ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রয়োজন চিকিৎসকদের ম্যাজিস্ট্রেসি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১৬
প্রয়োজন চিকিৎসকদের ম্যাজিস্ট্রেসি

ঢাকা: স্বাস্থ্যখাতে প্রকৃত পরিবর্তন ও সংস্কার অন্য গোত্রের মানুষ দিয়ে কোন ক্রমেই সম্ভব না। 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে' কিন্তু এক রমণী অন্য রমণীর সংসারে সুখ বয়ে আনতে পারেন কতোটুকু?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন দিন বদলের সনদ নিয়ে উন্নয়নের রোডম্যাপ ঘোষণা করলেন তখন তিনি তরুণ নেতৃত্বের উপর অনেকখানি আস্থা রেখেছিলেন।

বিসিএস দিয়ে একজন নবীন চিকিৎসক যখন ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা দিতে যান, তখন প্রচলিত সিস্টেম তাকে সিস্টেমে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে। ইচ্ছা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যখাতের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা সম্ভব হয় না এই বিসিএস কর্মকর্তার।

অথচ প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে তার একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা সহকারী সচিব এর সমান ক্ষমতা ও দায়িত্বপ্রাপ্তির কথা ছিলো। কিন্তু শুধু আউটডোরে বসে প্যারাসিটামল, মেট্রো আর গ্যাসের বড়ি লিখেই একজন নবীন সরকারি কর্মকর্তার মেধা, মনন ও শ্রমের অপচয় করা হয়। এটাই সিস্টেম। অথচ দেশকে দেবার ছিলো তার অনেক কিছুই।

একটু পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন।

আমাদের অনেকেরই জানা যে উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়ে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য অনিরাপদে পড়ে থাকে কোয়াক এবং ফার্মেসির দোকানদারদের হাতে। অ্যান্টিবায়োটিক, দামী স্যালাইন, ব্যাথা নাশক, স্টেরয়েড এর যথেচ্ছ ব্যবহার, যেনতেন করে সেলাই, দুঃসাহসিক শল্যচিকিৎসা ইত্যাদি করে গ্রামের মানুষের ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকির অবস্থা তৈরি হয়েছে বহু বছর ধরে। এসব নিয়ে অনেকেই অনেক বিস্তারিত লিখেছেন, বলেছেন। অথচ এর প্রতিকার বিধান হয়নি। এদের অপচিকিৎসার কি কখনো বিচার হয়েছে? কখনোই না।

আবার একজন গরীব অসুস্থ মানুষ উপজেলা হাসপাতালে, ইউনিয়ন সাবসেন্টারে বা কমিউনিটি ক্লিনিকে গেলেন সেবা নিতে। কিন্তু তিনি প্রত্যাশিত সেবা পেলেন না। হয় তার সাথে স্বাস্থ্যকর্মী বা সেবিকারা দুর্ব্যবহার করলেন, কিংবা যেকোন সেবার জন্য তার কাছ থেকে প্রয়োজনের বেশি মূল্য নেওয়া হলো, অথবা অ্যাম্বুলেন্স এর চালক রোগী নিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানালো - অব্যবস্থাপনা যেটাই হোক না কেন ভুক্তভোগী কিন্তু কোন বিচার পান না।

চিকিৎসকেরা এ সময় অসহায় অনুভব করেন। কারণ তিনি একজন সাধারণ ক্ষমতাহীন মেডিকেল অফিসার। কেউ তার আদেশ না শুনলে বিধিমালা যাই বলুক প্র্যাকটিকালি তার কিছুই করার নেই। কারণ কর্মচারীরা তাদের কাজের জন্য ব্যবহারিক অর্থে কেবল একজন ইউএইচএফপিও কিংবা সিভিল সার্জনের কাছে দায়বদ্ধ। আর এই পদের আসীন আমাদের স্যাররা এতো দায়িত্বে জর্জরিত থাকেন যে এসব বিচার-জবাবদিহিতার লোড তারা নিতে চান না। আর একজন কর্মচারীর এসিআর (বাৎসরিক গোপনীয় প্রতিবেদন) এ স্বাক্ষর করেন তারাই।

কর্মচারীরা চিকিৎসকদের খুব একটা তোয়াক্কা করার কথা মনে করেন না। তাই কোন কর্মচারীর অন্যায়কে সহ্য করে নেওয়া ছাড়া একজন সরকারি চিকিৎসক এর আর কিছুই করার থাকে না।

দিন শেষে যা হয় তা হলো নবীন একজন চিকিৎসক যিনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন, নিজেই ট্রাডিশনের পুতুলে পরিণত হন। এক সময় তিনি উপজেলা লেভেল ছেড়ে পোস্টগ্রাজুয়েশন বা অন্যান্য কারণে জেলা পর্যায়ে বদলি হন। ফলে অপচিকিৎসা আর অব্যবস্থাপনার আকর হয়ে পড়ে থাকে উপজেলা/ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যখাত। বছরের পর বছরে ধরে এভাবেই চলে এসেছে। এই অন্ধকার কাটেনি আজো।

অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চাইলে উপজেলা পর্যায়ে একজন চিকিৎসককে আর "নিধিরাম সর্দার' করে রাখা চলবে না।

"মেডিকেল অফিসার" পদবীর পরিবর্তে উপজেলা পর্যায়ে একজন সরকারী চিকিৎসকের পদের নাম করতে হবে "উপজেলা চিকিৎসা কর্মকর্তা ও নির্বাহী স্বাস্থ্য ম্যাজিস্ট্রেট"
(Upazila Medical Officer and Executive Health Magistrate।

কেবল চিকিৎসা প্রদান করার জন্য সরকার একজন চিকিৎসককে উপজেলা পর্যায়ে পাঠাননি। চিকিৎসা প্রদানের সাথে সাথে জনগণের স্বাস্থ্যখাতের সাথে জড়িত প্রতিটি বিষয়ে তিনি তদারকি করার ক্ষমতা রাখবেন। চিকিৎসার সাথে জড়িত ধাপগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিকারে তিনি প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে ও দণ্ড দিতে পারবেন। তাকে ইউএইচএফপিও কিংবা সিভিল সার্জনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। এই ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রতিবিধানে সরাসরি ইউএনও মহোদয় ও স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের ওসি তাকে সহযোগিতা করবেন।

দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়, কিছু কিছু পরীক্ষার হলে পরিদর্শককেও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়। অথচ চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের মতো এতো সংবেদনশীল একটি সেক্টর আমরা প্রায় সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে চলেছি।

১৮৯৭ সালে প্রণীত 'GENERAL CLAUSES ACT 1897' অনুযায়ী ফৌজদারি আইন সম্পর্কে জানা ও তার প্রয়োগের ক্ষমতাই ম্যাজিস্ট্রেসি। এই দায়িত্ব মেডিকেল সায়েন্সে অভিজ্ঞ একজন সরকারি চিকিৎসকের হাতে পৌঁছালেই তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যখাতের পরিবর্তন আনা সম্ভব। কোন চিকিৎসক যদি কোন কারণে এই অর্পিত দায়িত্ব নিতে না চান তবে তিনি তা সারেন্ডার করতে পারবেন। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে একাধিক নির্বাহী স্বাস্থ্য ম্যাজিস্ট্রেট থাকতে হবে।

আমার ঘরের কোথায় ডিফেক্ট আমিই ভালো জানবো। বাইরের মানুষ বা অন্য ঘরের মানুষ এসে আমার ঘরের সমস্যা ঠিক করে দিয়ে যেতে পারবে না। ইচ্ছাশক্তি ও বিচক্ষণতা দিয়ে উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লব ঘটাতে পারেন তরুণ চিকিৎসক কর্মকর্তারা। আসুন এই বৃহৎ ক্যাডারের ঐক্য ও প্রতিভাকে দেশের কাজে নিয়োজিত করার প্রয়াস নিই।

জয়তু বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ।

চিকিৎসক পরিচিতি: ডা. রাজীব দে সরকার
                                পোস্টগ্রাজুয়েশন (পেডিয়েট্রিক সার্জারী) অধ্যয়নরত
                                সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ,
                                বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকা।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১৬
আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।