বঙ্গ জীবন তো নয়ই, এমনকি কর্মজীবনে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে এতটা হতাশা আগে কোন দিন আসেনি। জীবনের কোন একসময় দেশের মেডিকোলিগাল সার্ভিসের সাথে জড়িত ছিলাম বলেই হয়ত আমার এই অনুভূতি।
ছাব্বিশ বৎসরের এক মাতাল নারী পুলিশের কাছে গিয়েছিল নালিশ নিয়ে, যে এক কালো এশিয়ান তাকে ধর্ষণ করেছে। পুলিশ নালিশটি আমলে নিয়ে পরীক্ষার জন্য সেই নারীকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। খালি চোখেই চুল, আর কাপড়ের বিভিন্ন অংশে বীর্য দেখা যাচ্ছিল। তাই যোনি পথের পাশাপাশি চুল আর শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে স্যাম্পল নেয়া হল ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। পরে বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে উভয়ের সম্মতিতে যৌন মিলন নিশ্চিত হয়ে সেই নারী আবার পুলিশের কাছে এসে তার অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিল।
সমসাময়িক সময়ে টেলিফোনের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে পুলিশ ৩৭ বৎসরের এক নারীকে বন্ধ এক টয়লেট থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো হাসপাতালে। মদ খেয়ে চুর হওয়া সেই নারীর পরনের কাপড় ছেঁড়া, শরীরের বিভিন্ন অংশের কালশিটে আর ছিলা জখম দেখে পুলিশ যৌন নির্যাতন সন্দেহ করেছিল।
এই নারীর যোনিপথ আর শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে স্যাম্পল নেয়া হল ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। ডিএনএ পরীক্ষার ফল বেরুলে দেখা গেল, উভয়ক্ষেত্রে ডিএনএ একই ব্যক্তির যা ভিক্টিমদ্বয়ের যোনি পথ ব্যতিরেকে শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিটিকে গ্রেফতার করে আইনের হাতে সোপর্দ করলে কোর্ট অভিযুক্তের কোন কথা না আমলে না নিয়ে শুধু ডিএনএ প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ছয় বৎসরের সাজা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেন। জেলে দেড় বৎসর সাজা কাটানোর পর উচ্চ আদালতে তিনি আপীল করেন। আপীলে তার বক্তব্য ছিল, শুধু ডিএনএ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে তাকে যে সাজা দেয়া হয়েছে তা ভুল। আপীল গৃহীত হলে আবার শুরু হয় মামলার তদন্তক্রম। ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঘটনা ১ এবং ঘটনা ২ এর উভয় ভিকটিমকে একই হাসপাতালের একই বিছানায় বসিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে ডিএনএ পরীক্ষার স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছিল।
যেহেতু ঘটনা ১ এ সম্মতিতে যৌনমিলন হয়েছিল এবং বীর্যপাত যোনিপথের বাইরে করা হয়েছিল, তাই চুল ও শরীরের অন্যান্য উন্মুক্তস্থানের বীর্য, ঘটনা ১ এর ভিকটিম থেকে হাসপাতালের বিছানা এবং হাসপাতালের বিছানা থেকে ভিকটিম ২ এর স্পর্শে যাওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। আদালত আপীলের রায়ে এই সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে অভিযুক্তকে সাজা ভোগের ক্ষতিপূরণসহ সসম্মানে মুক্তির আদেশ দেন।
উপরের ঘটনা দুটিতে আলোকপাত করলে দেখা যায়, সেখানে পুলিশের ভুল, হাসপাতালের গাফিলতি, তদুপরি ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহকারীর অদূরদর্শিতা সবকিছুই বিদ্যমান ছিল। ফলে নিরীহ এক ব্যক্তিকে অকারণে দেড় বৎসর জেলে কাটাতে হয়। অথচ যাদের ভুলে এই সাজা তারা সবাই এখন লোক চক্ষুর অন্তরালে! আর ভুক্তভোগীর রুঢ় দৃষ্টি এখন চূড়ান্ত মতামত প্রদানকারী ঐ ফরেনসিক ডাক্তারের দিকেই। নির্দোষ ব্যক্তিটি পুরা পুলিশবাহিনীকে পরোক্ষভাবে দোষারোপ করলেও ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারকে সরাসরি নাম ধরে দোষারোপ করছেন। আর এজন্যই ফরেনসিক ডাক্তারকে স্পর্শকাতর মামলা তো বটেই, প্রতিটি মামলার প্রতিটি স্তরে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।
এরকম দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর জনগণ উত্তেজিত হলে পুলিশ শুধু অন্যত্রই তাকিয়ে থাকে না, বরং আকারে ইংগিতে অন্যের কাঁধে দোষ চাপাতে তৎপর হয়। সোহাগী তনুর ময়নাতদন্তের পর্যালোচনা করা হলে এটি পরিষ্কার যে, প্রথম ময়নাতদন্তের প্রটোকলে মেজর কোন সমস্যা ছিল। এখানে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সীমাবদ্ধতা পুরো মেডিকোলিগাল ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। সীমাবদ্ধতা অনিচ্ছাকৃত হলেও তা ধোপে টিকবে না, কেননা বিশেষজ্ঞের না জানাটাও অপরাধ। তবে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত কেন অন্যত্র করার আবেদন করা হয়নি তার জবাব পুলিশকেই দিতে হবে? সোহাগী তনুর উত্তোলিত লাশের দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের কীর্তিমানদের বিব্রত হওয়া উচিত ছিল।
কেননা জানামতে, দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত দলের দলনেতা ওতোপ্রতভাবে প্রথম ময়নাতদন্তে জড়িত ছিলেন। সম্ভবত একারণেই অতি আত্মবিশ্বাসে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তেও প্রটোকল যথাযথভাবে মানা হয়নি। প্রবাদই তো আছে, মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। ডিএনএ পরীক্ষা সম্পর্কে ন্যুনতম জ্ঞান সম্পন্নরা নিশ্চয়ই জানেন যে, ডিএনএ স্যাম্পলের বড় আপদ হল, তা স্পর্শাদি দ্বারা দুষিত হতে পারে। তারপরও পুলিশ আর বাদীর পাশাপাশি দ্বিতীয় ময়নাতদন্তকারী দল যেভাবে সমস্বরে ডিএনএ নির্ভর হয়েছেন, তাতে করে মনে হচ্ছে- ডিএনএ সম্পর্কে তাদের কারো কোন ধারণাই নাই। মনে রাখতে হবে,
১। ডিএনএর উপস্থিতি যেমন সব সময় ভিকটিম ধর্ষিতা কিনা তা প্রমাণ করে না, তেমনি
২। ডিএনএর অণুপস্থিতিও সব সময় ভিকটিম ধর্ষিতা কিনা তা প্রমাণ করে না, আর
৩। ফরেনসিক প্রতিবেদন এক ধরনের পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভরশীল নয়।
স্বাভাবিক চোখে দেখলে বলা যায়, সোহাগী তনু হত্যায় একেবারে গ্যাঁড়াকলে পড়েছে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তকারী দল। তিন কুল হারিয়ে কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারছে না। কুল বাঁচানোর পরামর্শ সভাও থেকেছে পরামর্শহীন। সাময়িক প্রতিবেদন না দিয়ে তারা যে নিয়মের বত্যয় ঘটিয়েছে তার কৈফিয়ত তাদেরকে দিতেই হবে। তার উপর “ধর্ষিতা হয়েছে” এ ধরনের প্রতিবেদন দিলে নিজ পেশায় নিয়োজিত অন্য সবার বিরাগভাজন হবেন, আর “ধর্ষিতা হয়নি” রিপোর্ট দিলে ডিএনএ প্রতিবেদনকে চ্যালেঞ্জ দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে ডিএনএ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে কোর্টে লেজে গোবরে অবস্থা সৃষ্টি হবে।
অনেকেই বলেন, আমি সেই স্থানে থাকলে কিভাবে প্রতিবেদন দিতাম। আমার অবস্থান এক্ষেত্রে পরিষ্কার। প্রতিবেদন তিন প্যারাগ্রাফে প্রস্তুত করতাম। প্রথম প্যারাগ্রাফে থাকত ইতিহাস, দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে আমার পরীক্ষা ও তার ফলাফল আর তৃতীয় প্যারাগ্রাফে প্রাপ্ত ফলাফলের ইন্টারপ্রিটেশন আর জাস্টিফিকেশন।
ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে সেটিও উল্লেখ থাকত তৃতীয় প্যারাগ্রাফে।
কলিকালে রাজনৈতিক প্রটেকশন কোন কাজে আসবে বলে আমি মনে করি না। কেননা আদালতের দৃঢ়তায় ঐসব রক্ষাব্যুহ কাঁচের দেয়ালের মত ভেঙ্গে পড়বে। তবে ধর্ষক যদি ক্ষমতাশালী হয় তাহলে তা থেকে কিছু ফায়দা পাওয়া যেতে পারে। আইনের ক্ষেত্রে ময়নাতদন্তকারীর পদ বা শিক্ষাগত যোগ্যতায় দায়মুক্তির কোন সুযোগ নেই।
দায়িত্ব নিয়েই বলতে পারি, কলিকালের বাংলাদেশে অনেক সাধারণ প্রভাষক অনেক অসাধারণ সহকারী বা সহযোগী অধ্যাপক থেকে বেশী জ্ঞান রাখেন। সেই সব অসাধারণ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা আগামীতে আইনের কাজে নত হবেন তা বলাই বাহুল্য।
অজপাড়াগাঁয়ের সোহাগী তনুর ঘটনা এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে সবার সামনে এসেছে। এই ঘটনা থেকে ময়নাতদন্তে জড়িত প্রতিটি মানুষ যদি শিক্ষাগ্রহণ করেন, তবেই হয়ত সোহাগী তনুকে সম্মান জানানো হবে- যার জন্য সে উপযুক্তও বটে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম: বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়া। ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৬
জেডএম/