ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ম্যাজিক বুলেট, ফোর্থ স্টেট শব্দগুলো নিয়ে ভাবতে হবে!

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৬
ম্যাজিক বুলেট, ফোর্থ স্টেট শব্দগুলো নিয়ে ভাবতে হবে!

সাংবাদিকতার তত্ত্বে ‘ম্যাজিক বুলেট’, ‘ফোর্থ স্টেট’ শব্দগুলো নিয়ে এবার ভাবতে হবে! মিডিয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত এ দু’টি শব্দ বা তত্ত্ব আজ নিঃসন্দেহ প্রশ্নবিদ্ধ।

সাংবাদিকতার তত্ত্বে ‘ম্যাজিক বুলেট’, ‘ফোর্থ স্টেট’ শব্দগুলো নিয়ে এবার ভাবতে হবে! মিডিয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত এ দু’টি শব্দ বা তত্ত্ব আজ নিঃসন্দেহ প্রশ্নবিদ্ধ।

ম্যাজিক বুলেট তত্ত্বটিতে বলা হয়, ‘মিডিয়ার এমন একটি ক্ষমতা রয়েছে যা সমাজে ম্যাজিক বুলেটের মতো কাজ করে।

মিডিয়া যা বলবে, সমাজ, সমাজের মানুষ সেভাবেই কাজ করবে’।

এখানে দু’টি শব্দ- একটি 'ম্যাজিক', অন্যটি 'বুলেট'।   দু’টি শব্দই কিন্তু নিজ ক্ষমতা ও কার্যকারিতায় শক্তিশালী। যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় যেমন পাল্টে যায় কোনো কিছু, ঠিক তেমনটি ঘটলে আমরা বলি... ‘বাহ যাদুর মতো কাজ করেছে’। আর বুলেট যেমন ছুটে এসে দ্রুত আঘাত করে, তেমন কিছু ঘটলে আমরা বলি, ‘বাহ! বুলেটের মতো কাজ হয়েছে’।

আর এই ম্যাজিক বুলেট তত্ত্বের যারা আবিষ্কারক, তারা মিডিয়ার ক্ষমতাকে এমনভাবে দেখেছেন যে, তার প্রকাশে এ দু’টি শক্তিশালী শব্দকে একসঙ্গে ব্যবহার করছেন। তারা বলেছেন, ‘মিডিয়া’ নামের ‘বন্দুক’ থেকে যখন গুলি বের হয়, তখন তা সরাসরি দর্শক, পাঠক শ্রোতার 'মস্তিষ্কে' আঘাত করে।

এটিকে ‘হাইপোডারমিক নিডল’ মডেলও বলেছেন তারা। অর্থাৎ বলা হয়, ‘মিডিয়ার কোনো বার্তা তার দর্শকের মস্তিষ্কে সরাসরি ইনজেক্ট করে দেয়। তখন মিডিয়া যেভাবে চায়, পাঠক-দর্শক সেভাবেই আচরণ করে’।

কিন্তু মিডিয়ার সে ক্ষমতা আজ লোপ পেয়েছে। ১৯৩০-এর দশকে নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব টোয়েন্টের দেওয়া এ আচরণতত্ত্বটি মূলত প্রণীত হয় নাৎসি প্রোপাগান্ডায় হলিউডের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে, যা আজ আর চলে না। সুতরাং, মিডিয়ার প্রভাব নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিডিয়ার ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ বললে ভুল হবে, বস্তুতপক্ষে ভুলুণ্ঠিত হয়েছে। একটি কথা অন্তত বলাই চলে- এখানে মিডিয়ার ম্যাজিক বুলেট তত্ত্ব কাজ করেনি।

আরেকটি শব্দ ‘ফোর্থ স্টেট’। বলা হয়, ‘সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ (অথবা চতূর্থ শক্তি) এই মিডিয়া। সমাজ বা রাজনীতির যে শক্তিটির কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা হয় না, কিন্তু তা রয়েই যায় তাকেই এ চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মিডিয়া রাষ্ট্রের কাঠামোর অবধারিত কোনো অংশ নয়। সে কারণেই একে চতুর্থ শক্তি নাম দিয়ে তার অস্তিত্ব ও শক্তিকে স্বীকার করে নেওয়া হয়।  

এ শব্দটির ইতিহাস আরও পুরনো। ১৭৮৭ সালে গ্রেট ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে সংসদীয় বিতর্কে এডমুন্ড ব্রুক প্রথমে শব্দটির ব্যবহার করেছিলেন। তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজের তিনটি প্রধান স্তম্ভ ছিলো অভিজাত শ্রেণি (ফার্স্ট স্টেট), ধর্মযাজক শ্রেণি (সেকেন্ড স্টেট) ও সাধারণ মানুষ (থার্ড স্টেট)। টমাস কার্লাইল তার ‘বুক অন হিরোস অ্যান্ড হিরো ওরশিপ' বইয়ে লিখেছেন- ব্রুক সেদিন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘এই সংসদে আজ তিনটি স্তম্ভের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। কিন্তু ওই যে গ্যালারিতে বসে আছেন সাংবাদিকরা, তারা এই সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ। তারা কিন্তু এদের সকলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ’।    

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর মিডিয়ার জন্য এই ফোর্থ স্টেট তকমাটি কি প্রশ্নবিদ্ধ হয় নি?

হয়েছে। কারণ, মিডিয়াকে, মিডিয়ার ক্ষমতাকে, মিডিয়ার বক্তব্য, মিডিয়ার প্রচেষ্টাকে আর মিডিয়ার সকল অনুমানকে মিথ্যা প্রমাণিত করে, পুরোপুরি ভুলুণ্ঠিত করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।

মিডিয়া কতো কথা বলেছে, ট্রাম্প অযোগ্য, নোংরা মানসিকতার, ট্যাক্স ফাঁকিবাজ, জালিয়াত, অর্থ-দুর্বৃত্ত, নারীবিদ্বেষী, বর্ণবাদী, বিকৃত যৌনাচারী। এসবের কোনোটাই ম্যাজিক বুলেটের মতো, হাইপোডারমিক নিডলের মতো দর্শক-পাঠকের মস্তিষ্কে আঘাতও হানেনি, ঢুকেও পড়েনি। ফলে তারা ট্রাম্পকেই পছন্দ করেছেন।

এ নির্বাচনে মিডিয়া ফোর্থ স্টেট হিসেবেও বিবেচিত হয়নি। বরং ব্যবহৃত হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে। কারণ, এডমুন্ড ব্রুক যে ফোর্থ স্টেটের কথা বলেছিলেন, তা ছিলো মিডিয়ার বিবেক- তার কলমের শক্তিকে বিবেচনা করে, মিডিয়ায় প্রকাশিত বা প্রচারিত বিজ্ঞাপনের বিবেচনায় নয়।

যুক্তরাষ্ট্র তথা গোটা বিশ্বের প্রায় সকল মিডিয়াই এ নির্বাচনে ট্রাম্পের জয় দেখতে পায়নি। যে কয়েকটি মিডিয়া দেখতে পেয়েছে, তারাও তা দেখেছে একটি পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। উপরিতল থেকে তারা স্রেফ ভাষার ব্যবহার ও বানোয়াট পরিসংখ্যানে ট্রাম্পকে এগিয়ে রেখেছিলো। তাদের ছিলো না সত্যিকারের পরিস্থিতির ওপর কোনো নজরদারি, কিংবা গভীরের কোনো বিশ্লেষণ।

আর যারা ট্রাম্পকে পিছিয়ে রেখেছিলেন, তারাও ছিলেন পক্ষপাতদুষ্ট। ভেতরের খবর তাদের যে অজানা ছিলো কিংবা জানার চেষ্টাটুকুও ছিলো না, তা নিয়ে ০৮ নভেম্বর (মঙ্গলবার) দিবাগত মধ্যরাতের পর থেকে আর কেউই সন্দেহটুকুও করছেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী মিডিয়া ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের জয়ের সম্ভাবনা দেখেছিলো ৯৮.৫ শতাংশ। আর ট্রাম্পের মাত্র দেড় শতাংশ। অন্য প্রধান মিডিয়াগুলোর কোনোটিই (রিপাবলিকান সমর্থক মিডিয়াগুলো ছাড়া) হিলারির জয়ের সম্ভাবনা ৮০ শতাংশের নিচে দেখেনি।

কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে, তা এখন সবার জানা।

যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়াগুলো যেভাবে প্রেডিক্ট করেছে, সারা বিশ্বের মিডিয়াগুলো সেটাই অনুসরণ করে গেছে। কেউই গভীরে যায়নি। ফলে সার্বিকভাবে আজ মিডিয়ার যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এতো মিডিয়ার এতো এতো চোখ, কেউ কি দেখতে পায়নি, আমেরিকানরা ভেতরে ভেতরে কতোটা রক্ষণশীল, কতোটা নারী বিদ্বেষী, কতোটা তারা ইসলামোফোবিয়ায় ভুগছে?

মিডিয়াগুলো স্রেফ ট্রাম্পকে নিয়ে পড়েছিলো। তারা এ খবর রাখেনি যে, যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৫ কোটি ৯৬ লাখ ১১ হাজার ৬৭৮ জন নাগরিক রয়েছেন যারা প্রত্যেকেই একেকজন ডোনাল্ড ট্রাম্প মনোভাবাপন্ন।

এই মিডিয়াকে ফোর্থ স্টেট বললে এডমুন্ড ব্রুকের আত্মা কষ্ট পাবে। এই মিডিয়াকে ‘মিডিয়া গান’ বলা হলে ইউনিভার্সিটি অব টোয়েন্ট তা মানবে না।

সুতরাং, ম্যাজিক বুলেট, ফোর্থ স্টেট শব্দগুলো নিয়ে ভাবতে হবে!

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৬
এমএমকে/এএসআর

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।