কাজের আলাদা ক্ষেত্রের দূরত্ব কখনই এই বন্ধুত্বে বিন্দুমাত্র ফাটল ধরাতে পারেনি। জীবনভর মেরু-দূরত্বের বাসিন্দা ফিদেল কাস্ত্রো ও গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মধ্যে ছিল তেমনই নিবিড়তম সখ্য।
এমনিতে কেউ কাউকে চিনতেন না। স্বাভাবিক কোনো যোগাযোগ ও সম্পর্কও ছিল না উভয়ের মধ্যে। রাজনীতিবিদ ফিদেল কাস্ত্রোর নাম সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস প্রথম শোনেন কিউবার কবি নিকোলাস গুইলেন-এর মুখে।
গুইলেন জানান, স্বৈরাচারী বাতিস্তা শাসনের অবসান ঘটানোর ক্ষমতা রাখেন আইনের এই তরুণ ছাত্র কাস্ত্রো। কিন্তু তখনই সেই আন্দোলন মুখর ও উত্তাল বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে কাস্ত্রো আর মার্কেসের মুখোমুখি পরিচয় বা দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি।
দু’জনের আনুষ্ঠানিক প্রথম দেখা হলো অনেক পরে। মার্কেসের সঙ্গে কাস্ত্রোর প্রথম সাক্ষাতের ঘটনা ১৯৫৯ সালে কিউবার সফল বিপ্লবের পর। সেটি ছিল জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ। কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হলে মার্কেস জোরালো ভাষায় স্বাগত জানান।
চেকোশ্লোভাকিয়ায় (চেক প্রজাতন্ত্র) সোভিয়েত আগ্রাসনকে কাস্ত্রো সমর্থন জানালে দুনিয়াজুড়ে বিরূপ সমালোচনার মাঝখানে মার্কেস মন্তব্য করেন, ‘পৃথিবী দু’টো সমান লোভী এবং নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র দ্বারা পীড়িত। ’
ক্রুশ্চেভ জমানার সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে মার্কেসের উক্তি ছিল ঐতিহাসিক, ‘এর সঙ্গে সমাজতন্ত্রের মিল ক্রমশ কমছে। ’
কিউবার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রবল সমালোচক ছিলেন মার্কেস আর ছিলেন কাস্ত্রোর একান্ত সমর্থক। যে কারণে অনেক বছর মার্কেসকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হয়। তাতে কী? মার্কেস কোনো অবস্থাতেই কাস্ত্রো সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব ধারণ করেননি বা সমালোচনামূলক মন্তব্য করেননি।
মার্কেস এবং কাস্ত্রোর মধ্যে বন্ধুত্বের ভিত্তি ছিল তাদের দু’জনেরই সাহিত্যের প্রতি টান এবং মতাদর্শিক দায়বদ্ধতা। মার্কেসের হাভানার বাড়িতে কাস্ত্রো ছিলেন নিয়মিত অতিথি।
কীভাবে অত কাজের মধ্যেও কাস্ত্রো এত অধ্যয়নের সুযোগ পেতেন, তা ছিল মার্কেসের কাছে এক প্রবল বিস্ময়। যেমন-মার্কেসের লেখা ‘দ্য স্টোরি অব অ্যা শিপরেকড সেলার’ গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে কাস্ত্রো কথাচ্ছলে মার্কেসকে জানান, ‘নৌকার গতিবেগ সংক্রান্ত একটি ভুল তথ্য বইটিতে আছে। ’
এরপর থেকে মার্কেস কোনো বই প্রকাশিত হওয়ার আগে সেটির পাণ্ডুলিপি কাস্ত্রোকে পড়তে দিতেন।
কাস্ত্রো আর মার্কেস ছিলেন দুই জগতের দুই নির্মাতা। কাস্ত্রো গড়তে চেয়েছিলেন অনন্য কিউবা। পৃথিবীর সব চাপ সহ্য করে তিনি নিজের মতো করে স্বদেশ নির্মাণ চালিয়ে গেছেন জীবনের শেষ সময়েও।
বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল। বন্ধু-রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল শত্রু। চারদিক থেকে তার এবং তার দেশের উপর এসেছিল নানামুখী আঘাত ও ষড়যন্ত্র। কাস্ত্রো ছিলেন নির্ভীক ও লড়াইরত। তিনি তার বিশ্বাসের জগত নির্মাণের কাজে এগিয়েই চলেছিলেন।
পক্ষান্তরে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস লাতিন আমেরিকায় গড়েছিলেন এক নতুন সাহিত্য জগত। তার মহাদেশ ছাড়িয়ে তিনি লাতিন সাহিত্যকে প্রসারিত করেছিলেন বিশ্বময়।
তিনি লিখেছিলেন এক নতুন উপন্যাস। নাম ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড’, যার বাংলা হলো ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ কিংবা ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা’।
অদ্ভুত সেই উপন্যাস, যেখানে কল্পনার-বাস্তব মুখোমুখি দাঁড়ায় চেনা-বাস্তবের সামনে; আতিশয্যময় রূপকথা-স্বরূপ বাস্তবতা চ্যালেঞ্জ জানায় চেনা-বাস্তবকে। পৃথিবীর দূরতম লাতিন আমেরিকায় ‘জাদু বাস্তব সাহিত্য’র এক অভিনব অভিযাত্রা আরম্ভ হয় মার্কেসের হাত ধরে।
সাধারণ পাঠকের মনে হতে থাকে, লেখকের সৃষ্ট জগতটি চেনা, আবার কিছুক্ষণ পরেই মনে হয়। না, না, এ-তো সম্পূর্ণ অচেনা।
মার্কেসের উপন্যাসটি একটি অবহেলিত ও শোষিত মহাদেশের বিপন্ন মানুষের অস্তিত্বের বহু বর্ণময়তার আখ্যান। যাতে অনেক মানুষ এবং ঘটনার সমাবেশ ঘটে আর শেষে বেজে চলে একটা বিষণ্ন সুর। একই ভাবে, কাস্ত্রোর জীবনও বঞ্চিত দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের একটি নিষ্পেষিত দেশের জাগরণের আখ্যান।
অর্জনের আনন্দ ও বেদনার বহু বিষণ্ন সুর কাস্ত্রোকেও ঘিরে রেখেছে। শেষ বিচারে মনে হয়, দুই জগতের এই দুই দিকপাল দূরতম কর্মক্ষেত্রে থেকেও কত কাছাকাছি। দূরত্বের প্রাচীর ডিঙিয়ে দু’জনেই যেন নিবিড় বন্ধুত্বের আলিঙ্গনে আবদ্ধ।
রাজনীতি ও সাহিত্যের মেরু-তুল্য দূরত্বের দুই বিশাল বাসিন্দার এই বন্ধুত্ব সত্যিই এক বিরল ঘটনা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১৮
এমপি/এসএইচ