বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম’। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তার এ অনুভূতি সত্যিকার অর্থেই দলটি সম্পর্কে এক কথায় সর্বোৎকৃষ্ট বিশেষণ ও বিশ্লেষণ।
এটি দল নিয়ে তার হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত অনুভূতিরও বহির্প্রকাশ।
মওলানা ভাসানী থেকে শেখ হাসিনা, শামসুল হক থেকে ওবায়দুল কাদের- প্রতিষ্ঠা থেকে ২০তম জাতীয় সম্মেলন, ১৯৪৯ থেকে ২০১৬ সাল- দীর্ঘ ৬৭ বছরের লড়াই, সংগ্রাম ও অনুভূতির নাম আওয়ামী লীগ।
শেখ মুজিব। বয়স তখন মাত্র ২৯ বছর। তখনও তিনি শুধুই মুজিব বা বড়জোড় শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু বা জাতির জনক হয়ে ওঠার গল্পটা হয়তো তখন ভেতরে ভেতরে শুরু হয়ে গেছে, হয়তো সেটা জানতেনও না শেখ মুজিব। জানতো শুধু অন্তর্যামী। কিন্তু লড়াইটা যে দীর্ঘ, পথটা যে বন্ধুর তা তিনি ঠিকই অনুধাবন করেছিলেন। কারণ, মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে এসে ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ যে কঠিন, তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। জ্যেষ্ঠ নেতারা তাই তেজোদীপ্ত তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানকেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন।
কিন্তু রাতারাতি সব কিছু হয় না। রাজনীতি বা নেতা তো নয়ই। হালে অনেকেই নেতা হতে পারেন। তাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামেই যাত্রা শুরু আজকের আওয়ামী লীগের। কারণ, আগে চাই জনগণের মাঝে চেতনার জাগরণ, তারপর সে অনুসারে রাজনীতির পাল। নামে হলেও অসাম্প্রদায়িক হতে আওয়ামী লীগ আরো সাত বছর সময় নেয়। ১৯৫৭ সালের তৃতীয় সম্মেলনে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই এ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। সে কারণে আজকের অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয় সোহরাওয়ার্দীকে।
শেখ মুজিব সেই চেতনারই উত্তরাধিকার। আমরা তার উত্তর প্রজন্ম। ১৯৫৩ সালের দ্বিতীয় সম্মেলনেই শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদকের হাল ধরেন।
এক সময় তারুণ্য ও যৌবনের কাছেই ছিল রাজনীতির মূল চাবিকাঠি। পাকিস্তান আন্দোলন- সেও তো তারুণ্যেরই অবদান। যদিও স্বপ্নভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। কিন্তু এর মাঝেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক দশক পার হওয়ার আগেই বাঙালির কাণ্ডারি আওয়ামী লীগের দায়িত্ব ফের এক তরুণের হাতে অর্পণ করার মতো সৎসাহস দেখিয়েছিল সেদিনকার আওয়ামী লীগ।
কিন্তু আজ তরুণদের ওপর কেবল আওয়ামী লীগ নয়, কোনো দলের ভরসা নেই বলে মনে হয়। কিন্তু সেদিনের সেই তরুণ মুজিবই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, সত্তরের নির্বাচনের পথ পেরিয়ে পরিণত বয়সে এসে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন একটি জাতিকে।
কিন্তু পাকিস্তানে বাঙালির অধিকারের রাজনীতি ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ে। সেই ধারাবাহিকতাতেই ১৯৫৮ সালে পুরো পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়। স্থগিত করা হয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি। অন্তত ছয়-সাত বছর সীমিত রাজনীতি করেই কাটাতে হয় আওয়ামী লীগকে।
স্বাধীনতার আগের আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে অন্তত দু’টি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্বটি -১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৬৬ সাল থেকে। প্রথম পর্বটি স্বাধিকার আন্দোলনের ও পরের পর্বটি মূলত স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকেই ধাবিত হয়েছে।
১৯৬৬ সালে প্রথমবারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হয়েই বঙ্গবন্ধু বাঙালির প্রথম মুক্তির সনদ ছয় দফা পেশ করেন, পাকিস্তান যাকে প্রকারান্তরে স্বাধীনতার সনদ বলেই অভিহিত করতো। এরপর আরো কতো আন্দোলন-সংগ্রাম।
তাই নি:সন্দেহে আওয়ামী লীগ একটি অনূভূতির নাম, যার সঙ্গে মিশে আছে একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির ইতিহাস। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্ষমতার বাইরেই বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছে (৬৭ বছরের মধ্যে ১৮ বছরে মতো ক্ষমতায়)। পাঁচ দশকই ক্ষমতার বাইরে তার অবস্থান।
তাতে আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রামের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়নি। একটি গণতান্ত্রিক দল ক্ষমতার বাইরে গিয়েও জনগণের জন্য কাজ করতে পারে। তেমনি দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে না থেকেও দলের জন্য কাজ করা যায়। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাতে দলের কোনো ক্ষতি হয়নি। সভাপতি হয়েছিলেন এএইচএম কামারুজ্জামান। জিল্লুর রহমান ১৯৭২ ও ১৯৭৪ সালে সাধারণ সম্পাদকের হাল ধরেন। এমনকি ১/১১’র কঠিন সময়েও জিল্লুর রহমানই দলকে ঐক্যের পথ দেখান।
আওয়ামী লীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কমিটি হচ্ছে ১৯৬৬ সালের কমিটি যা ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালেও বহাল থাকে। গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, ওই কমিটির কার্যকালই মুক্তিযুদ্ধকাল। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমেদের নামও অপরিহার্যভাবেই লিখিত থাকবে। তেমনি জিল্লুর রহমানও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কঠিন সময় পার করেছেন (১৯৭২, ১৯৭৪, ১৯৯২, ১৯৯৭ ও ২০০০ সাল)। জোহরা তাজউদ্দিন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, মহিউদ্দিন আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাকসহ আরো অনেক নেতার নাম চলে আসে এ তালিকায়। তারা সবাই কঠিন সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন।
দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ দলের নির্বাহী ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে এ পদ আরো গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের এই পুনর্পাঠ এ কারণেই যে, দু:সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন দলের সাধারণ সম্পাদকরাই। স্বাধীনতা আন্দোলনে তাজউদ্দিন, স্বাধীনতার পর সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, জোহরা তাজউদ্দিন, জিল্লুর রহমানদের পথ বেয়ে আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
২০তম সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন ওবায়দুল কাদের। তার জন্য শুভ কামনা। কিন্তু পথটা যে বড়ই কঠিন। তাই কঠিনেরে ভালোবেসেই পথ চলতে হবে।
আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। সুসময়ের সাধারণ সম্পাদক হওয়াই শেষ কথা নয়। একটি অনুভূতিকে নতুন প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত করার কাজটি যে এখন তাকেই করতে হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যার বিবেচনাকেও স্বাগত জানাই। ওবায়দুল কাদের নতুন ও পুরনোদের সেতু রচনা করতে পারবেন এমনটাই ধারণা। প্রগতিশীল ও আধুনিক চেতনায় সমৃদ্ধ নেতাই পারেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মাঝে সেতু রচনা করতে। ওবায়দুল কাদেরের জন্য শুভ কামনা।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৬
আরএম/এএসআর