচ্ছি দাউ দাউ করে জ্বলছে বাড়ির একটি দোতলা ঘর। আবার কোনও একটি বাড়িতে উঁচু বাঁশে টাঙানো পাকিস্তানের পতাকা। সেখানে শান্তি কমিটির নামে স্বাধীনতা বিরোধীদের দাপট। দেখতে পাচ্ছি গুলিবিদ্ধ ছেলের দিকে ছুটে যাওয়া মায়েরও গুলিতে লুটিয়ে পড়া। তারই সূত্র ধরে একই ট্রেঞ্চের ভেতর রাইফেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিরাপরাধ ছেলে বুড়ো-নারী-শিশুদের হত্যা। দেখতে পাচ্ছি মানবতার চূড়ান্ত ভুলুণ্ঠন।

স্রেফ মায়ের মুখেই শোনা স্মৃতি থেকেই এসব জানা, এই উপলব্দি। বলতে পারি এই একটি গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আর তাদের দোসররা মানবতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যে যজ্ঞ চালিয়েছে সেটাই ছিলো তখনকার ৬৪ হাজার গ্রামের চিত্র।

আপনি যখন মায়ের মুখে এসবের বর্ণনা শুনবেন, মায়ের বিষ্ফোরিত চোখে দেখতে পাবেন ভয়ের বিন্যাস আর যুদ্ধ জয়ের কথা বলতে গিয়ে সেই মুখেচোখেই দেখবেন রোদের ঝিলিক। ওটাই স্বাধীনতা। ওটাই স্বাধীনতার চেতনা। আর তা নিঃসন্দেহেই এক সোনালী চেতনা।
 
আজকে যারা মা-বাবা হচ্ছেন তারা স্বাধীনতার পরে দ্বিতীয় প্রজন্ম। নিজেদের মায়ের বা বাবার কাছে শোনা স্বাধীনতার কথা এই প্রজন্মের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের শোনাবেন। তার জানা যে স্বাধীনতার কথা, তার কণ্ঠে উচ্চারিত স্বাধীনতা জয়গান জানা হয়ে যাবে পরের প্রজন্মের। তাদের হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে থাকা বোধ জাগ্রহ হবে তাদের অনাগত সন্তানদের মাঝে। আর তার মধ্য দিয়েই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়াবে স্বাধীনতার চেতনা। ঘটবে সোনালী চেতনার সৌম্য অভ্যুত্থান। আর স্বাধীনতা হয়ে থাকবে আমার... আমাদের।

লেখক: হেড অব নিউজ, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশ সময় ১৫৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১৬
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।