টোকিও (জাপান) থেকে ফিরে: জাপান সফরে যাওয়ার আগেই দেশটির অর্থনীতি-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি ও মানুষের আচার-আচরণের একটি বর্ণনা অনেকের কাছ থেকে শুনেছি। বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের কেডিএস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রহমান বলেছিলেন, ‘জাপানের ওয়াশরুমের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার দেখলেই বুঝতে পারবেন তারা কতটা সভ্য আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জাতি।
সাধারণত বাঙালির ওয়াশরুম ব্যবহার করতে না পারা নিয়ে নানা রসাত্মক ও বিদ্রুপাত্মক কাহিনী রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ও মালয়েশিয়াসহ মুসলিম দেশগুলোতে ওয়াশরুমে পানি ব্যবহারের সিস্টেম চালু রয়েছে। অন্য অনেক জায়গায় টিস্যু পেপারের প্রচলন। এই টিস্যু পেপার ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের কাছে অস্বস্তিকর। জাপানিরা ধর্মীয়ভাবে বৌদ্ধ। ওয়াশরুম ব্যবহারের পর তাদের পানি ব্যবহারের সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়। বোতাম টিপে যে কেউই এর সহজ ব্যবহার করতে পারবেন। কমোড থাকে সবসময় উত্তাপময়, যা আপনাকে অন্যরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেবে। কোনো বোতামই জটিল নয়, সবগুলোই সহজ।
ওয়াশরুমের এমন আধুনিক সিস্টেম দিয়ে তো আর জাতি হিসেবে জাপানিদের বৈশিষ্ট্য আর এগিয়ে যাওয়ার চিত্র ফুটিয়ে তোলা যাবে না। চারদিনের জাপান সফরে আমরা ১৫ সাংবাদিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্যামিলির ৩ কর্মকর্তাসহ ১৮ জনের টিমের ক্লান্তিকর ও ব্যস্ততম সময় কাটালেও জাপান আমাদের কাছে এখনও অন্যরকম এক দেশ মনে হচ্ছে। ফিরে আসার সময় বাস থেকে বিমানবন্দরে নামার আগে একসঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে ৩ বিমানবন্দর কর্মী করজোড়ে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে বাস থেকে লাগেজ বুঝিয়ে দিলেন প্রত্যেককে। ২২টি দেশের ৫৪টি নগর ও ১৭টি মেগাসিটি দেখার অভিজ্ঞতা আমার। কোথাও বিমানকর্মীদের এমন অভ্যর্থনা চোখে পড়েনি।
উন্নতি, সভ্যতা, উদ্ভাবন- প্রায় সবক্ষেত্রেই এগিয়ে থাকা জাপানের এখন রিজার্ভ হলো ১,২৪৮ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮ হাজার কোটি) মার্কিন ডলার। রিজার্ভের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চীন, তাদের রিজার্ভ ৩,২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ব রিজার্ভের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জাপানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরে ছিল ০.৪৯ শতাংশ। ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে তাদের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ১১.১ শতাংশ ও ১২.৫ শতাংশ। প্রায় ৪৯ বছর আগের এই প্রবৃদ্ধি এখন আর জাপানে নেই। জাপানের অর্থনীতির গতি এখন নিম্নমুখী। ২০১১ সালে প্রথম ধাক্কা খায় তাদের অর্থনীতি। সেই বছর প্রবৃদ্ধি ছিল মাইনাস ০.৫ শতাংশ।
বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বড় ৩,৭৭,৯০০ বর্গকিলোমিটারের এই দেশটির ৬৬ শতাংশ এলাকাই সবুজ গাছগাছালিতে ভরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, জাপানিদের গড় আয়ু ৮৪ বছর। জন্মহার ১.৪২ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি পরিবারে দু’টির বেশি সন্তান জন্ম নেয় না। বর্তমানে দেশটির ২৫ শতাংশ মানুষ ৬৫ বছরের অর্থাৎ, কর্মদক্ষতার দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে তারা। বর্তমানে তাদের দেশে ধনী লোকের সংখ্যা ৩.৯ শতাংশ যাদের মাসিক আয় ৩০ লাখ জাপানি ইয়েন (১ ডলার = ১০৩ ইয়েন)। মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৪০.৯ শতাংশ। নিম্নমধ্যবিত্তের সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ। আর নিম্নবিত্তের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। মধ্যবিত্তের মাসিক আয় ১০ লাখ ইয়েন। নিম্নবিত্তদের আয় মাসিক ২ লাখ ইয়েন। যেখানে জাপানে আধা লিটারের একটি পানির বোতলের দাম ১০০ ইয়েনের মতো। জীবনযাত্রার ব্যয় এতো বেশি যে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের হারও কমে যাচ্ছে। টোকিও শহরে একটি কারের মাসিক পার্কিং ব্যয় কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ হাজার ইয়েন।
তাদের ওয়েবসাইট থেকে আরও জানা যায়, জাপানিরা তাদের আয়ের মাসিক ৭০ হাজার ইয়েনই খরচ করে খাবার-দাবারে। বাড়িভাড়ার খরচ ৫৩ হাজার ইয়েন। ভ্রমণের খরচ ৪১ হাজার ইয়েন। বিনোদন খরচ ২৯ হাজার ইয়েন। শিক্ষাখাতের খরচ সাড়ে ১১ হাজার ইয়েন। তারা ট্যাক্স দেয় প্রায় ৪০ শতাংশ। এতো আরাম-আয়েশ আর বিত্ত-বৈভবের পরেও তাদের জীবন মারাত্মক এক ঝুঁকিতে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভূমিকম্পের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণপ্রবণ এলাকা হলো জাপান। উত্তর আমেরিকা, এশিয়া প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪টি প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে জাপান। প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা জাপানিরা ভূমিকম্প জয় করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আশাহি গ্লাসের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা টাকো ওহাশি জানালেন, জাপানে যত উঁচু ভবন তত বেশি তার নিরাপত্তা। সুউচ্চ ভবনের স্থাপত্য সৌন্দর্যের সঙ্গে তার স্ট্রাকচারাল ডিজাইনেও ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়েছে জাপান। বরং কম উচ্চতার ভবনে এসব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবেই কম। জাপান এমন দেশ যেখানে প্রতি মাসে গড়ে একবার ভূমিকম্প হয়। কমমাত্রার ভূমিকম্পে তারা থাকে নির্বিকার। ক্ষেত্রবিশেষে এই ধরনের ভূমিকম্প তাদের দেয় এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভ’তিও। নিজের চোখেই সেটি দেখলাম ‘সেভেন-ইলেভেন’ স্টোরে কেনাকাটা করতে গিয়ে। কাউন্টারের জাপানি তরুণী অটোমেটিক ক্যাশকাউন্টারে দাঁড়িয়ে যখন ভ’মিকম্পের সময় হাসছিলেন গত ১৬ মে সন্ধ্যায়।
জাপান প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিয়েও কিছু কথা বলা যায়। পৃথিবীর ২২৪টি দেশের মধ্যে ব্যাংক রিজার্ভে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৮তম, রিজার্ভ হলো ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হলো ৬.৫ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধিতে আমাদের অবস্থান বিশ্বের মধ্যে ২৪তম। প্রতিবেশী ভারতের প্রবৃদ্ধি ৭.৩ শতাংশ। তার চেয়েও এগিয়ে মায়ানমার। তাদের প্রবৃদ্ধি ৮.৫ শতাংশ। আর বিশ্বে জাপানের প্রবৃদ্ধি হলো ১৯১তম। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও ভ’মিকম্প মোকাবেলা করেই বাঁচতে হয় বাঙালিদের।
বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় গাড়ি উৎপাদনকারী দেশ হলো জাপান। গত বছর কেবল টয়োটাই উৎপাদন করেছে ১০ লাখ গাড়ি। পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় ১০টি গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ৪টি জাপানের। নিশান, হোন্ডা, সুজুকির অবস্থান হলো যথাক্রমে ৪, ৮, ১০। মারুবেনি ট্রেডিং কোম্পানির ৬৭টি দেশে ১৩২টি শাখা রয়েছে। খাদ্যসামগ্রী, কেমিক্যালসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ব্যবসার পরিধি হলো ১১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী নির্মাতা সনি, হিটাচি, মিতসুবিশি, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ওবাইশি, টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি এনটিটি ও শিপিং কোম্পানি এনওয়াইকে-এর মতো পৃথিবীবিখ্যাত সব কোম্পানির ব্যবসা রয়েছে বাংলাদেশে।
জাপানিদের প্রযুক্তি, দক্ষতা ও উদারনীতি কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার অনেক সম্ভাবনাই রয়েছে। প্রতিবেশী মায়ানমার জাপান থেকে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা পেয়েছে। শোনা যায়, জাপান-মায়ানমারের এই সহায়তায় মধ্যস্থতা করেছেনএকজন বাংলাদেশি শিল্পপতি ও রাজনীতিবিদ। সবক্ষেত্রেই জাপানি সহায়তা আমরা আরো কতটা বাড়াতে পারি সেই ব্যাপারে এখনই আমাদের সরকারের নীতিনির্ধারকদের কৌশলও পরিকল্পনা আরও কার্যকর হওয়া প্রয়োজন।
লেখক: রফিকুল বাহার, সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৬
এএ