এখন দেখা যাক বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা বিশিষ্ট পণ্ডিতরা কি বলেন, আমেরিকান লেখক এবং বিখ্যাত রাজনীতিবিদ হেলেন কেলার বন্ধুর গুরুত্ব প্রকাশ করে বলেছিলেন “I Would rather walk with a friend in the dark, Than walking alone in the light”
আমেরিকান অভিনেত্রী লিনডা গ্রেসন বন্ধুকে নিয়ে মজা করে বলেছিলেন- “There is nothing better than a friend, unless it’s a friend with chocolate”
অন্যদিকে চীনা দার্শনিক মেনসিয়াস আসল বন্ধুর গুরুত্ব বুঝিয়ে বলেন- “Friends are siblings that god never gave us”
আফ্রিকান প্রবাদে আছে যে “Between true friends even water drunk together is sweet enough”
ইংরেজি পাদ্রি থমাস আ্যকুইনাস বলেছিলেন- “There is nothing on this earth more to be prized than true friendship”
বন্ধু বিষয়ক আলোচনায় এতক্ষণ বিশেষজ্ঞ মতামত উল্লেখ করা হলো। এখন ব্যক্তি জীবনের নানা ঘটনা থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, প্রভাব ও ব্যাপকতা আলোচনার দাবি রাখে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়: মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রামপাশা গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে হৈ হুল্লোড়, হাসি-তামাশা, খেলাধুলাই ছিল প্রধান। পাশাপাশি পড়া লেখার জন্য অভিভাবকদের বকাঝকা বন্ধুদের সাথে শেয়ার করাই ছিল মুখ্য কাজ।
উচ্চ বিদ্যালয়: কমলগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ও দি এইডেড উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি বন্ধুত্বের সম্পর্কের কিছুটা বিকাশ ঘটতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দুষ্টুমির জন্য প্রধান শিক্ষক স্যার এর শাস্তি অনিবার্য ছিল। ব্যক্তিগত ভাবে আমিও দুষ্টুমি করবো না মর্মে একাধিকবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।
কলেজ: কলেজ জীবনে এসে বন্ধু জীবনের এক অজানা দিক উন্মেচিত হয়। সহশিক্ষা থাকায় ছেলে বন্ধুর সাথে মেয়ে বন্ধুও জুটে যায়। সিলেট সরকারি কলেজে সেই ১৯৮৪-৮৫ সনে পড়ার সময়ের এক ঘটনা না বললেই নয়। এক বন্ধু আমাকে পড়াশোনাতে মনোযোগী হওয়ার জন্য উপদেশ দেয়। আর যাই কই বন্ধুর উপদেশ শুনে পড়ালেখায় বেশ মনোযোগী হই। এ দিকে অবাক কাণ্ড পরীক্ষার ফল বেরুলে দেখা যায় আমি কৃতকার্য আর সে বন্ধু অকৃতকার্য। তবে তার এ বন্ধুত্বের উপদেশ আজও মনে পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে স্বনামধন্য শিক্ষক ও প্রিয় বন্ধুদের পেয়ে সুন্দর এক জগৎ গড়ে ওঠে। আমাদের সময়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগ সমূহের মধ্যে লোক প্রশাসন বিভাগ এর খুব সুনাম ছিল।
ক্লাস এ যখন শিক্ষকরা আসতেন আমরা সব চুপ মেরে স্যারদের কথা শুনতাম। অধ্যাপক নুরুস সাফা, অধ্যাপক আব্দুন নুর, ড. আহমেদ শফিকুল হক, অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন, অধ্যাপক রুহুল আমিন এর মত নামকরা শিক্ষকরা আমাদের পড়াতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কার্যক্ষেত্রে কোন ভেদাভেদ ছিলো না। আমরা সকলে মিলে একত্রে আড্ডা দিতাম, মজা করতাম, পড়ালেখার ব্যাপারে ব্যক্তিগত ভাবে আমি অনেক বন্ধুদের কাছে ঋণী। এবার আশা যাক বন্ধুত্বের সম্পর্কের বিষয়ে আমার কিভাবে লেখার আগ্রহ জাগালো।
একটি ছোট ঘটনা তবে এর প্রভাব বিস্তৃত ও ব্যাপক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর ২১ তম ব্যাচের বন্ধুরা ঢাকায় অফিসার্স ক্লাবে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে এক জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পারিবারিক কারণে আমি যেতে পারিনি। যাক আমাদের ২১ তম ব্যাচের দুইজন সহকর্মী অনুষ্ঠানে গেল এবং তাদের সুবাদে প্রকাশিত ম্যাগাজিন আমি দেখতে পেলাম। এজন্য অনুষ্ঠানের আয়োজক ফারুকী, নেয়ামুল বশীর, শিপন, তোফা, জীবন, এটিএম শোয়েব, ফেরদৌস আলম সহ সকল বন্ধুদের প্রতি ধন্যবাদ রইল।
শুরু হলো আমার নতুন কর্মযজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে ফিরে এসে চব্বিশ বছরে যাদের দেখা পাইনি তাদের অনেককেই ম্যাগাজিন এ দেখতে পেলাম। শুরু হলো Facebook Friendship ও মোবাইল যোগাযোগ। মোবাইলে বন্ধু নিলুকে পেয়ে কথা শুরু করলাম। ‘আপনি নিলু বলছেন’ এভাবে কথা শুরু করলে সে থামিয়ে দিয়ে বলল তুমি ২১ তম ব্যাচ এর তাই আপনি আপনি না বলে তুমি করে বল, কথা শুনে বেশ ভাল লাগল।
খবর নিয়ে দেখি আমার বন্ধু দাউদ সরকারি অফিসের বড় কর্তা। তার সাথে দেখা করতে গেলে জড়িয়ে ধরল, ছবি তুললো ও আপ্যায়ন করালো।
কয়েকদিন পরে দেখি Facebook এ সে ছবি ছেড়েছে, এত করে বন্ধুদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল। বন্ধুরা আমার খবর নিতে শুরু করল। ইংল্যান্ড, আমেরিকা থেকে শুরু করে পৃথিবীর নানা প্রান্তে অবস্থানরত বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হলো। এক সময় মনের টানে ও বন্ধুদের সাক্ষাতের আশায় ছুটে গেলাম চট্টগ্রাম শহরে। দেখা হলো বন্ধু কামরুল হাসান খান, আক্তার কামাল, আব্দুর রহিম ও মোস্তাফা এলাহীর (রুমী) সাথে। তারা সবাই আজ প্রতিষ্ঠিত। বন্ধুরা প্রতিষ্ঠিত দেখে খুব ভাল লাগল। যাক তাদের মধ্যে কেউ জোর করে বাসায় নিয়ে গেল, কেউবা চট্টগ্রাম শহরের রেস্টুরেন্টে খাওয়াল। তাঁদের পরিবারের সাথে পরিচয় হলো। মিসেস কামরুল এবং মিসেস আক্তার ভাবির আন্তরিকতার কথা উল্লেখ করতে হয়। আমার প্রিয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা হলো শিক্ষক দম্পতি বন্ধু মোজাম্মেল হক ও শামসুন্নাহার মিতুল এর সাথে। এক সাথে কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটানোর জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাতে হয়। আমি ও অনেকদিন পর বন্ধুদের পেয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে ছেড়ে দিলাম। দিনের একটা বড় সময় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াই। ছুটে যাই এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। এত আনন্দ, আবেগ, অনুভূতিতে জড়িয়ে যাই যা সত্যিকার অর্থে প্রকাশ করা যাবে না। এখানে সঙ্গত কারণে ধন্যবাদ দিতে হয় আমার ভাগনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন সৈয়দ মোস্তফা মোহাম্মদ আলীকে। তার সৌজন্যেই আমার চট্টগ্রামে অবস্থান করাসহ গাড়ি সুবিধা পাওয়ায় বন্ধুদের খোঁজে ঘুরে বেড়ানো সহজ হয়। এখানে বলে নিতে হয় কর্মক্ষেত্রে প্রিয় ক্যাম্পাস শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আর ছাত্র জীবনের সূত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইলে আলাপ হলো লোক প্রশাসনের বন্ধু ইকবাল আহমদ খান, সেলিম, কবির আজাদ, সুস্মিতা, সীমা, জেবা, মিলি, সায়মার সাথে। ২১ তম ব্যাচের বন্ধু জহির, মাহবুব, বাবু, আসমা, চিনু, লুসি, শিল্পী, নিলু, জেসি, সুরমা সহ অনেকের সাথে। ২৪ বছর পর বন্ধুদের সাথে কথা বলে খুব ভাল লাগল।
বন্ধুদের আবেগ ও ভাবনায় ডুবে গিয়ে ফেসবুকে এ বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে চার লাইন এর একটি লেখা দিলাম। তাতে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল। পাঠকের কথা চিন্তা করে বন্ধু বিষয়ক মতামত কিছুটা তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারলাম না।
বন্ধু জীবন লিখেছে “দারুণ অভিব্যক্তি। সব মানুষের চেতনা শক্তি এক নয়। বিভিন্ন মানসিকতার লোক সমাজে বাস করে। বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দর্শন থাকতে পারে না। বন্ধু বন্ধুই। তাই নেতিবাচক মানসিকতা পরিহার করে আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে”।
জেসির মতে কিছু লোক আছে যারা বন্ধু ও সুন্দর সর্ম্পকটাকে বোঝে না তাদেরই এই ছোট মন মানসিকতা থাকে। বন্ধু সম্পর্কটা অনেক সুন্দর আর মধুর।
ফারজানা তাহের এর মতে বন্ধুত্ব এমন একটা সম্পর্ক, যে সম্পর্ক অন্য কোন সম্পর্কের সাথে তুলনা করা যায় না। প্রকৃত বন্ধুত্বের সম্পর্ক কখনোই নষ্ট হয় না।
এভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উপর মতামত ও প্রতি উত্তর সাতচল্লিশটা আসে। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটার স্বার্থে তা আর উল্লেখ করা হলো না। তবে প্রতিটা মতামতই গুরুত্বের দাবিদার।
অনেকে বন্ধুত্ব ও প্রেমকে একাকার করে ফেলে। সত্যিকার অর্থে বন্ধুত্বের ব্যাপকতা ও পরিধি অনেক বিস্তর। বন্ধুত্ব শুধু ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিদের মধ্যে নয়। এর উপর নির্ভর করে সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে অনেক কিছু করা যেতে পারে। আর প্রেমকে এভাবে বলা যায় যা দুইজন ব্যক্তিকে তথা মানব মানবীকে জানা ও বোঝার সুযোগ করে দেয়। যার চূড়ান্ত পরিণতি হয় বিবাহ নামক সুন্দর সম্পর্কের মাধ্যমে।
অন্যদিকে সংসার জীবনে বন্ধুর আদর্শ রূপ হলো স্বামী কিংবা স্ত্রী, এরা একে অন্যের পরিপূরক। বিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে স্ত্রীর চেয়ে ভাল বন্ধু আর কেউ হতে পারেনা। একটু চিন্তিত ভাব দেখলেই স্ত্রী জিজ্ঞেস করে “বলো তোমার কি হয়েছে”? এরূপ অভিজ্ঞতা আমার মত সকল বিবাহিত পুরুষেরই রয়েছে। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না।
পরিশেষে স্বল্প পরিসরে বন্ধুত্ব বিষয়ক আর কি বলার থাকে। তবে এটুকু বলতে পারি অতীতের ইতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে আমরা কি সামনের দিকে যেতে পারিনা? আর গান এর সুরের সাথে তাল মিলিয়ে বলতে পারি “বন্ধু বিনে পরাণ বাঁচেনা”।
লেখক: সৈয়দ ছলিম মোহাম্মদ আব্দুল কাদির, অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট