একাত্তরের উত্তাল মার্চ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো।
বাবা-মা, ভাই-বোন, কাকা-মাসি ছিলেন পায়ে হাঁটার দলে। অবশ্য মাসি এসেছিলেনে মামার বাড়ি থেকে বেড়াতে। এসেই পড়লেন বিপাকে। গ্রামছাড়ার সময় তাকেও সঙ্গী হতে হয়েছিল।
বাবার মুখে শোনা গল্পই বলছি। যে গ্রামে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম সেখানে বাবার খুবই সুনাম ছিল। পেশায় তিনি ডাক্তার ছিলেন। হাতে যশ ছিল। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী মুক্তিযোদ্ধা রমেশ বড়ুয়াকে সারিয়ে তুলেছিলেন তিনি। থাক সেই কথা। বলছিলাম আশ্রিত হওয়ার গল্প।
সপ্তাহখানেক পরই খবর এলো আমাদের বাড়িঘর ও ফকিরা বাজারে বাবার যে ফার্মেসি তা সুদ্ধ পুড়িয়ে দিয়েছে পাকিবাহিনী। আমরা তালা মেরে চলে আসাতে হয়তো রাজাকাররা মনে করেছিল ‘মুক্তির’ খাতায় নাম লিখিয়েছি সবাই। তাই প্রতিহিংসা ও আক্রোশের বশবর্তী হয়ে অগ্নিকাণ্ড। সেই আগুনে পুড়েছে আরও অনেকের বাড়ি। অনেকের দোকান।
বড় হওয়ার পর মায়ের মুখে শুনেছিলাম, অগ্নিকাণ্ডের খবরে বাবা খুব কেঁদেছিলেন। সারা দিন কেঁদেছিলেন।
কয়েক সপ্তাহ পরই সোনাইছড়িবাসীর মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। কানাকানি ফিসফিস চলছে। মিলিটারি এলো বলে। ওই গ্রামে তখন কয়েকশ’ আশ্রিত। উদ্বেগের কারণ রাজাকার-আলবদরদের দেখানো পথে হাঁটছে মিলিটারি। অবশেষে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মায়ানমার পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন বাবা-কাকারা।
একদিন নিশুতি রাতে তল্পিতল্পাসহ আবার দুর্গম পথে হাঁটা শুরু করলো আমাদের দলটি। গন্তব্য ওপারের বলিবাজার। একেতো রাতের আঁধার, তার ওপর গহিন জঙ্গল। ভয়ে গায়ের রোম খাড়া হওয়ার জোগাড়। এভাবে ভোর হয়। সবাই ক্ষুধার্ত। দূরে দূরে পাহাড়চূড়ায় দু-একটি বাড়ি। তাদের একটিতেই আমরা উঠি। বিশ্রামের জন্যে। কিছু চেয়ে নিই খাওয়ার জন্যে। ‘তারা’, তিতকরলা ইত্যাদি সবজি লবণ দিয়ে কোনো রকমে সেদ্ধ করে গরম গরম ভাত দিলেন গৃহস্থ। পরম তৃপ্তি ভরে খেলেন সবাই। সন্ধ্যায় ফের যাত্রা শুরু হলো। রাত ঘনিয়ে আসার পরই মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো নতুন বিপদ দেখা দিল।
একদল ডাকাত গতিরোধ করলো আমাদের। সবাই শরণার্থী। ডাকাতরা পুরুষদের আলাদা লাইনে দাঁড় করাল। নারী ও শিশুরা অন্য দিকে জটলা করে আছে। সবার চোখ ছানাবড়া। অস্ত্র তাক করে আছে ডাকাতরা। ভয় দেখাচ্ছে ব্রাশ ফায়ার করবে যদি না সব সোনাদানা, দামি জিনিসপত্র তাদের দিয়ে দেওয়া হয়। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে হাউমাউ করে কান্নার রোল পড়ে গেল জটলার ভেতর। এর মধ্যেও আমার মা সোনাদানার বড় একটি অংশ আমার কোমরে গুঁজে রাখলেন। তার ধারণা ছিল ছোট ছেলে হিসেবে আমাকে সন্দেহ করবে না। হলোও তাই। বাবার হাতে, মায়ের হাতে, সবার হাতে যা ছিল সবই ডাকাতদের ঝুলিতে গেল। শুধু আমার কোমরেরটাই ছিল অক্ষত।
আশানুরূপ সোনাদানা পেয়ে ডাকাত দল আঁধারে মিশে গেল। কিন্তু ছেলে-বুড়ো সবার ভয় কাটছে না। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর একসময় সম্বিত ফিরে পেলেন বাবা-কাকারা। রাত পোহাচ্ছে। আর দেরি করা উচিত হবে না। সীমান্তের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। পুনর্যাত্রা শুরু হলো। এবার ধীরগতিতে হাঁটছে সর্বস্বান্ত পোড়খাওয়া একদল মানুষ। যাদের ঘরে ভয়, দেশে ভয়, চলতি পথে ভয়। জীবনের ভয়, মরণের ভয়। অবশেষে বলিরবাজার পৌঁছি আমরা।
আবার সংগ্রাম। আবার কষ্টের জীবন। কাছারি ঘর, রসুইঘর, চিলেকোটা কিছুই বাদ নেই। শরণার্থী আর শরণার্থী। তাঁবু খাটানো হয়েছে। একেকটি তাঁবুতে দুই-তিন পরিবার। গাদাগাদি করে থাকছে। কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। বাবা উদয়াস্ত খাটছেন কৃষিজমিতে। তারপরও দুবেলা খাবার জুটছে না সবার। একবেলা খেয়ে আরেক বেলা জল। কোনো কোনো দিন দুবেলাই উপোস। সীমাহীন কষ্ট।
আমার হলো কঠিন ডায়রিয়া। মা-বাবা আমাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন যমের সঙ্গে যুদ্ধ করে। সব কষ্ট ম্লান হয়ে যায়, যখন একেকটি লড়াইতে জয়ের খবর আসে। শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর আসে। এভাবেই কেটে যায় চার-পাঁচ মাস। বড় হয়ে যাই আমি। চার বছরের শিশু।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই উখিয়া সীমান্ত দিয়ে দেশে ফিরি আমরা। বিরানভূমি রামু। সোনার সংসার লণ্ডভণ্ড। দোকান পুড়ে ছাই। পোড়া বাড়িতে আগাছা জন্মেছে। আবার বাবা কষ্ট করলেন। সীমাহীন কষ্ট। ধারকর্জ করে, নিজে খেটে খোলা আকাশের নিচে দোকানটি কোনো রকমে দাঁড় করালেন। বাড়ি তোলার সামর্থ্য কই। দোকানের পেছনে একটি কামরাই হয়ে গেল আমাদের থাকার ঘর। তারপরও খুশি বাবা-মা। নিজের দেশ, স্বাধীন দেশ। যেখানে লাল-সবুজের পতাকা উড়ে। গর্বে বুক ভরে ওঠে।
একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন, যিনি বাবাকে খুবই পছন্দ করতেন। এক রাখাইন পরিবার বাড়িসহ ভিটা বিক্রি করছে জানতে পেরে তিনি বাবাকে চার-পাঁচ হাজার টাকা দিলেন। যুদ্ধের সময় রাখাইন পরিবারটিও মায়ানমার আশ্রয় নিয়েছিল। পরে এখানকার ভিটেমাটি বিক্রি করে তারা স্থায়ীভাবে ওপারে চলে যান।
আমার বাবার ঘনিষ্ট কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যাদের আমি চাচা ডাকি। এর মধ্যে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমদ, আবু আহমেদ, রমেশ বড়ুয়া, নুরুল ইসলাম বাঙালি, নুরল হক, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাদের টিম লিডার ছিলেন হাবিলদার আবদুস সোবহান।
মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফার আহমেদ ও আবু আহমেদ‘র মুখে শুনেছি, রামুর ঈদগড়, নতুন মুরংপাড়া, কাউয়ার খোপ, মনির ঝিল, লামা থানা এলাকায় পাকি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। রামু-কক্সবাজার-বান্দরবান এলাকা ছিল তাদের। লামা থানা, রামু থানা, উখিয়া থানায় অপারেশন করেছেন তারা। ডিসেম্বরের একদিন কাউয়ারখোপ, মনিরঝিল হয়ে মেইন সদরে গেলে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে আশঙ্কা করে তারা সোনাইছড়ি ক্যাম্প করতে যান। তখন খবর আসে রোহিঙ্গা সলিটারি অর্গানাইজেশন (আরএসও) রামু থানা অপারেশন করবে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। আরএসও ছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী (পুরুইক্কা)। তাই মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত রামু থানা অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন এবং সফল হন।
আমি গর্বিত, বয়সে শিশু হলেও নিজের চোখে একাত্তর দেখেছি। আজ যে লাল-সবুজের পতাকা উড়ছে তার জন্যে যে মূল্য দিতে হয়েছে তার সাক্ষী হতে পেরেছি। তাই তো হৃদয়ে যেমন চেতনায়ও তেমনি একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, মা-মাটি-দেশের প্রশ্নে নিরপেক্ষ থাকতে পারি না। আমি সবসময় দেশের পক্ষে, লাল-সবুজের পতাকার পক্ষে।
লেখক: বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ও ব্যুরো এডিটর, চট্টগ্রাম
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৬
টিসি/জেডএম