ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি || জনি হক

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৬
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি || জনি হক

বাইরে থেকে ফিরে কিংবা ছুটির দিনে, যতক্ষণ ঘরে থাকি, টিভিই দেখি। খবর দেখি।

ভালো নাটক হলে আটকে থাকি। ভালো না লাগলে আরেক দেশি চ্যানেলে ঢুঁ মারি। একটাতে মন না টিকলে আরেকটা চ্যানেল তো আছেই। রিমোটে চেপে এই ঘোরাঘুরির স্বাধীনতা আমাকে আনন্দ দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময় হিন্দি সিরিয়াল এই স্বাধীনতায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়!

গত মাসের একটা কথা বেশ মনে পড়ছে এখন। কোনো একটা চ্যানেলে তখন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফুটেজ দেখানো হচ্ছিলো। ওটা দেখতে দেখতে হঠাৎ মা প্রশ্ন করে বসলেন- ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য রক্ত দেওয়ার দরকারটা কি ছিলো? আমার তো গেলো ভ্রু কুঁচকে। বলে কি! মুখ থেকে বেরিয়েই গেলো- মানে কি! মা আত্মবিশ্বাসী, তিনি যেন ঠিকই বলেছেন! কী বলো মা এগুলো? মাথা ঠিক আছে? জানতে চাইলাম।  

মায়ের জবাব, ঠিকই বলছি, বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে আমরা কি করছি? দিনের বেশিরভাগ সময় হিন্দি চ্যানেল দেখছি, হিন্দি গান শুনছি, হিন্দি ভাষা শিখছি। স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করে একই দেশে রাজনীতিবিদরা নিজেরা নিজেরা মারামারি করছেন। তাহলে এসব করে লাভটা কী!

মায়ের কথাগুলো শুনে চুপ না হয়ে পারলাম না। তিনি তো ঠিকই বলেছেন। রাস্তায় জ্যামে আটকে থাকলে পাশের গাড়ি থেকে যে গানটা শুনি, তার ভাষা আমার মায়ের নয়। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া তরুণের কানে গুঁজে রাখা ইয়ারফোনে যে গানটা বাজে, তার ভাষা আমার মায়ের নয়।

স্বাধীনতার চেতনা নতুন প্রজন্মের মধ্যে আসলে বড়রাই ছড়িয়ে দেন না। তরুণদের দোষ দিয়ে কি হবে? স্বাধীনতার বীজ বপন হয়েছিলো যে ভাষা আন্দোলনে, তাকে ভুলে ইংলিশ মিডিয়ামে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামেন অভিভাবকরা। চারপাশে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো, পরীক্ষায় প্রথম করানোর প্রাণান্ত চেষ্টা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সেরা বানানোর অন্ধ প্রয়াস- সব মিলিয়ে বেশি যত্নআত্তি আর চাপ প্রয়োগ করতে গিয়ে যে শিশু-কিশোর, বালক-বালিকা, তরুণ-তরুণীকে স্বাধীনতা দেওয়া হয় না, সেদিকে খেয়ালই থাকে না অভিভাকদের। অতিশাসন অনেক সময় ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে। তার ওপর নিজেরা হিন্দি ছবি আর সিরিয়াল দেখতে গিয়ে পরোক্ষভাবে পরবর্তী প্রজন্মকেও তাতে অভ্যস্ত করিয়ে ফেলছেন বড়রা। এতে স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের সুতোটা ঢিল হতে থাকে ক্রমশ।  

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সিদ্ধান্তও বড়রা এখন হরহামেশা চাপিয়ে দেন তরুণদের ওপর। কারও আগ্রহ সাংবাদিকতায় থাকলেও তাকে ব্যাংকের চাকরি করতে বলা হচ্ছে। কেউ হয়তো চিকিৎসক হতে চায়, কিন্তু তাকে পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে অ্যাকাউন্টিং। স্বাধীনতা সবার অধিকার হলেও নিজের পছন্দমতো ক্যারিয়ার গড়তে পারে না বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী। পরিবারের ইচ্ছায় গতানুগতিক বিষয় নিয়ে পড়তে হয়।

শুধু পড়াশোনা বা চাকরি কেনো, জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও পূর্ণ স্বাধীনতা কি আছে? মেয়েরা তো সেই স্বাধীনতা পায়ই না বলা চলে। বেশিরভাগ মা-বাবা সন্তানকে সে সুযোগটা দেন না। এ অবস্থায় নতুন প্রজন্মের ব্যক্তিস্বাধীনতার অবয়বটা কেমন?

আমি যখন কিশোর ছিলাম, আমার কাছে স্বাধীনতা ছিলো শুভ্র গাঙচিলের ডানায় ভর করে নীল আকাশে ভেসে বেড়ানোর ফ্যান্টাসি, বাঁধনহারা স্বপ্নের হাতছানি। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত ছেড়ে দিয়ে আকাশকে কাছে ডাকা! কবিতা লেখা। গান শোনা। ছোটবেলায় দুষ্টুমি করতাম, এখনও করি। মাত্রা বেড়ে গেলে মা-বাবা শাসন করেছেন। পরিমিত থাকলে মজা পেয়েছেন। মন ভাঙেননি। এই স্বাধীনতাটা সবারই থাকা উচিত।

স্বাধীনতা মানে নিজের মতো বাঁচা। যে জীবনযাপনে ঘিরে থাকে মুক্তির অপার আনন্দ। তবে শৃঙ্খলা তো থাকতেই হবে। শৃঙ্খলা মেনে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারাটাই ব্যক্তিস্বাধীনতা। আমাদের মতো গরিব দেশের আমজনতার কাছে এই ব্যক্তিস্বাধীনতাই যদি না থাকে তাহলে ক্যামনে কি!

এমনিতেই নানান হতাশা কাজ করে আমাদের মধ্যে। তাই পড়াশোনা আর ছকেবাঁধা দৈনন্দিন জীবনের ফাঁকে বন্ধুরা মিলে একটু হৈহুল্লোড় করার পরিবেশ থাকা জরুরি। চারপাশের অস্থিরতা দেখলে প্রশ্ন জাগে মনে, আমাদের কি সত্যিই ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নোংরা রাজনীতির কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত আর অপ্রীতিকর ঘটনা ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার দৈন্যদশাকেই প্রকট করে তোলে। তাই অস্থিরতামুক্ত সমাজ চাই, দেশ চাই।

আমার তো মনে হয়, তরুণ-তরুণীদের মধ্যেই ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয় বেশি। বিশেষ করে স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করতে পারে কয়টা মেয়ে? এখনও এই সময়ে এসেও আমাদের সমাজে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে সন্ধ্যার পর মেয়েরা বাইরে থাকলে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। তাই সূর্যের আলো ডুবে যাওয়ার পর মেয়েদের বাইরে থাকার স্বাধীনতা নেই। রক্ষণশীলতার নামে স্বাধীনতার ওপর এই হস্তক্ষেপ চেনা চিত্র।  

অনেক সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়ে থাকে। তবুও পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের লালচে রঙ যখন আছড়ে পড়ে সমুদ্রের ঢেউয়ে, সাগরের সামনে দাঁড়িয়ে জীবনটাকে এক মুহূর্তেই ভালোবেসে ফেলি আমরা। এই তো স্বাধীনতা! অন্তহীন সমুদ্রের বুকে যেন ভেসে যায় সব ক্লান্তি আর বিষাদ। নোনা বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে অনুভব করি মুক্তির আনন্দ! বেঁচে থাকাটা যেন আসলেই আনন্দের।

স্বাধীনতা মানেই মুক্তির আনন্দে উপভোগ করা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। স্বাধীনতা মানে হারিয়ে যাওয়ার অধিকার যখন তখন, জীবনটাকে দেখা নিজের ইচ্ছামতো। স্বাধীনতা মানে মাথা উঁচু করে নিজের ইচ্ছার কথাটা জানানো। নিজের মতো করে জীবনযাপনের স্বাধীনতা থাকা চাই সবারই। স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করতে হয় এর সঠিক প্রকাশের মাধ্যমে।

স্বাধীনতা মানে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে ভালোবাসা, আর সে আনন্দের পরশ এগিয়ে দেয় জীবনকে। স্বাধীনতা মানে উচ্ছ্বলতায় মেতে ওঠা। লাল-সবুজের মাঝেই রয়েছে স্বাধীনতার আনন্দ, স্বাধীনতার উন্মাদনা। সিনেমা হলে গেলে ছবি শুরুর আগে লাল-সবুজ পতাকাটা হাওয়ায় উড়তে থাকে! ওই মানচিত্রে তাকিয়ে গর্ব নিয়ে গাই- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...

স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়ার গৌরব আমাদের অহংকার। এই দেশেই তো জন্মেছিলেন চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন, এসএম সুলতান, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কথাশিল্পী শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, জসিমউদদীন, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, শিল্পী আব্বাস উদ্দীন, আবদুল আলীমের মতো কিংবদন্তিরা। এই দেশ তো সকল দেশের সেরা হবেই! এমন দেশ আর কোথায় পাওয়া যাবে! আমি, আপনি, আমরা সবাই তাই ধন্য আমাদের জন্মভূমিতে। আসুন স্বাধীনতার চেতনায় জাগ্রত হই, জাগ্রত করি। বাংলাদেশকে ভালোবাসি।

লেখক: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান বিনোদন, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।