মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে সারাদেশের মতো আমাদের গ্রামেও নেমে এসেছিল অমানিশা। হত্যাকাণ্ডের মতো কোন ঘটনা না ঘটলেও হিন্দুপাড়ায় লুটপাট, জ্বালাও-পোড়াও আর মারধরের মতো ঘটনা ঘটেছিল অসংখ্য।
কিন্তু যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই একটা গুমোট ভাব বিরাজ করছিল দেশ জুড়ে। মানুষ বিভিন্ন কথা বলতো। কেউ কেউ বলতো এই দেশে থাকতে চাইলে মালাউনদের মুসলমান হয়ে যেতে হবে; না হলে বিষয় সম্পত্তি ফেলে হিন্দুস্থানে পালিয়ে যেতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি...। ওসব কথা শুনে সাধারণ হিন্দুদের মনে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছিল তখন থেকেই। বিশেষ করে যে সব ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে ছিলো তাদের মানসিক অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ।
এমন দু’একটি ঘটনা ঘটেওছিল তখন। বাড়ি থেকে মেয়েদের রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে গেছে, আর পরদিন খুঁজে পাওয়া গেছে হয়তো কোনো জঙ্গল বা ছনখেতে (কাঁশবন)।
বলে রাখা ভাল, আমাদের চূড়ালি গ্রামটি ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর থানার অধীনে। পাশের গ্রামের নাম তাতকুড়া। কিন্তু হিন্দুপাড়াটি এই দুই গ্রামকে একই সরল রেখায় নিয়ে এসেছে।
তো, দেশের এই অবস্থায় প্রথমদিকে রাত জেগে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমে হিন্দুরাই পাহারা দিতো পালা করে। পরের দিকে যখন দেশের অবস্থা আরও টালমাটাল হতে থাকলো তখন প্রতিবেশী কয়েকজন মুসলমান এসে যোগ দেয়। তারাও রাত জেগে পাহারা দিতে শুরু করে হিন্দুদের সম্ভ্রম আর সম্পদ রক্ষায়। এদের মধ্যে ‘খাঁ বাড়ি’র লোকজন ছিল খুবই আন্তরিক। তাছাড়া চানু ও ওয়াহেদ-এর বাড়ির লোকজনও হিন্দুদের পাশে ছিল সবসময়। বিশেষ করে; আমাদের বাড়ির মানুষদের প্রতি ছিল তাদের অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
তারা হিন্দুদের বাড়িতে গিয়ে বলে আসতো, আমরা আপনাদের কোন ক্ষতি হতে দেবো না। যদিও পরবর্তীতে শত চেষ্টা করেও আর রক্ষা করতে পারেন নি। কিন্তু বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে হামলা ও লুটপাটকারীদের প্রতিহত করেছিল। যার কারণে অন্য গ্রামে লুটপাট শুরু হলেও আমাদের গ্রামে হয়েছে আরও কয়েকদিন পর। হয়তো ঠেকানো সম্ভব হতো; যদি ভিন্ন গ্রামের রাজাকার বা আলবদর বাহিনীর লোকেরা পাকিস্তানি মিলিটারিদের নিয়ে হামলা না চালাতো।
আমদের পরিবার ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল ও শিক্ষিত। এলাকায় বাড়িটি ‘ভূইয়া বাড়ি’ নামে পরিচিত। আশপাশে দু’চার গ্রামের মধ্যে আমাদের দাদুর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ঘরবাড়ির দিক দিয়ে ততোটা উন্নত ছিলো না আমাদের বাড়ি। কোন দালানকোটা ছিল না আমাদের। সব ঘর ছিল টিনের। সে কারণেই লুটপাটের তালিকায় ধান-পাট, গরু-ছাগল আর অন্যান্য জিনিসের সাথে আমাদের ঘরের টিন-কাঠগুলোও ছিল। দু’একটা ঘরের চাল থাকলেও অন্য ঘরের ভিটা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। লুটপাটকারীরা ঘরের ভিটে পর্যন্ত কোদাল দিয়ে কুপিয়ে দেখেছে, মাটির নিচে কোন জিনিসপত্র আছে কি না।
যুদ্ধ যখন বেধে গেছে তখন চারদিক থেকে শুধু লুটপাটের খবর। শোনা যাচ্ছিল, আমাদের বাড়ি লুট হবে। এমন অবস্থায় আমার দাদু বা বাবা কেওই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না; আসলে আমাদের কি করা উচিত। আত্মীয়-স্বজন ও বাবার বন্ধুরা অনেকেই বলতো হিন্দুস্থানে চলো। কিন্তু আমাদের ছয় সদস্যের পরিবারে তিন জনই ছিল বৃদ্ধ। অর্থাৎ; আমার দাদু ও দুই ঠাকুমা (দাদুর দুই স্ত্রী), মা, বাবা ও আমার সাড়ে চার বছর বয়সি বড় ভাই। সবশেষে আমারদের প্রতিবেশী মুসলমানরাও বললো, এভাবে হয়তো আর আপনাদের রক্ষা করতে পারবো না। চারদিক থেকে শুধু হুমকি আসছে। আপনারা বরং হিন্দুস্থান চলে যান, আমরা যতটুকু সম্ভব আপনাদের সম্পদ রক্ষা করার চেষ্টা করবো।
একদিন রাতের আঁধারে পিতৃভিটা ছেড়ে হিন্দুস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাই সবাই। প্রথমে বাড়ি ছেড়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে চানু মিয়াদের বাড়িতে আশ্রয় জোটে। চানুদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হলেও মানুষ সৎ ছিল। তারা দাদু-বাবাদের জন্য একটি ঘর ছেড়ে দেয়। সেখানে দু’এক দিন থাকতে হবে। হিন্দুস্থানে যেতে হলে যতটুকু নিরাপত্তা দরকার, তাছাড়া দাদু-ঠাকুমাদের কষ্ট কম হয় সে দিকে খেয়াল রাখা হচ্ছিল। কিন্তু মুশকিল ছিল আমার ভাইকে সামলানো। তার সব কিছুতেই সমস্যা। নিজের বিছানা ছাড়া ঘুমাবে না, তার থালা ছাড়া খাবে না, দুধ খেতে নিজের বাটি লাগবে, ডাল খেলে কাগুজি লেবু লাগবে, আস্তে আস্তে কথা বলতে পারবে না- এই রকম অনেক মর্জি। যতোই তাকে বলা হতো; কথা বললে রাজাকার আসবে। কিন্তু সে তার কাজ করেই যেতো।
যা-ই হউক, অবশেষে শেরপুরের সীমান্ত দিয়ে ভারতের ডালু শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই মেলে তাদের। শরণার্থী শিবিরে গ্রামের অনেকের সঙ্গেই দেখা হয় বাবা দাদুদের। যারা অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত ছিল; তারা শিবিরে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি করতো ফেরি করে। অবশ্য শিবিরে বাবা-দাদুদের বেশিদিন থাকতে হয়নি। কয়েকদিন পর কাকু এসে তার কুচবিহারের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল।
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে স্বাধীন দেশে এসে ভিটে-মাটি আর দু’টো ঘরের টিনের চালা ছাড়া আর কিছুই ফিরে পায়নি। সেই সময়টাতে অর্থনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, ধনী-গরীব সবাই চলে এসেছিল এক কাতারে। তখন জানতে পেরেছিল কারা লুটপাট চালিয়েছিল আর কারা জবাই করে খেয়েছিল আমাদের বাড়ির গরু।
যতটুকু বলতে শুনেছি, আমাদের গ্রামের মানুষ দ্বারা আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হইনি এটা বলা কঠিন। তবে, অধিকাংশ মানুষই ছিল হিন্দুদের রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ। দুষ্টপ্রকৃতির কিছু লোক বাইরের গ্রামের আলবদর রাজাকারদের সঙ্গী করেই ঘটিয়েছিল নাশকতা।
[এই লেখাটি আমার বাবা ও প্রতিবেশিদের মুখে শুনা গল্পের অংশবিশেষ]
লেখক: ওয়েব ইনচার্জ, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৬
জেডএম/