ছাপা কাগজের ফর্মার হিসেব বোঝে না শিশুরা। কিন্তু নতুন বইয়ের ঘ্রাণ চিনতে তাদের ভুল হয় না।
তাইতো কোমলমতি শিশুদের শৈশবকে রঙিন করছে পাঠ্যবই। যার নেপথ্যের কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সন্তানের হাতে নতুন বই দেখে খুশি হন বাবা-মায়েরা। তাদের অনেকেই হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কারণ, যারা এখন অভিভাবক, তাদের শিক্ষাজীবনের গল্প ছিল ভিন্ন। বছরের শুরুর দিনে নতুন বই ছিল তাদের কাছে দু:স্বপ্নের কাছাকাছি। তখন বড় ক্লাসের শিক্ষার্থীদের পুরনো বই পরের ক্লাসে দেওয়ার রেওয়াজ ঠিল। বইয়ের শেষের অধ্যায় নেই, মাঝখানে পৃষ্ঠা ছেঁড়া, আঁকাআঁকির মহাকাব্য- এসব মেনেই শুরু হতো শিক্ষাজীবন।
মার্চ-এপ্রিল নাগাদ নতুন বই পাওয়া যেতো, তবে টাকা দিয়ে কিনতে হতো। কিন্তু এখন দিনবদল হয়েছে। আর এ পরিবর্তনের দিশারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার দুরদর্শী চিন্তার কারণে বছেরের শুরুর দিনে নগর থেকে গ্রামে সর্বত্রই বই উৎসবের আমেজ শুরু হয়।
বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের আট বছরে সরকারের অর্জন অনেক। কারণ, মোটা মলাটে রঙিন বই এদেশে বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে। যার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এবার সাড়ে চার কোটি শিশুর হাতে ৩৬ কোটিরও বেশি বই তুলি দেওয়ার কৃতিত্ব গোটা শিক্ষা পরিবারের। পাঠ্যবইয়ের লেখক, মুদ্রাকর, সম্পাদক, প্রুফ রিডার, মেশিনম্যান, বাইন্ডার, ট্রাকচালক- এই মানুষগুলোর সঙ্গে রয়েছে সরকারের দুই মন্ত্রণালয়।
বই তৈরি করে দেওয়ার পর আমাদের শিক্ষকেরা সযত্নে বইগুলো তুলে দিচ্ছেন শিশুদের হাতে। অসংখ্য মানুষের নিরলস পরিশ্রমের কারণে বছরের শুরুর দিনে সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে যাচ্ছে।
এবার প্রাথমিক স্তরের আড়াই কোটি শিশুর হাতে বিনামূল্যে সাড়ে ১১ কোটিরও বেশি বই তুলে দিচ্ছে সরকার। পৃথিবীতে একশ’টির বেশি দেশ রয়েছে যাদের জন্যসংখ্যা আড়াই কোটির কম।
এই শিশুরাই তো আগামীর বাংলাদেশ। তাদের জনসম্পদে পরিণত করছে সরকার। একইসঙ্গে বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে। একযুগ আগেও বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু সেই অসাধ্য সাধন করে চলেছে সরকার।
আওয়ামী লাগ সরকার সব সময় শিক্ষকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধনে সকল শিশুর বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা নিশ্চিত করেন বঙ্গবন্ধুর সরকার। অর্থের অভাব থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সে বছর ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ৪০ লাখ বিনামূল্যের বই ছাপিয়ে তা বন্টন করেন। ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫: এইচ টি ইমাম)।
তারই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার পথেই হেঁটেছেন। ২০১৩ সালে তিনি ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন।
২০১৭ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শ্রেণির ২ কোটি ৪৯ লাখ ৮৩ হাজার ৯৯৩ জন ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে বিতরণের জন্য ১১ কোটি ৫৫ লাখ ২৬ হাজার ৯৫২ কপি পাঠ্যপুস্তক ২ শতাংশ বাফার স্টকসহ ছাপানো হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী পাঠ্যপুস্তক বিতরণ উৎসবের উদ্বোধন করেছেন।
প্রাথমিক প্রর্যায়ের শিক্ষার্থীদের প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৬টি বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনে সম্পূর্ণ নতুন, চার রঙা ও আকর্ষণীয় পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে ই-বুকের ব্যবস্থা। প্রবাসের বাঙালি শিশুদেরও বই উৎসবে সামিল রেখেছে সরকার। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের অধীনে বিদ্যালয়গুলোতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই সরবরাহ করছে এনসিটিবি।
এবারই প্রথম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের জন্য নিজস্ব বর্ণমালা সম্বলিত মাতৃভাষায় পাঠ্যবই প্রণয়ন এবং সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ২০১৭ সালেই প্রথম প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশে ৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাদরী) শিক্ষার্থীদের মাঝে ৮ ধরনের পঠন-পাঠন সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।
এদেশে প্রতিটি সকাল আসে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে। আর সেই সম্ভাবনার পথে এগিয়ে চলেছে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রতিদিনের গ্রাম কিংবা শহরে এভাবে জ্ঞানের আলোর দীক্ষা নিতে ছুটে যায় শিশুরা। কারণ, শিক্ষা এখন সুযোগ নয়, অধিকার। আর বিনামূল্যে পড়ালেখার সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। গরিব অথবা সামর্থ্যবান সকলের সন্তানেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগকে ত্বরান্বিত করতে সরকার এক কোটি ৩০ লাখ শিশুকে উপবৃত্তির সংস্থান রেখেছে। চালু রয়েছে স্কুলফিডিং কর্মসূচি।
প্রাথমিক শিক্ষার বাতিঘর জ্বালিয়ে রাখছেন প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক। তাদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষতা বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সনাতনী পাঠদানের পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোতে মাল্টিমিডিয়া পদ্ধতিতে পাঠদান চলছে। আধুনিক পদ্ধতিতে আনন্দময় পরিবেশে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির সঙ্গেও পরিচিত হচ্ছে শিশুরা।
আমাদের লক্ষ্য, শিশুদের নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। তাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস শেখানো হচ্ছে। বাঙালি জাতির গৌরবগাথা আর বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাঙালির অধিকার আদায়ে যিনি জীবনের মূল্যবান ১৩টি বছর কারাগারে কাটিয়েছেন, তার জীবনী থেকেই শিশুরা শিখছে আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা।
বঙ্গবন্ধুর উত্তরসুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুরদর্শী এবং যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন সমগ্র বিশ্বের উন্নয়নের রোড মডেল। তার নেতৃত্বে হয়েছে সমুদ্রজয়, জিডিপি ছাড়িয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ, রফতানি ছাড়িয়ে গেছে ৩৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন, মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ প্রকল্প, সমুদ্রবন্দরসহ মেগা মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে।
শিক্ষাখাতে বিপ্লব সাধিত হচ্ছে। শিল্প-সাহিত্য, খেলাধূলায় ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখাচ্ছে বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা। ডিজিটাল বাংলাদেশের সাফল্য ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম-গঞ্জে। লোডশেডিং শব্দটি এখন অতীত ইতিহাসের বিষয়। দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে পদ্মাসেতুর কাজ। এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সাফল্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলছে। যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তানের হাতে বাংলাদেশ। এ উন্নয়নের পথচলা নিরন্তর।
তাই শিক্ষার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে হাঁটছি আমরা। দেখছি নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্ভাবনা। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ শত বাধা পেরিয়ে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী
বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬
এএসআর