ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

তারকারা নয়, ছেলের চোখে বাবাই নায়ক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৩ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
তারকারা নয়, ছেলের চোখে বাবাই নায়ক

[বাবাদিবসকে মাথায় রেখে টাইম ম্যাগাজিনে দারুণ এক নিবন্ধ লিখেছেন মাইকেল কিম্মেল। আজকের পশ্চিমা জগতে পুরুষত্বের সাবেকি ধারণা কিভাবে আমূল পাল্টে যাচ্ছে, পরিবার ও সন্তানের প্রতি ঔদাসিন্যের বদলে আজকের বাবারা সন্তানের লালন পালন, দেখভাল করা ও ঘরকন্নার কাজে কিভাবে অনেক বেশি সময় দিচ্ছেন, কিভাবে তারা সন্তানের চোখে হয়ে উঠছেন স্বপ্নের নায়ক ---সে কাহিনিই তুলে ধরেছেন এই মার্কিন লেখক।

মাইকেল কিম্মেল পেশায় Center for the Study of Men and Masculinities at Stony Brook University-র নির্বাহী পরিচালক।   ‘Manhood in America’ নামের একটি সাড়া জাগানো বইয়ের লেখক তিনি। ভাষান্তর করেছেন কনসালট্যান্ট এডিটর জুয়েল মাজহার]

আজ থেকে ৩০ বছর আগে ‘ম্যাসকুলাইনিটি’(পৌরুষ) বিষয়ের ওপর শিক্ষকতাকালে ছাত্রদের কাছে আমি জানতে চাইতাম তাদের চোখে স্বপ্নের নায়ক কারা। যে জবাবটা তারা দিতো তা ছিল সহজেই অনুমেয়: তাদের পছন্দটা ভাগ হয়ে যেতো অ্যাথলেট (যেমন, মোহাম্মদ আলী, মাইকেল জর্ডান), রকগায়ক (যেমন, ব্রুস স্প্রিংস্টিন, মাইকেল জ্যাকসন) ও চলচ্চিত্রের তারকাদের মধ্যে; কালেভদ্রে আরো কিছু প্রয়াত ও জীবিত জননন্দিত মানুষদের কথাও তারা বলতো (যেমন, মার্টিন লুথার কিং, গান্ধী ও যিশু খ্রিস্ট)।
 
নায়ক যারা বাস্তবকে ছাপিয়ে ওঠা মহান তারা; তাদের থাকে এমনসব গুণাবলি যা সাধারণ ছাপোষা মরণশীল মানুষ কেবল কল্পনাই করতে পারে। তাদের কাজকারবার সবই দুনিয়াসেরা; তাৎক্ষণিকের ক্ষুদ্র গণ্ডি ছাড়িয়ে চিরকালের বরমাল্যভূষিত তারা।

আজকের দিনে এসে নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে বীরত্বের ধারণার সেই গৎবাঁধা চালচিত্র।   ক্লাসের অর্ধেক ছাত্র এখনো অবশ্য তাদের স্বপ্নের নায়কদের তালিকায় অ্যাথলেট(যেমন, লি ব্রন জেমস, স্টিফেন কারি), রকস্টার (ক্যানি ওয়েস্ট, জাস্টিন বিবার) ও মুভিস্টারদের(যে কোনো সুপারহিরো) নামই বলে থাকে। আর ভাসাভাসা ধারণা থেকে আরো কিছু জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের নামও তারা বলে (সচরাচর বলে প্রেসিডেন্ট ওবামার নামটি)। কিন্তু রাজনৈতিক ঔদাসিন্যময় হালফিল দুনিয়ায় বাড়বাড়ন্ত সংবাদমাধ্যমগুলো পাদপ্রদীপের আলোয় আসা যে কোনো খ্যাতিমানের জীবনের ময়লা খুঁজে বের করবার জন্য যেখানে হন্যে হয়ে ছোটে, সেখানে এসব ছাপিয়ে আজকের দিনে সবচেয়ে কমন পছন্দটা এখন ‘‘আমার বাবা’’ এবং ‘‘আমার মামণি’’—তে এসে ঠেকেছে। সেলিব্রেটিরা বহুদূরের মানুষ; আর পাপারাৎসিদের (paparazzi) ক্যামেরার মুহূর্মুহু ঝলসানিতে সেলিব্রেটিদের অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি জনসমক্ষে ফাঁস হয়ে পড়ে। কিন্তু পিতামাতাদের বেলায় তেমনটি হয় না: সন্তানদের জন্য তারা মাথার ঘাম পাযে ফেলেন, আবেগঘন মুহূর্তে যুৎসই পরামর্শটি দেন, সঠিক পথটি বাতলে দেন, আদরে কাছে টানেন এমনকি হয়ে ওঠেন বন্ধু।

সাম্প্রতিককালে পরিচালিত বিভিন্ন জরিপ সেকথাই বলছে। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের অর্ধেকের চোখে নায়ক হচ্ছে তাদের বাবা-মায়েরা। এখানেও অবশ্য লিঙ্গভিত্তিক ব্যবধানটা স্পষ্ট: বেশির ভাগ মেয়েরা বলেছে তাদের মায়েদের কথা আর ছেলেরা তাদের বাবাদের কথা।

মেয়েরা তাদের মায়েদের ‘হিরো’ হিসেবে যে গণ্য করে, তা কৌতূহলোদ্দীপক হলেও মোটেও অবাক করা ব্যাপার নয়। একালের তরুণীদের অনেকে বলেছে, প্রতিদিনই তারা তাদের মায়েদের কাছে সেলফোনে বার্তা পাঠায় অথবা কথা বলে; এমনকি কলেজে যাবার পরও। তারা তাদের জীবনের নানা বিষয় নিয়ে মায়েদের সঙ্গে কথা বলে, অকপটে নিজেদের আবেগ-অনভূতি প্রকাশ করে। মাকে তারা তাদের বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু বা সখী মনে করে।

আর ছেলেরাও পিছিয়ে নেই। আজকালকার ছেলেরা তাদের স্বপ্নের নায়ক হিসেবে যে কোনো সেলিব্রেটির চেয়ে তাদের বাবাদের কথাই বেশিবার বলে। ব্যাপারটা অবশ্য বেশ অবাক করার মতোই। কেননা মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা অনেক বেশি ‘বীরপূজারি’’। দীর্ঘদিন ধরে কয়েকটি জিনিস বালক-বয়সের থিম হয়ে আছে--—কোনো একজন স্বপ্নের নায়ক থাকা, রোলমডেল থাকা, স্বপ্নের রূপকল্প বা ভিশন থাকা ইত্যাদি ইত্যাদি...।

দশকের পর দশক ধরে অনেক বোদ্ধা সমালোচকের মুখে একটা সমালোচনা খুব চাউর ছিল। আর তা হচ্ছে বাবারা নিজেদের কাজকম্মো নিয়েই ব্যস্ত; ঘরের বা বাড়ির বিষয়ে মনোযোগ দেবার ফুরসত তাদের নেই। তারা একেকজন মূলত '‘গরহাজির জমিদার’’। .আর এ শতকের গোড়ায় সমালোচকের দল পিতৃত্ব ব্যাপারটিকে তো ‘‘রবিবাসরীয় প্রতিষ্ঠান’’ (“a Sunday institution.”) আখ্যা দিয়ে ফেলেছিলেন।

কিন্তু উল্টোই সত্য হয়ে উঠছে আজ। বাবারাই এখন ছেলেদের চোখে হয়ে উঠছে প্রিয় স্বপ্নের নায়ক। তারা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরের সেলিব্রেটিদের সঙ্গে নিজেদের বাবাদের চাক্ষুষ সক্রিয় ভূমিকা ও উপস্থিতির মধ্যে ফারাক করতে শিখেছে। সন্তানরা যে এখন সেলিব্রেটিদের হটিয়ে তাদের বাবাদেরকে  স্বপ্নের নায়ক হিসেবে দেখতে শুরু করেছে, তার কারণ কিন্তু সমাজে সেলিব্রেটিদের আকাল পড়েছে এমন নয়; বরং আজকালকার বাবারা সন্তান, পরিবার ও আপনজনদের জন্য অনেক বেশি সময় দিচ্ছেন ও অনেক বেশি শক্তি ব্যয় করছেন বলে।

এই যে বিরাট পরিবর্তনটা ঘটে গেছে তার পেছনের কারণটা মূলত আজকাল নারী-পুরুষেরা তাদের কাজকম্মো বা চাকরি-বাকরি ও পরিবার দুটোকেই সময় দিচ্ছেন; পরিবার ও বাইরের কাজ—এ দুটোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করছেন। সর্বোপরি তারা হয়ে উঠছেন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিষ্ঠাবান পিতামাতা। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ সেকথাই বলছে।

ধরুন ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা প্রকৌশলী উইল পেম্বল –এর কথা। পুত্রের রোলারকোস্টার প্রীতির ব্যাপারটিকে তিনি নিয়ে গেছেন এক অভিনব উচ্চতায়---বাড়ির পেছনের আঙ্গিনায় ওর জন্য নির্মাণ করেছেন আস্ত একটা রোলারকোস্টার।

ধরুন রক্কো ফোরজিওনে ও কোরি মার্টিনের কথা। এই দুই নরনারী তাদের সদ্যোজাত সন্তানের মঙ্গলচিন্তায় নিজেদের জীবনকে বলতে গেলে শেকড়ছাড়া করে ফেলেছেন। পরিবারে শুভানুধ্যায়ী বন্ধুবান্ধব ও আপনজনদের কাছাকাছি থাকবার জন্যই তাদের এই ত্যাগ।

অথবা ধরুন মিগেল আভিলার কথা। ভদ্রলোকের মেয়ে গোঁ ধরেছিল ১৫ বছরে পা রাখবার দিনে সে তার বাবার সঙ্গে ‘হিপহপ’ নাচবে। মেয়ের আশা পূরণের জন্য বেচারা মিগেল সংখ্যাহীন দিন-ঘণ্টা ব্যয় করেছেন সেই হিপহপ  নাচের তালিম নিতে।

অনেক নতুন বাবা আজকাল প্রতিদিনই তাদের বীরত্বের প্রকাশ ঘটান। আসলে বীরত্ব –টীরত্ব কিছু নয়। এটা দৈনন্দিন জীবনেরই অংশ। আজকাল পিতারা তাদের বীরত্বের প্রকাশটা ঘটান বাচ্চাদের অনেক অনেক বেশি যত্নআত্তি ও দেখভাল করার মধ্য দিয়ে। এর আগে ইতিহাসে আর কখনোই এমনটা দেখা যায়নি। আজকাল অনেক নতুন বাবা আবার বাচ্চার নেংটি (ডায়াপার) বদলানোর কাজে রীতিমতো ওস্তাদ!

আর এর চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, অধুনাকালের পুরুষের সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গিটা আমূল পাল্টে গেছে। মানে বাচ্চার দেখভাল লালনপালন করলে ‘পুরুষত্বে’ হানি ঘটবে এহেন সনাতনী ধারণাটি একালে আর হালে পানি পাচ্ছে না।

সাম্প্রতিক DoveMen+Care-পরিচালিত এক গবেষণা-জরিপে আমি ছিলাম উপদেষ্টা। ওই জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন আমেরিকান পুরুষের ৭ জনই মনে করে যে, নিজের নয় বরং অন্যের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া/অন্যের প্রয়োজনটাকে বড় করে দেখাটাই হচ্ছে আসল বীরত্ব। দৃষ্টিভঙ্গির এই আমূল পরিবর্তনটা খুবই তাৎপর্যময় ঘটনা। অথচ এর আগে দশকের পর দশক ধরে সমাজবিজ্ঞানীরা পুরুষালিত্ব বা পৌরুষ সম্বন্ধে পুরুষের মুখের কথা ও তাদের কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করে এসেছিলেন। পুরুষের বেলায় গতানুগতিক ধারণাটা ছিল, পুরুষমাত্রই হবে নিরাবেগ, কর্তব্যসচেতন ও কঠিন মনের প্রাণিবিশেষ যারা কখনো কাঁদে না, যারা কোনো মূল্যে জয় ছিনিয়ে আনে। এহেন ধারণা পোষণ করেও আজকাল পুরুষরা নিজেদের পরিবারকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় দিচ্ছে।

পুরুষের কথা ও কাজের ফারাকটা এখন কমে আসতে শুরু করেছে—কেননা পুরুষত্ব সম্পর্কে পুরুষ তার আগের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে আসতে শুরু করেছে। অর্থাৎ (পরিবার ও সন্তানের প্রতি) তথাকথিত পুরুষালি ঔদাসিন্যের ধারণা বাতিল করে পরিবারের দেখভাল করার, সন্তান লালনপালন করার এবং সন্তানের সঙ্গে আবেগ-অনভূতি শেয়ার করা হয়ে উঠেছ নবযুগের রীতি।

অবশ্য এও ঠিক যে, অন্যদের জন্য কিছু করতে পারাটাকেই  দীর্ঘদিন ধরে অ্যামেরিকান ম্যাসকুলাইনিটির এক বিমূর্ত গুণ বলে ভাবা হতো। ভাবুন সেইসব যুদ্ধের চলচ্চিত্রগুলোতে দেখানো নায়কের ব্যক্তিগত ত্যাগের কথা, ভাবুন একাকী সেই পশ্চিমা পুরুষটির(heroic Western loner) কথা, যে কিনা বদলোকদের কবল থেকে আস্ত একটা শহরকে রক্ষা করার পর ঘোড়ার পিঠে আসীন হয়ে সূর্যাস্তের আলো-আঁধারির ভেতর হারিয়ে যায়। আজকালকার বাবারা তেমন বিমূর্ত নায়ক নন। বরং তাদের ভালোবাসা ও ত্যাগটা অনেক বাস্তবিক আর মূর্ত। জগতের আর সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আজকের পশ্চিমা নায়কেরা সূর্যাস্তের পথে ছুটে চলেন;  কেননা তাকে ঘরে ফিরে রান্নাবান্নায় সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে, থালাবাসন ধুতে হবে আর বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে হবে।

এখন এটাই হচ্ছে নিত্যদিনের বীরত্বগাথা!

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।