আদিকাল থেকেই মানুষ স্থানান্তরগমন করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। মানব সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাসে একটা সময় যখন হান্টিং অ্যান্ড গ্যাদারিং সোসাইটি ছিলো, তখন মানুষ খাদ্যান্নেষণে, নিরাপত্তার অভাবে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে স্থানান্তরগমন করতো।
অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালিরা স্থানান্তরাগমন করছে কেন? আমরা নিশ্চয়ই উপরোক্ত কারণগুলির এক বা একাধিক কারণ এখানে খুঁজে পাবো। তারপরেও অস্ট্রেলিয়ায় উল্লেখযোগ্য হারে বাঙালিদের স্থানান্তরাগমনের ইতিহাস খুব দীর্ঘদিনের নয়। সর্বসাকুল্যে, অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালিদের সংখ্যা ৮০-৯০ হাজার;তাদের মধ্যে নাগরিক কিংবা স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা ৬৫ হাজারের বেশি নয়।
আমরা যে সমাজে বসবাস করি, যে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছি, যে দেশে খাজনা দেই, যে দেশের ভালো-মন্দ আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে, সেই দেশটি কীভাবে চলে? কে বা কারা চালায়? কীভাবে আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি প্রণীত হয়? সেই দেশে কীভাবে, কার কাছে সমস্যাগুলো উত্থাপন করতে হয়? কীভাবে সমাধান করতে হয়? এরকম হাজারো প্রশ্ন আছে, আমরা কি সব প্রশ্নের উত্তর জানি? না, আমি অন্তত জানি না। কিন্তু আমাদের মধ্যে অবশ্যই কেউ না কেউ আছেন, যিনি বা যারা অনেক কিছুই জানেন। কারণ তারা অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছেন।
আমরা জানি, অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক কাঠামো মূলত তিনস্তর বিশিষ্ট। (১) স্থানীয় সরকার (সিটি কাউন্সিল) (২) প্রাদেশিক সরকার (স্টেট গভর্নমেন্ট) এবং (৩) কেন্দ্রীয় সরকার (ফেডারেল গভর্নমেন্ট)। ৬০-৬৫ হাজার বাঙালিদের মধ্যে শতকরা কত ভাগ বাঙালি অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছেন? শুধু কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সাধারণ সদস্য পদ বিবেচনায় নিলেও শতকরা একভাগ বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা, সন্দেহ আছে। ৯৯ শতাংশের অধিক বাঙালি অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছেন না কেন? সমস্যা কোথায়? মনস্তাত্ত্বিক? শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাব? ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা? আত্মবিশ্বাসের অভাব? সাংগঠনিক যোগ্যতা? রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কিংবা জ্ঞানের অভাব? আত্মীকরণ? গণতান্ত্রিক রীতিনীতি? সুস্থ-ধারার রাজনীতি? রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন?
নাকি অভিবাসীদের প্রথম প্রজন্ম এমনই থাকে? দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রজন্ম মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। আমাদের অনেকের সন্তানই কিন্তু আন্ডার-গ্রাজুয়েশন, কেউ কেউ পোস্ট-গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। তাদেরকে কেন মূলধারার রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য হারে দেখতে পাচ্ছি না? পশ্চিমবঙ্গে যদি জ্যোতি বসু ২৫ বছরাধিককাল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, ইংল্যান্ডে যদি টিউলিপ পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হতে পারেন, নেদারল্যান্ডসে যদি একজন বাঙালি মেয়র নির্বাচিত হতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রে হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনে মাইগ্রেশন অ্যাডভাইজরি কমিটিতে যদি একজন বাঙালি মেয়ে তাহমিনা, প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করতে পারেন, তাহলে অস্ট্রেলিয়ায় আমরা কেন পারবো না?
অবশ্যই পারবো। ইতোমধ্যেই সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এখানেও কেউ কেউ এগিয়ে এসেছেন। বাঙালি কমিউনিটি ধীরে ধীরে অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতির মহাসড়কে উঠছেন। ফেডারেল পার্লামেন্টের নির্বাচনে মোহাম্মাদ জামান (টিটু) অংশ করে ২৭ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন। যা ছিলো এ যাবৎ কালের উক্ত সংসদীয় এলাকায় লিবারেল পার্টির কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ ভোট।
ড. তানভীর আহমেদ অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে নেতৃত্বের পাশাপাশি একজন বুদ্ধিজীবী-লেখক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কেউ কেউ স্টেট পার্লামেন্টের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ইতোমধ্যেই বাঙালি কমিউনিটির একাধিক সদস্য সিটি কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছেন। আমাদের জানামতে অনেকেই বিভিন্ন এলাকার লেবার এবং লিবারেল পার্টির গুরত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। ভবিষ্যতে আমরা তাদের আরও গুরত্বপূর্ণ পদে দেখতে পাবো। কিন্তু যা কিছু হচ্ছে তা কি যথেষ্ট? অবশ্যই যথেষ্ট নয়। নিঃসন্দেহে আমাদের আরও বেশি সম্পৃক্ততা, আরও বেশি অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
কেউ হয়তো বলতে পারেন, সবাইকেই কেন রাজনীতি করতে হবে? আমরা সবাইকে রাজনীতি করতে বলছি না; কিন্তু আমাদের সবাইকে রাজনীতি সচেতন হতে হবে। আমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। রাজনীতিই সব কিছুর চালিকা শক্তি। আপনি কিংবা আপনার কমিউনিটি যদি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ না হন, আপনাকে কিংবা আপনার কমিউনিটিকে কেউ গুরুত্ব দেবে না। বাঙালি জাতি যদি রাজনৈতিক সচেতন না হতো, তাহলে কোনোদিনই একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পেতো না। আমাদের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে। আমরা যত বেশি ডায়াস্পোরিক পলিটিক্স, তথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করি, তার দশ ভাগের একভাগও যদি অস্ট্রেলিয়ান রাজনীতির মূলধারায় অংশগ্রহণ করতাম, তাহলে এতদিনে আমাদের অর্জন আরও অনেক বেশি গৌরবময় হতে পারতো।
অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে এখনো বাঙালিদের যা কিছু সফলতা, তা শুধু স্থানীয় সরকার পর্যায়ে তথা সিটি কাউন্সিলে। স্টেট কিংবা ফেডারেলে আমরা এখনো কোনো সাফল্য পাইনি। অস্ট্রেলিয়াতে যদি বসনিয়ার একজন মানুষ পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হতে পারেন, একজন ইতালিয়ান যদি মন্ত্রী হতে পারেন, একজন চাইনিজ বংশোদ্ভূত মানুষ যদি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারেন, তাহলে আমরাও পারবো। আমাদের যদি কিছু সীমাবদ্ধতা থেকেও থাকে, তা কি সমাধানযোগ্য নয়? অবশ্যই সমাধানযোগ্য।
আমরা কী সবাই জানি অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে মারা যাচ্ছি মা...আমারে বাঁচাও দের জন্য সমস্যা এবং সম্ভাবনাগুলো কি কি? সিডনিতে বাঙালিদের প্রায় অর্ধশতাধিক কমিউনিটি অরগানাইজেশন আছে; আমাদের কমিউনিটি অরগানাইজেশনগুলো এক্ষেত্রে কি ধরনের ভূমিকা পালন করছে? কীভাবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা যেতে পারে? আমরা কি তা জানি? কথায় আছে, ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’। অস্ট্রেলিয়াতে এসেও বাঙালিদের স্বপ্নের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সন্তানদের চিরকালের লালিত স্বপ্ন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চায়। কেউ ভুলেও চিন্তা করে না, আমার ছেলে-মেয়ে একদিন অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দেবে; মন্ত্রী-এমপি হবে।
প্রশ্ন হতে পারে, এগুলো জেনে কি হবে? এতোবড় স্বপ্ন দেখে কী লাভ? অবশ্যই লাভ হবে। কয়েক বছর আগেও একজন গার্বো সিডনির প্রিমিয়ার (মুখ্যমন্ত্রী) ছিলেন (শহরের ময়লা যে পরিষ্কার করে তাকে গার্বো বলা হয়। গার্বেজ থেকে গার্বো)। সুতরাং, উদাসীন হওয়ার কিংবা হীনমন্যতায় ভোগার কিছু নেই। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাস্কির একটি উক্তি আছে, ‘উদাসীন ব্যক্তিই রাষ্ট্রের কুনাগরিক’। কুনাগরিকরা দেশের বোঝা, সমস্যা। উদাসীন নাগরিকদের বিষয়ে একটি দার্শনিক মতবাদের উল্লেখ করছি- ‘তোমার বন্ধুকে তুমি ভয় করো না, কারণ সে হয়তো তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে; তোমার শত্রুকেও ভয় করো না, কারণ সে হয়তো বড়জোর তোমাকে হত্যা করবে। কিন্তু তুমি সেই ব্যক্তিকে ভয় করো, যে ব্যক্তি নির্লিপ্ত এবং উদাসীন;এই নির্লিপ্ত এবং উদাসীন মানুষের কারণেই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অন্যায়-অপরাধ সংঘটিত হয়। এদের কারণেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজে-রাষ্ট্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৬২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৬
এএ