ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

গ্রিনফেল টাওয়ারের আগুন, প্রশ্ন ও আরেকটি হামলা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫০ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৭
গ্রিনফেল টাওয়ারের আগুন, প্রশ্ন ও আরেকটি হামলা আগুনে নিহত-নিখোঁজদের একাংশ ও আগুনে পোড়া গ্রিনফেল টাওয়ার

দুঃখ যেমন চারদিকে বিস্তৃত হয়েছে লন্ডনের কেনজিংটন ঘিরে, তেমনি গ্রিনফেল টাওয়ার ঘিরে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য প্রশ্ন আর ক্ষোভ। ব্রিটেনের মতো দেশে কীভাবে ২৪ তলা টাওয়ারে আগুন লেগে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারালো তা নিয়ে প্রশ্নতো উঠবেই।

বাতাসে বারুদের গন্ধ নেই, খোলা আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে না জ্বলন্ত লাশের গন্ধ, তবুও এটাই সঠিক গ্রিনফেল টাওয়ারে নিখোঁজ হয়েছে আমাদের হোসনার তরুণী প্রাণ। সেখানে নিঃশেষ হয়ে গেছে তার বাবা-মা আর ভাইয়ের দেহও।

যুদ্ধ-ফেরত শরণার্থী, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী, ইউরোপের দেশ থেকে আসা মানুষসহ অধিকাংশ সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর আবাস ছিলো এ টাওয়ারে। সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত ৭৯ জন নিহত হয়েছেন, না হয় নিখোঁজ রয়েছেন এ টাওয়ারের। কিন্তু আসলেই কি তাই। এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

দুর্ঘটানার পরের দিন সম্ভবত এক সোমালি বংশোদ্ভূত তরুণী আমিনার লাইভ আলাপ দেখেছিলাম বিবিসিতে। তাকে যখন সাংবাদিক প্রশ্ন করছিলেন, তখন ওই তরুণী বলছিলেন, আমি পরে বলবো। আমি বলবো ভিন্নকথা। বলেছিলেনও তাই। আমার ভালো লাগেনি, তার এ কথাটি। তিনি ছিলেন ক্রদ্ধ। প্রশ্ন তুলেছিলেন, এ মানুষগুলো মরলো কেন? তড়িৎ কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এক পর্য়ায়ে বলেই ফেলেন, এটাতো রিভেঞ্জ! সাংবদিক বিস্মিত হন। তিনি একথাটি শুনতে চাননি। আমরাও শুনতে চাইনি এসব কথা। আইলা নামের আরেক তরুণীর কান্না দেখেছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। তিনি স্বেচ্ছাসেবক। তার ক্রোধ আমাকেও তাড়িয়ে নিয়েছে। তারই মতো প্রশ্ন জাগিয়েছে। চিৎকার করে বলছেন, খাবারের কোনো অভাব নেই, পানি পড়ে আছে। প্যাকেটের পর প্যাকেট, কেউ নিতে আসছে না। তার প্রশ্ন হলো ভিকটিম কোথায়? শত শত মানুষ ছিলেন এখানে, চিৎকার দিয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে বলছেন এরা কোথায়? তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। আয়লা এই এলাকায়ই থাকেন। প্রতিদিনই আসছেন। টিভি এখন তাকে নিয়ে মেতে  উঠেছে।

২.
ব্রিটেন ভিন্নভাষী, ভিন্ন সংস্কৃতি ভিন্ন বর্ণ ভিন্ন গোত্রের মানুষের এক মিলনস্থল। এখানে ‘ডাইভার্সিটি’ আর ‘কোহেশন’ শব্দ দুটো বহু এবং বারবার উচ্চারিত শব্দ। ব্রিটেনের রাষ্ট্রযন্ত্রও ভিন্ন বংশোদ্ভূত মানুষের বৈচিত্র্যময় সংযোগেই সমৃদ্ধ হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের মতো যখন ব্রিটেনের ম্যানচেস্টারে টেরোর আক্রমণ হয় তখন ব্রিটেনের সব মানুষই এক হয়েছে। বিভিন্ন শহরে দু-একজন যখন বর্ণবাদী কিংবা সাম্প্রদায়িক আতঙ্ক বিস্তার করতে চেয়েছে, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই এগিয়ে এসেছে। সরকার নিরাপত্তা দিয়েছে। সাময়িক হেট ক্রাইম বাড়লেও তা ক্রমেই কমে আসছে এখন। সে হিসেবে গ্রিনফেল টাওয়ার কোনো আক্রমণ নয়, একটি দুর্ঘটনা।

সব দুর্ঘটনাকে আমরা নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে পারি না। সেজন্যেই হয়ত ব্রিটেনের মানুষ এটাকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখছে না। অন্তত ব্রিটেনের মতো দেশ, যেখানে কথায় কথায় ‘হেলথ অ্যান্ড সেফটি’ ইস্যু খোঁজা হয়, যেখানে মানুষের নিরাপত্তা কিংবা নাগরিকদের সুরক্ষার বিধান রাষ্ট্রের একটা প্রধান দায়ভার, সেখানে মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে নির্মিত হাই রাইজ বিল্ডিং নির্মাণের সময় এগুলো কি মানা হয়েছিলো- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে ব্রিটেনের প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে ফায়ার অ্যালার্ম নিয়ে স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস তাগিদ দেয়, হাজার হাজার পাউন্ড ব্যয় করে, সেখানে ৮.৭ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে পুনঃমেরামত করা বিল্ডিংয়ে মাত্র পাঁচ হাজার পাউন্ডের জন্য আগুন প্রতিরোধক সামগ্রী না লাগিয়ে বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিক সামগ্রী। গত ১৪ জুন ২৪ তলা বিল্ডিংয়ে জ্বলে ওঠা অগ্নিকাণ্ডে আশ্চর্যজনকভাবে ফায়ার অ্যালার্ম বাজেনি।

২.৫ মিলিয়ন পাউন্ড বাঁচানোর জন্য দেশের খ্যাতিমান দরপত্রকারীদের বিল্ডিংয়ের কাজ না দিয়ে যাদের দিয়ে কাজ করানো হয়েছে, তারা বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ কিংবা মেরামতের অনেক নিয়ম-কানুনই তোয়াক্কা করেনি। এরকম হাই রাইজ বিল্ডিং মেরামতে নিয়মানুযায়ী এক ধরনের পানির পাইপ ব্যবহার করার কথা, যেখানে আগুন লেগে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এই পাইপগুলো থেকে পানি বের হয়ে আগুন নেভাতে সাহায্য করে। অন্তত সে ব্যবস্থা থাকলে প্রাণহানি এতো ব্যাপক হতো না, বিল্ডিংও রক্ষা করা যেতো।

ব্রিটেনে একটা ছোট্ট বিল্ডিং তৈরিতেও কাউন্সিলের নির্দেশনা মেনে ধাপে ধাপে কাউন্সিলের প্রকৗশলী দিয়ে শনাক্ত (চেক) করাতে হয়। দু’বছর আগেও এ টাওয়ারের বাসিন্দারা বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন অব্যস্থাপনা এবং সস্তা কাজের ব্যাপারে অভিযোগও করেছিলো কেনজিংটন অ্যান্ড চেলসি বার কাউন্সিলে, কিন্তু কাউন্সিল কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এরকম আরও অনেক প্রশ্নের পর প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে, অভিযোগ আসছে একের পর এক। প্রশ্ন কিংবা এই অভিযোগগুলোর উত্তর কি হবে এখন।

৩.
দেশটির প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার পদক্ষেপ নিতে দীর্ঘস‍ূত্রিতা শুধু যে গ্রিনফেল টাওয়ারের বাসিন্দা কিংবা স্বজনদের ক্রদ্ধ করেছে, তাই নয়, গোটা দেশের মানুষ সমালোচনায় মুখর হয়েছে। লন্ডনে তার অফিস অথচ পরেরদিন এসেছেন তিনি আক্রান্ত মানুষ আর পোড়া বিল্ডিং দেখতে। তা-ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নন। এসেছেন ব্যক্তিগত সফরে। ওইদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নই করতে দেওয়া হয়নি। তিনি মিডিয়া থেকে দূরে ছিলেন। অথচ গ্রিনফেল অগ্নিকাণ্ড ব্রিটেনের একটা জাতীয় দুর্যোগ। এ দুর্যোগ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কথা বলেননি। টাওয়ারের অসহায় মানুষের পাশাপাশি দেশের কোনো নাগরিকই এটা প্রত্যাশা করেনি।

আসলে টেরিজা মে কি খুব একটা কঠিন সময় পার করছেন, সে একটা প্রশ্ন আসতেই পারে। এরকম একটা দুর্যোগে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেননি মে, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাধারণ মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন না বুঝে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছেন তিনি। অথচ বিরোধীদলীয় নেতা ব্রিটেনের জনপ্রিয় নেতা করবিনকে পেয়ে মানুষ ঘিরে ধরেছে, ভিকটিমদের জড়িয়ে ধরেছেন তিনি। সাধারণ মানুষের মতো তারও অভিযোগ ফায়ার সার্ভিসে লোকবল কমিয়ে এনেছে সরকার। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের নিরলস কাজের প্রশংসা করেছেন তিনি। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের অপ্রতুলতার কারণে দুর্যোগটা আরও ব্যাপক হয়েছে, মৃত্যু বেড়েছে, এ দায়তো সরকারকে নিতেই হবে। এসব অভিযোগ গুলোর কারণেই কেনজিংটন অ্যান্ড চেলসি বার কাউন্সিলে স্থানীয় মানুষ বিক্ষোভ করেছে, মানুষ ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের দিকেও বিক্ষোভের মিছিল নিয়ে গেছে।

৭৯ জন মানুষের নিহত হওয়ার খবর আমরা পাচ্ছি, কিন্তু সে নিখোঁজের মিছিল প্রলম্বিত হবেই। স্বেচ্ছাসেবী আইলা যেমন বলেছেন কোথায় টাওয়ারের শত শত মানুষ, আমরা চাই আইলার কথাটি মিথ্যে হোক,আমরা আশাবাদী সেই শত শত মানুষ ফিরে আসবে। গ্রিনফেল টাওয়ারের মানুষ আবারও লন্ডনে কিংবা ব্রিটেনের কোনো শহরে ভয়হীন জীবন কাটাবে, স্বস্তি নিয়েই জীবনের বাকি দিনগুলো কাটবে, স্বজন হারানোর ক্রন্দন কিংবা দীর্ঘশ্বাস নিয়েই।

৪.
একটা দুর্ঘটনা ঘটার পর আমলাতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া যেমন হয়, ঠিক তেমনি হয়েছে। লাল ফিতা দিয়ে পুলিশ ঘিরে রেখেছে টাওয়ার। স্বজনহারা নিঃস্ব মানুষগুলো মে’র সঙ্গে দেখা করেছে। ৫ মিলিয়ন পাউন্ডের তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে। কিন্তু প্রশ্নতো মিলিয়ে যাবে না এই স্বজনহারা মানুষদের কাছে থেকে, কিংবা এই দেশের অগণিত মানুষের হৃদয় থেকে। এই টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড আর প্রলম্বিত নিখোঁজ মানুষের মিছিল কি একটা ধনী সমৃদ্ধ দেশটার নেতৃত্বকেই চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেলো না।

৫.
১৯ তারিখ সকাল শুরু হয় আরেকটা সন্ত্রাসী হামলার খবর দিয়ে। এ হামলা হয়েছে লন্ডনের ফিন্সবারি পার্কে। এবারের আক্রমণটা ভিন্ন। একজন শ্বেতাঙ্গ মধ্যবয়সী ভ্যানচালক নামাজ-ফেরত মুসল্লিদের উপর ভ্যান চালিয়ে দেয় মধ্যরাতে। একজন নিহত হন এবং ৮ জন আহত হন এ আক্রমণে। আশার কথা টেরিজা মে অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠেই এটাকেও টেরোর আক্রমণ হিসেবই উল্লেখ করেছেন।

আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই আমিনার উচ্চারিত ‘রিভেঞ্জ’ শব্দটা গ্রিনফেল টাওয়ারের বেলায় অবশ্যই কোনো যুক্তির মাঝে পড়বে না, তবে ৪৮ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ পুরুষের মুসল্লিদের উপর ভ্যান চালিয়ে দেওয়া আরেক ফ্যাসিস্ট উগ্রতারই প্রকাশ। ক্রোধান্বিত হয়ে হয়তো এটাকে আমিনার মতো কেউ কেউ বলবেন ‘রিভেঞ্জ’ কিংবা প্রতিশোধ। মুসলিম টেরোর শব্দটি যেমন বহুল প্রচলিত, ঠিক তেমনি হয়তো এর বিপরীতে এখন নতুন শব্দের যোগ হলো।

আসলে ‘মুসলিম’ শব্দ দিয়ে টেরোর হামলাকে ব্রাকেটবন্দি করা হলেও উগ্রতার স্থান-কাল কিছুই নেই। একটা মিথ্যে সম্মোহনে এরা নিজেরাই মূলত ব্রাকেটবন্দি, তাইতো এরা ঘটিয়ে যায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড। মুসলিম হোক, কালো হোক, সাদা হোক- যে অপশক্তিই ঘটাক না কেন এরকম টেরোর আক্রমণ, এটা মানবতার বিরুদ্ধে কিছু বিকারগ্রস্তদের নৃশংস পাশবিকতা ছাড়া কিছুই নয়। অতএব গাইতে হবে ঐক্যের জয়গান।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৪ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।