ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

চট্টগ্রামকে অনেক দিয়েছেন, দুঃখিত বাবুল আক্তার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০১ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৬
চট্টগ্রামকে অনেক দিয়েছেন, দুঃখিত বাবুল আক্তার

স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে দুষ্কৃতিকারীরা নির্মমভাবে হত্যার পর পুলিশ সুপার পদমর্যাদার সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের নাম বেশি প্রচারিত হচ্ছে। এই কারণে তিনি সাধারণের কাছে বেশ জনপরিচিতি পাচ্ছেন? নাকি আগে থেকেই তার সাহসী, পেশাদারী মনোভাব ও সততার জন্য তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশি আলোচিত ও আলোকিত এক সরকা‍‍রি কর্মকর্তা ছিলেন।

কেন সে ব্যাখা দিচ্ছি একের পর এক।

এক. বছর সাতেক আগে জিইসি মোড়ের পেনিনসুলা হোটেলের বিপরীত দিক থেকে মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছিলাম। পার হয়ে স্বচ্ছ কাঁচঘেরা ক্যাপসুল লিফটে হোটেলের রেস্টুরেন্টে উঠছিলাম। এমন সময় বাবুল আক্তারের ফোন। জিজ্ঞেসকরলেন, কোথায় আপনি? আমি সরাসরি জবাব দিলাম, পেনিনসুলার লিফটে। জবাব শুনে বাবুল আক্তার বললেন, আপনার জবাব শুনে খুব খুশি হলাম। অনেকেই সাধারণত টেলিফোনে নিজেদের অবস্থান গোপন রাখার চেষ্টা করেন। আমি পুলিশি অভিযান ছাড়া ফোনে কখনও নিজের অবস্থান গোপন করিনা। আমি বললাম, বাবুল আক্তারের সঙ্গে মিথ্যা বলে পার পাওয়া যাবে না।

দুই. জঙ্গি তৎপরতা, অস্ত্র উদ্ধার, মামলায় সহায়তা করা, সমস্যার দ্রুত সমাধান করে দেওয়া-এই ছিল বাবুল আক্তারের পেশার পুঁজি। সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলে, কষ্টে রেখে সুবিধা আদায়ের কৌশল থেকে তিনি ছিলেন অনেক দূরে। সেই সম্মান রাষ্ট্র তাকে দিয়েছে। তিনি পুলিশ পদক পেয়েছেন, রাষ্ট্রপতি পদকও পেয়েছেন। এমন জাঁদরেল অফিসার দেখতে কেমন? কেমন তার আচরণ? সাধারণের মনে এই ধরনের প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক। আমার ২৬ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে অল্পকয়েকজন পুলিশ অফিসারের দেখা পেয়েছি যাদের কাজ, ব্যক্তিত্ব, সাহসিকতা ও স্মার্টনেস আমার এখনও মনে গেঁথে আছে। এদের একজন হলেন বাবুল আক্তার। সেই বাবুল আক্তারেরও যে আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে সেটি তুলে ধরলেই বোঝা যাবে।
 
তিন. হালকা-পাতলা গড়নের সাধারণ এক বাঙালি তিনি। বিনয় তার অহংকার। কথা বলেন ধীরে ধীরে, মৃদু স্বরে। সহজে কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন, ক্ষমতা দেখিয়েছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এমন নজির নেই।   কঠিন সময়েও তিনি থাকেন নির্বিকার, ধীরস্থির। পোশাক-আশাক, চাল-চলন সাধারণ এক সরকারি কর্মকর্তার মতোই। অথচ পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের আয় সম্পর্কে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধারণা একটু অন্যরকম। পুলিশ সুপার ছাড়াও পুলিশ ইন্সপেক্টরদের আয় আর সম্পদ নিয়ে অনেক কাহিনী। পুলিশে একটি কথা চালু আছে, যার টাকা বা সম্পদ বেশি সবই শ্বশুরের দিক থেকে পাওয়া। এ নিয়ে বেশহাসি-তামাশা আছে পুলিশের মধ্যেও। তবে এটা ঠিক, বাবুল আক্তারের মতো পুলিশ অফিসারের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়।

চার. বছরের পর বছর বাবুল আক্তার অবৈধ অস্ত্র, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পেরেছেন। সেখানে তাকে সহায়তা করেছেন তার জীবনসঙ্গিনী প্রিয়তমা স্ত্রী মিতু। তাদের ভালবাসার ধন দুটি শিশু সন্তান। এই দুজনকে আগলে রেখেছিলেন মিতু। এখন মিতু নেই। মা হারা এই শিশু সন্তানদের কে দেখবে? আমরা যদি প্রত্যেকেই নিজের ক্ষেত্রে এরকম ভাবি যে আমার ছেলেমেয়েদের মায়েরও কোন কারণে অকালমৃত্যু হয়েছে। তখন? আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, মাথা একেবারেই বিগড়ে যাবেন, অস্থির হয়ে যাবেন, এক কথায় আপনি পাগলপ্রায়। বাবুল আক্তার আপনি কেমন আছেন? এখন আমরা জানিনা। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি আপনি আপনার মধ্যে নেই।

পাঁচ. আমার জানামতে বাবুল আক্তার ছিলেন এমন এক অফিসার, যাকে ভালবেসে কেউ একটা টিকেট দিলে তবেই তিনি বিমানে চড়ে ঢাকায় যান কিংবা আসেন। স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তার কাছে বায়না ধরেছিলেন, চট্টগ্রামের পাঁচতারকা হোটেল রেডিসনে খাবেন। স্ত্রীর সেই বায়না তিনি মেটাতে পারেননি। ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামের চিটাগং গ্রামার স্কুলে (সিজিএস) পড়াবেন বলে এক শিল্পপতির স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। মাসিক টিউশন ফিসহ যাবতীয় খরচের কথা শুনে মিতু আক্তার দমে গিয়েছিলেন। অথচ বাবুল আক্তারের চেয়ে অনেক জুনিয়র পুলিশ অফিসারের ছেলেমেয়েরা নামি ও ব্যয়বহুল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে।   প্রিয়তমা স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে বাবুল আক্তারকে এসব দুঃসহ স্মৃতি কি কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে না, কষ্ট দেবে না? বাবুল আক্তারের কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় সাহসিকতার নিদর্শন রেখেছিলেন পুরো চট্টগ্রামজুড়ে। চট্টগ্রামকে তিনি দিয়েছেন। বিনিময়ে এই চট্টগ্রামে তিনি হারিয়েছেন তার অবুঝ সন্তানের গর্ভধারিণী মা মিতু আক্তারকে। দুঃখ আর কষ্টেরও একটা সীমা থাকে। সেই সীমানার বাইরে এখন বাবুল আক্তার। কষ্টের জীবন, সুখের দাম্পত্য, পেশাদারি মনোভাব আর কঠিন বাস্তবতা বাবুল আক্তারকে এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যেখানে তিনিএকা নন। গোপন খবর হল এই, বাংলাদেশের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফী মিজানুর রহমান তার দুই মা হারা সন্তানের শিক্ষার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কষ্ট করে শিল্পগড়া, হাজার বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ধর্ম ও মানবিকতায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেশ-বিদেশে আলোচিত এক নাম সুফী মিজানুর রহমান। তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই তার সাত সন্তান অর্থাৎ পিএইচপির সব পরিচালক একমত হয়েছেন বাবুল আক্তারকে এই মানবিক একইসঙ্গে মানসিক সাপোর্ট দেয়ার জন্য।

রফিকুল বাহার
আবাসিক সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন লিমিটেড
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।