পারাবত থেকে: শৈশবেই ফিরে যেতে হয়। বার বার ফিরে যেতেই হয়।
শেষ খেজুরের রস খেয়েছি তাও বছর চারেক। দু-এক চুমুক মাত্র। এরই মধ্যে মনে পড়লো নিপাহ ভাইরাসের কথা। ভাবলাম শৈশবের কিছু কিছু বিষয় হয়ত ফিরে আসে কিন্তু পুরোপুরি নয়। সাথে যোগ হয় কালের ভাইরাস-এন্টিভাইরাস।
গ্রাম এখন অনেক পরিবর্তিত। রূপ পাল্টে শহর হওয়ার জন্য তার শত চেষ্টা। বাড়ির সামনে গাড়ি থাকতে হবে, ঘরের সামনে দোকান, ঘরে ঘরে টিভি-ডিশ। শান বাধানো পুকুর অনেক আগেই বিলীন। নদীর জল শুকিয়ে তার বুকে জেগে উঠেছে জল-শুন্য চরা। তবু সেখানেই আবার জীবনের আবাদ। নতুন ফসল-সবুজ ধান, সোনালী গম অথবা হলুদ শর্ষে। এতো শুধু ফসল নয়-জীবনেরই নানা রঙ, নানা স্বাদ।
শেষ কবে শিশির ছুঁয়েছি আজ আর মনে পড়ে না। গ্রামের মেঠো পথে হাঁটতে গিয়ে পুরো পা শিশিরে ভিজে যেতো। আর মৃত ধূসর দুর্বাঘাসগুলো লেগে থাকতো পায়ে পায়ে। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে রং বেরঙের গাদা ফুল নিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে অবশেষে দরিদ্র কিন্তু গর্বিত ও অহঙ্কারি মিনারের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়াতাম মনে হতো কী যেনো বলতে চায় সে। তখন সালাম-বরকত জব্বারকে চিনতাম না। চিনতাম শহীদ মিনার। আজ সালাম রকতকে জানি, কিন্তু প্রাণের সেই মিনার আজ আর খুঁজে পাই না! হারিয়ে গেছে শহরের ইটপাথরের উন্নয়নের ভিড়ে। তবুও ফিরে আসে শিশির, গাদা ফুল সালাম ররকত।
ফিরে আসে জাহাঙ্গীর, রুহুল আমিন, আবদুর রউফ, ৩০ লাখ শহীদ, আরো অনেকে। ফিরে আসে ডিসেম্বর। আজ এর পহেলা। বিজয়ের মাসের প্রথম দিন। বাংলাদেশ একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ফসল। আমরা একটি দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের পথ ধরে স্বাধীনতায় পৌঁছেছি। এ সংগ্রাম ছিল একটি অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায় বিচারের পক্ষে। এটি একটি জনযুদ্ধও। সব শ্রেণী-পেশার মানুষই এর অংশীদার। ১৯৭১-ইতিহাসের নৃশংশতম এক গণহত্যার নাম। এর শিকার হয়েছেন আমাদেরই পূর্বপুরুষরা। আমরা তাদেরই উত্তরাধিকার।
এলোমেলো এ রকম আরও কত কথা মনের মাঝে নাড়া দেয়। এরই মাঝে এগিয়ে চলছে ট্রেন। গন্তব্য সিলেট। সকাল ৭টায় বিমানবন্দর স্টেশন থেকে সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা।
ট্রেনে সিলেট গিয়েছি অন্তত এক দশক আগে। সে অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। যতো দূর মনে পড়ে প্রায় ১০-১১ ঘণ্টার যাত্রা ছিল সেটি। ট্রেন আখাউড়া এসে আবার উল্টা পথে কেন যায় সে প্রশ্নই বারবার মনে ঘুর পাক খেতে তখন। এখন আখাউড়া এসে ট্রেন আর উল্টো পথে (আসলে ঠিক পথেই যেতো) যায় না। ঢাকার ট্রেনকে সিলেটে যাওয়ার জন্য আগে আখাউড়া এসে লাইন পরিবর্তন করতে হতো। এখন আর তা লাগে না। সরাসরি সিলেটে চলে যায়। এ সরকারের আমলে রেলে প্রচুর কাজ হয়েছে। ঢাকা-সিলেট যাত্রা এখন ৬ ঘণ্টায়ই খতম। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ৫ ঘণ্টায়। ঢাকা চট্টগ্রামে ডাবল রেল লাইন হয়ে গেছে। এখন আর সিগলানের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় না। পৃথক রেল ট্র্যাক- তাই যাত্রাও স্বল্প সময়ের। এখানে মাত্র কয়েক কিলোমিটার ডাবল লাইন হতে বাকি আছে। এটি সম্পূর্ণ হলে সময় আরও কমে যাবে। দক্ষিণের সঙ্গে রেল সংযোগও পরিকল্পনাধীন। পদ্মাসেতু হলে রেল যাবে বরিশালেও। দক্ষিণ তথা বরিশালের মানুষও শুনবে রেলগাড়ি ঝমাঝম! ফরিদপুরের মৃত লাইনগুলো আবার জীবন ফিরে পেয়েছে। রেল নিয়ে এ সরকারের উন্নয়ন ফিরিস্তি আরও দীর্ঘ!
১৬ কোটির দেশ। তাই রেল ছাড়া গতি নেই। আগামীর বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে রেলের মাধ্যমেই। জলপথের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। রেল আর জলই ভরসা। না হলে শ্লথ হয়ে যাবে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাস্তা ফোর লেন, আট লেনে কুলোবে না।
যে শহর ছেড়ে আমরা এখন সিলেটের পথে সে শহরে এখনও কুয়াশা পড়েনি। সকালের সূর্য সেখানে স্বাধীন। পরাধীন কুয়াশা। অগ্রহায়ণের মধ্যভাগেও কুয়াশার দেখা নেই। শিশির তো পরের কথা। ট্রেন টঙ্গী অথবা ধীরাশ্রম পার হওয়ার পরই দেখা পেলাম ঘন কুয়াশার। হয়ত পাবো শিশিরের দেখা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৬
আইএ