নানি সবে কাঠের চুলায় ভাত বসিয়েছেন। মা, খালারা তখন সবজি, তরকারি কেটে দুপুরের খাবার যোগাড়ে সাহায্য করছেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে বলে শুনেছি মায়ের মুখে। মায়েরা চার পাঁচ বোন ছিলেন। তাই পাকিস্তানি হায়েনাদের ভয়টা একটু বেশিই ছিলো তাদের।
সাতক্ষীরার টাকি, হেঙলগঞ্জ, বসিরহাট সংলগ্ন এলাকা ভাতশালা আমার নানাবাড়ি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকা এ এলাকাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো বলেই জানি। মায়ের শিক্ষক ক্যাপ্টেন শাজাহান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম শক্তি।
বাবার গল্পটা আবার আলাদা। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। লেখালেখি করেন, আঁকেন, প্রচ্ছদ করেন। সঙ্গে রাজনীতিও। অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য টাকি ক্যাম্পে দিতে গিয়েছিলেন পরীক্ষা। বিএ পাস ছিলেন, তাই কমিশন ৠাংকে ভাইবা নেন সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ও আ স ম রব। কিন্তু মেডিকেলে উত্তীর্ণ হলেও মেজর জলিল সম্মুখ যুদ্ধে যেতে বাধা দেন। বাবার বুকের বাঁপাশে একটি জন্মদাগ আছে। সেটি দেখে বলেন, তোমার অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যাওয়ার দরকার নেই। তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। নিতান্ত যদি না শোনো তাহলে পলিটিক্যাল কোরে কাজ করো।
সে নির্দেশনা মেনেই শেষ পর্যন্ত কাজ করেছেন। বসিরহাট, টাকি অঞ্চলেই ছিলো তাদের বিচরণ। রাজাকাররা খবর পেয়ে দাদাবাড়ি গিয়ে ঘরবাবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছে। বাবারা তিন ভাইয়ের দুজন তখন সরকারি চাকরি করতেন। বাবাকে নিয়ে নানা ধরনের মিথ্যাচারিতা করতে হয়েছে দাদাকে। তবু বাড়ি থেকে হাঁস, মুরগি ধরে নিয়ে যাওয়া, গাছের ফল পেড়ে নেওয়ার মতো ছোটলোকি করতে দ্বিধা করেনি পাকিস্তানি দোসররা।
বহুদিন বাড়ি ফিরতে না পেরে বাবা গোপনে একদিন দাদা-দাদির সঙ্গে দেখা করতে ইছামতি নদী ধরে পা বাড়িয়েছিলেন বাড়ির পথে। কিন্তু সে যাত্রা হতে চলেছিলো শেষ যাত্রা। পাকিস্তানি সেনাদের অতর্কিত গুলির ভেতর নদীর কর্দমাক্ত ভেড়িতে অন্ধকারে শুয়ে কাদা মেখে বেঁচে গিয়েছিলেন সেদিন। যার ফলস্বরূপ পরবর্তীতে শ্বাস নিতে পেরেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে।
আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। দেখেনি স্বাধীনতার সময়কার সেই উত্তাল দিনগুলি। দেখেনি বিজয়ের পর সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতার বাঁধভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাস। আমাদের চুলায় ভাত চাপিয়ে শঙ্কায় থাকতে হয় না রান্না শেষ হবে কিনা, বাড়ি ফেরার পথে পা বাড়িয়ে ভাবতে হয় না রাজাকাররা পথে ওত পেতেছে কিনা কিংবা কোনো খাকি পোশাকধারী হায়েনা তাক করে আছে কিনা বন্দুকের নল। পরাধীনতার শিকল ভাঙতে মায়ের অশ্রুভেজা আশীর্বাদে আমরা এখন স্বাধীন।
এখনও যখন দেখি পায়ে ও পিঠে গুলির দাগ নিয়ে বেঁচে থাকা আমার এক দূর সম্পর্কের নানা টিভিতে স্বাধীনতা বিরোধীদের দেখলে মুখ ঘুরিয়ে পেছন ফিরে বসছেন, তখন ভাবি কতটা ঘৃণা করা যায় পাকিস্তানি ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের। তরুণ প্রজন্মের কাছে এটি শক্তিও বটে।
এতো কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন এ দেশে এখনও যখন দেখি যে লোকটি জীবনে কোনোদিন খেলা দেখে না সেও টিভির সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের খেলা দেখছে আর পাকিদের পক্ষে হাততালি দিচ্ছে তখনও ঘৃণা হয়। সে ঘৃণাও বোধহয় ঠিক ওই মুক্তিযোদ্ধা নানার মতোই। যখন শুনি পাকিস্তান ছিলো ভালো ছিলো, বাংলাদেশ হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে যাবে, ভারত হয়ে যাবে তখনও ঘৃণা হয়- মুর্খতার। যখন কোনো একটি জেলাকে পাকিস্তানের লেজ ধরে টিকে থাকা জামায়াত-বিএনপি ‘মিনি পাকিস্তান’ বানানোর অপচেষ্টা করে তখন ক্রিকেটার মুস্তাফিজ-সৌম্যরা প্রমাণ করে দেয় এটা বাংলার মাটি, বাংলাদেশ- অপশক্তির কাছে মাথা নোয়াবার নয়।
স্বাধীনতা সেটাই যা শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। ভালোবাসতে শেখায় নিজেকে, নিজের দেশের মানুষকে, মাটিকে। নিজেকে ভালো না বাসলে দেশকে ভালোবাসা যায় না। এগিয়ে যাওয়া যায় না উন্নতির পথে।
স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আমরা দেখিনি শুনেছি, পড়েছি বাবার এগিয়ে দেওয়া বইয়ে। বই পড়েই জেনেছি শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার গল্প, কবিতায়, গল্পে পড়েছি কষ্টার্জিত স্বাধীনতার প্রতিটি মাইলফলক, চেতনার কথা।
সেসময়ের প্রতিটি গান, ছবি, চরমপত্র, শোনা গল্প আজও রক্ত টগবগিয়ে তোলে। সেটাই এগিয়ে যাওয়া, বেঁচে থাকার শক্তি, প্রেরণা। এই শক্তিকে আঁকড়ে ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, প্রিয় মাতৃভূমি আমার।
আসিফ আজিজ: অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর, বাংলানিউজ
বাংলাদেশ সময়: ১৪১২ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৬
এএ/জেডএম