চট্টগ্রাম: সিএমপির তালিকাভুক্ত নয় মামলার পলাতক আসামি দিদার আলম। দীর্ঘদিন ধরেই তার নাগাল পাচ্ছিল না পুলিশ।
গ্রেফাতারের আশা যখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম তখন হঠাৎ এক সন্ধ্যায় থানায় এসে হাজির হলেন এক যুবক। তিনি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী দিদারের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের জানান। পরে সেই যুবকের দেওয়া তথ্য এবং এলাকাবাসীর সহযোগিতায় গ্রেফতারে সমর্থ হই প্রায় চার বছর ধরে পলাতক থাকা দিদারকে।
গ্রেফতারের পর সেই যুবকের কাছে জানতে চাইলাম, এতদিন আমরা একই এলাকায় অভিযান চালালাম, কিন্তু কেউ সহযোগিতা করলো না কেন? যুবকটি বলল, ‘স্যার, শুক্রবারে মসজিদে আপনার বক্তব্য শুনে সবাই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এলাকার অপরাধ নির্মূলে আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। ’ পরে বুঝতে পারলাম এই সাফল্যের নেপথ্য কথা।
দিদারকে গ্রেফতারে বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর একদিন জুমার নামাজের সময় হাজির হলাম শহীদ নগর জামে মসজিদে। ওইদিন মসজিদের ইমামের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে জুমার নামাজের আগে মুসল্লিদের উদ্দেশে মাদক, সন্ত্রাস, ইভটিজিং ও জঙ্গিবাদ নিয়ে কিছু কথা বলি। সেখানে পুলিশ আর জনগণের পারস্পরিক সর্ম্পক ও সহযোগিতার মাধ্যমে অনেক অপরাধ নির্মূল করার বিষয়টি তুলে ধরি।
তাদের কাছে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের গুরুত্বটি তুলে ধরে অপরাধ দমনে ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে পুলিশকে এলাকাবাসীর সহযোগিতার অনুরোধ করি। আর এই বক্তব্য এলাকাবাসী লুফে নেয়। কাজ করে টনিকের মতো। বুঝতে পারলাম, জনসম্পৃক্ততাই জনসেবার সাফল্য। জনসেবার জন্য জনগণকে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার অর্গানোগ্রাম বলছে আমার মোট জনবল ৭৬ জন। কিন্তু আমার থানার বর্তমান জনবল ১২ লাখ!
প্রিন্টিং মিস্টেক নয়, সত্যি।
আমার থানার লোকবল ১২ লাখ। আমার থানা এলাকার প্রতিটি মানুষই পুলিশের সদস্য। আর এটাই কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মূলমন্ত্র। তাই পুলিশের মহাপরিদর্শক জনাব এ কে এম শহীদুল হক মহোদয় ‘পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ’ স্লোগানকে সামনে রেখে যেদিন কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সূচনা করেছিলেন সেদিন থেকেই আমি ১২ লাখ পুলিশ সদস্যকে নিয়েই কাজ করি।
আরেকটি ঘটনা দিয়ে এটি পরিষ্কার করে দেওয়া যাক।
পেট্রোল সন্ত্রাস চলাকালীন সময়ে দায়িত্ব পালন করা খুবই দুরূহ হয়ে পড়ছিল। আমার বিশাল থানা এলাকার জন্য ১০০ জন জনবল বিশাল থালায় একটি তিলের মতো। কিভাবে এই অবস্থা সামাল দিব এটা নিয়ে যখন চরম দুশ্চিন্তায় তখনই আবারও সহায় হল এই কমিউনিটি পুলিশিং। পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় উঠান বৈঠক, সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি করি। এসব কমিটি গঠনের এক মাসের মাথায়ই পেট্রোল সন্ত্রাস শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।
আগেই বলেছি, প্রতিটি মানুষই এক একজন পুলিশ-এটাই কমিউনিটি পুলিশের মূলমন্ত্র। তাই প্রতিটি মানুষই নিজ দায়িত্ব মনে করে এসব সন্ত্রাস মোকাবিলা করেছে।
কমিউনিটি পুলিশিং হচ্ছে একটি ফলদায়ক বৃক্ষের মতো। এটি জনসাধারণের নাগরিক নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করছে। তেমনি পুলিশকেও সহযোগিতা করছে বহুমাত্রিকভাবে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থেই জনবল বেড়ে গেছে বহুগুণ। এলাকাভিত্তিক সচেতনতা সৃষ্টি হওয়ায় এলাকাভিত্তিক অপরাধ কমে আসছে। আবার অমীমাংসিত অনেক সমস্যার সমাধানও করে দিচ্ছে এই কমিউিনিটি পুলিশিং।
২০০০ সালে সিএমপির বাকলিয়া থানার যাত্রা শুরু হলেও গত ১৬ বছর ধরে এই থানার কার্যক্রম চলছে বহদ্দারহাট-নতুন ব্রিজ সড়কের রাহাত্তারপুল-কালামিয়া বাজার এলাকার মাঝামাঝি সড়কে ছোট্ট একটি ভাড়া করা ভবনে। ২০১৩ সালে থানার অফিসার ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বাকলিয়া থানার নিজস্ব জায়গার জন্য প্রশাসনিকভাবে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়। তবে পছন্দনীয় ও বড় মাপের উপযুক্ত জমি পাওয়া যাচ্ছিল না।
বাকলিয়া থানায় একাধিকবার ওপেন হাউস ডে অনুষ্ঠানে এলাকাবাসী ও আগত অতিথিদের নানা অনুরোধ করেও জমির ব্যবস্থা হচ্ছিল না। থানার নথিপত্র দেখে জানা গেল, বাকলিয়ায় থানার জন্য কল্পলোক আবাসিক এলাকায় জমির জন্য আবেদন করা হলেও সেটি প্রত্যাখান করে সিডিএ।
বিষয়টি জানার পর এলাকাবাসীকে বোঝানো হয়। কল্পলোক আবাসিক এলাকা আপনাদের জমি অধিগ্রহণ করেই করা হয়েছে। সেই জমিতে সরকারি মূল্যে আপনাদের থানার জায়গা প্রাপ্তি আপনাদের অধিকার।
বিষয়টি তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেবার পর ওপেন হাউস ডে’র একটি অনুষ্ঠানে সিডিএ চেয়ারম্যান জনাব আব্দুচ ছালামকে অতিথি করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে আমিসহ এলাকার মান্যগন্য ব্যক্তিরা থানার জন্য কল্পলোক আবাসিকে সিডিএ থেকে জমি বরাদ্দের জন্য জোর দাবি তুলি। ওই দাবির প্রেক্ষিতেই সিডিএ চেয়ারম্যান কল্পলোক আবাসিকে থানার জন্য ২০ কাঠা জমি বরাদ্দের আশ্বাস দেন। এর ছয় মাসের মধ্যে প্রশাসনিক কার্যক্রম শেষে কল্পলোক আবাসিকেই বাকলিয়া থানার জন্য ২০ কাঠা জমি বরাদ্দ দেয় সিডিএ। ১৬ বছর ধরে যে সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছিল না। সেটার সমাধান করে দিল পুলিশিংয়ের নতুন এই দর্শন।
এছাড়াও অবৈধ বিলবোর্ড, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, পরিচ্ছন্নতা অভিযানের মতো বৃহদাকার অভিযানগুলোর সাফল্যও কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ফল। এই কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ফলেই চট্টগ্রামের সৌন্দর্য এখন আর বিলবোর্ডের আড়ালে ঢাকা পড়ে না। আবর্জনার দুর্গন্ধের স্থলে সৌরভ ছড়ায় ফুলের মিষ্টি গন্ধ। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব রূপ নেয় অংশীদারিত্বমূলক সমাজ গঠনে। সত্যিই, জনসেবায় জনসম্পৃক্ততার বিকল্প নেই।
এক নজরে কমিউনিটি পুলিশিং
লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট পিলের গণমুখী পুলিশিং এর মূলনীতি থেকেই মূলতঃ কমিউনিটি পুলিশিং এর ধারণা আসে। কমিউনিটি পুলিশিং হচ্ছে অপরাধ সমস্যা সমাধানে পুলিশ ও জনগণের যৌথ অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার একটি নতুন পুলিশি দর্শন। আমাদের দেশে পুলিশি কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কার্যকরভাবে অপরাধ প্রতিরোধের জন্য কমিউনিটি পুলিশিং ধারণা গ্রহণ করা হয়েছে।
কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থায় কমিউনিটির সদস্যগণ, সমাজের বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং পুলিশের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অপরাধ প্রতিরোধ ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কমিউনিটি পুলিশিং মূলত একটি প্রতিরোধমূলক পুলিশি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় অপরাধের কারণগুলো অনুসন্ধান করে সেগুলো দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। অপরাধের কারণগুলো দূর করা যেহেতু পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয় তাই এই কাজে অন্যান্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।
কমিউনিটি পুলিশিং এর যাবতীয় কর্মকাণ্ড অপরাধ প্রতিরোধ তথা অপরাধ যাতে ঘটতে না পারে সেই লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণ নিজেরাই যাতে নিজ নিজ এলাকার অপরাধগুলো প্রতিরোধ করতে পারে সেজন্য পুলিশ জনগণকে আইনি পরামর্শ দেওয়া, অপরাধ সম্পর্কে সচেতন করা, অপরাধকর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য বা পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করে।
লেখক: পুলিশ পরিদর্শক, অফিসার ইনচার্জ, বায়েজিদ বোস্তামী থানা, সিএমপি, চট্টগ্রাম।