ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

স্বাধীনতা মানে ‘আমার বাংলাদেশ’ || ডা. শুভ প্রসাদ দাস

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৬
স্বাধীনতা মানে ‘আমার বাংলাদেশ’ || ডা. শুভ প্রসাদ দাস

আমার কাছে স্বাধীনতা বলতে গর্ব ভরে বলতে পারা ‘আমি বাংলাদেশি’, আমার কাছে স্বাধীনতা বলতে জাতীয় সংগীত গাইতে গিয়ে নিজের অজান্তে ভিজে যাওয়া চোখ, আমার কাছে স্বাধীনতা বলতে উম্নুক্ত গ্যালারি বা টিভি সেটের সামনে বসে খেলা দেখার সময় ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ চিৎকার।

২৬ মার্চের অর্থ আমার কাছে বাঙালির বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো।

শান্ত মায়ের শান্ত ছেলের দেশমাতৃকার অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা। এ স্বাধীনতা এমনি আসেনি। স্বাধীনতার অর্জনের রক্তাক্ত ইতিহাসের পেছনে লুকোনো অনেক কষ্ট, অনেক বীরত্বের গল্প।

আমার কাছে স্বাধীনতার মানে হলো, নিজের কাছে যা সঠিক মনে হয় তা বলতে পারা, দুর্নীতি দেখলে প্রতিবাদ করা। আমার কাছে স্বাধীনতার মানে হলো- বাংলাদেশের একটা ভালো খবরে আনন্দে মন ভালো হয়ে যাওয়া, একটা খারাপ খবরে মন খারাপ হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশকে নিয়ে কেউ খারাপ কিছু বললে, তার প্রতিবাদ করা। বাংলাদেশ মানে আমার দেশ। যার সবটুকুই আমার।

বাংলাদেশ বলতে আমার কাছে শীতের সরিষা ক্ষেত, বসন্তের কোকিলের ডাক, সবুজ চারপাশ, বর্ষার শব্দ টিনের চালে, নীল আকাশ ছুঁয়ে দূরে বহমান নদীতে ভেসে চলা পাল তোলা নৌকা। যার সবকিছুই আমি ভালবাসি।

পেশার স্বার্থেই জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত চিকিৎসকরা। তাই জনগণের প্রাণের দাবিতে সবসময়েই তারা এগিয়ে এসেছে , প্রাণ দিয়েছে। সে ৫২ বা একাত্তরে। স্বাধীনতা অর্জনেও রয়েছে নাম জানা না জানা অসংখ্য চিকিৎসকের আত্মত্যাগের ইতিহাস।

প্রখ্যাত শল্য চিকিৎসক  ডা. শামসুদ্দিন আহমেদকে তার চাচা হাসপাতালে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি শান্ত হাসি হেসে বলেছিলেন, এখনই আমাদের বড় প্রয়োজন, তাছাড়া যুদ্ধনীতি অনুযায়ী হাসপাতালে যুদ্ধ বা রক্তক্ষয় হওয়ার কথা নয়। অথচ পাকসেনারা হাসপাতালে ঢুকে তাকে ধরে এনে হোস্টেলের সামনে গুলি করে হত্যা করে। লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালে ঢুকে পাকসেনারা হত্যা করে ডা. আব্দুরর হমানসহ নার্স, গার্ড এমনকি রোগীদেরও।

দিনাজপুর সদর হাসপাতালে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য অবস্থানকারী ডা. মো. আব্দুল জব্বার গ্রামে গমনরত স্ত্রী পুত্র কন্যাকে বিদায় জানানোর সময় বলেছিলেন, আরে ডাক্তারদের আবার শত্রু আছে নাকি। আমার কিচ্ছু হবে না। অথচ হাসপাতালের ভেতরে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ডা. রফিক আহমেদের ধারণা ছিলো, যুদ্ধের সময় ডাক্তারদের মারবে না ওরা, অথচ তাকে পাকসহযোগী অবাঙালিরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল। চক্ষু চিকিৎসক আব্দুল আলীম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। কিন্তু ধরে বেঁধে অসহায়ের মত মারবে এটা আমি ভাবতে পারি না। অথচ তাকেই ১৭ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া গেলো হাত দুটি পিছমোড়া করে বাধা অবস্থায়। কপালের বাঁ দিকে বেয়নেটের গভীর ক্ষত। চোখে বাধা গামছা গলায় এসে ঠেকেছিলো। বুকে অসংখ্য গুলি। সব মিলিয়ে বিভীষিকাময় এক চেহারা।

১৮ ডিসেম্বর পাওয়া গেলো ডা. ফজলে হোসেন রাব্বীর মৃতদেহ। তার স্ত্রীর লেখনি মতে, হ্যাঁ তিনি ঘুমিয়ে আছেন শান্তিতে । মুখটা ডানদিকে একটু হেলানো, বাঁ দিকের গালের হাড়ে ও কপালের বাঁ পাশে বুলেটের ছিদ্র। সারাটা বুকে বুলেটের অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন- কত আমি গুনিনি। তবে একথা মিথ্যা তার বুক কেটে ফেলা হয়েছিলো। আমি সে বুক দুহাতে ধরেছি।

ডাঃ জাহানারা রাব্বী আরো লিখেন, আমাদের পৃথীবিতে যখন জন্ম তখন মৃত্যুও একদিন হবে। আমার স্বামীর সঙ্গে আমার কথাই ছিলো তিনি আগে যাবেন। প্রশ্ন আমার একটাই, কিন্তু এভাবে কেনো?

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মূল উদ্দেশ্যই ছিলো জাতিকে মেধাশূন্য করা। কারণ সকল শহীদ চিকিৎসকই প্রত্যক্ষ সক্রিয়তা দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বপক্ষে।  

যে নির্মল বাতাসে প্রতিদিন সকালে বুক ভরে শ্বাস নিই , যে বাংলায় কথা বলি, গর্বভরে বলি- আমরা বাংলাদেশি, সেই বাংলাদেশ অর্জনে যাদের অবদান তাদের ভুলে যাওয়া একান্তই স্বজাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। অবশ্য বাঙ্গালির বিশ্বাসঘাতকতার রক্ত তো সেই মীরজাফরের কাল থেকেই বহমান। এখনো তাই শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক চলে, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করেন কেউ কেউ।

তরুণ প্রজন্মের একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার যেনো আমাদের পূর্বসূরীদের সেই আত্মত্যাগের ইতিহাস ভুলে না যাই। আমরাও যেনো তাদের মত বুঝি, এদেশের মানুষের এখনো আমাদের দরকার। এদেশের প্রতিটা মানুষ যেনো আমাদের সেবা থেকে কোন অযুহাতেই বঞ্চিত না হন। তাহলেই হয়তো শহীদ চিকিৎসকদের প্রতি প্রকৃত সন্মান দেখানো হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৬ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।