মূলত আশি দশকের ইত্তেফাক ভবন আজকের মতো একটি বাড়িমাত্র ছিল না। তখন সেটি ছিল বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের শীর্ষ ও নেতৃস্থানীয় কমপ্লেক্স।
আশি দশকের শুরুতে সেই ইত্তেফাক ভবনে আমার প্রথম প্রবেশ ‘দ্য নিউ নেশন’-এর সুবাদে। ‘দ্য নিউ নেশন’-এর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসাবে প্রবেশ করলেও ‘রোববার’, ‘ইত্তেফাক’-এর সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে সেই ভবনটি থেকে অবশেষে বের হতে পেরেছিলাম প্রায়-দশ বছর পর।
‘নিউ নেশন’-এর মফস্বল সম্পাদক প্রবীণ আবদুস সোবহান সাহেব অচিরেই আমাকে তাঁর বিভাগ থেকে মূল নিউজ বিভাগে পাঠিয়ে দেন। ক্লাস শেষে প্রতিদিন বিকাল-সন্ধ্যায় অফিসে এসে মধ্যরাত পযন্ত লেগে থাকলে তো আর মফস্বল পাতার গণ্ডির মধ্যে থাকা যায় না! এক পাশে বসে বাঘাবাঘা মানুষদের কাজ দেখি। প্রেস রিলিজ টাইপ করি। মাঝেমাঝে বিশাল বারান্দায় গিয়ে সে আমলের খোলামেলা ঢাকার রাতের আকাশের উন্মুক্ত দিগন্তের অনেকটুকুই দেখে আসি। মাঝরাতের আগে আগে এক্সিকিউটিভ এডিটর আমানুল্লাহ কবীর এক পাশে হাসানুজ্জামান চৌধুরী এবং আরেক পাশে অরুণাভ সরকারকে নিয়ে পেজ মেকাপ দেন।
তখন কম্পিউটার পুরোপুরি আসেনি। কিছু কিছু হেডিং ফটো কম্পোজে হতো বটে। দীর্ঘ সময় শেষে মেকাপ করে প্লেট প্রেসে পাঠিয়ে সবাই বেরিয়ে গেলে আমিও অফিসের কোনও একটি বেবি ট্যাক্সিতে গাবতলি এসে নাইটকোচে সাভার পৌঁছাই। কখনো আরও অপেক্ষা করে প্রথম ছাপানো কাগজ হাতেই ফিরি। রাত ১টার মধ্যে পরের দিনের কাগজ হাতে পাওয়ার বিস্ময়কর চমক এখন আর লভ্য নয়।
সেইসব দিনে হাসানুজ্জামান খানের সঙ্গে নিবিড়তা বাড়ে। তিনি বিকেলের আগে আগেই চলে আসতেন। যেতেন সবার পরে। ফলে তিনি আমার আসা-যাওয়ার পুরোটাই খেয়াল করতেন। অন্যরা, যেমন ফজলে রশীদ, কাজী মন্টু, মোয়াজ্জেম হোসেন, আফজাল এইচ খান এমন আরও অনেকের সঙ্গে কাজের সূত্রে যোগাযোগ হলেও আমার মনে হতো হাসান ভাই যেনবা সবচেয়ে বেশিই অফিসে থাকেন। কখনো দিনের বেলা এসেও তাকে দেখেছি। কাজের ক্ষেত্রটিই ছিল তার ধ্যান ও জ্ঞান।
হাসানুজ্জামান খান ছিলেন মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের অধিবাসী। কথা বলতেন একটু জড়িয়ে। কারও কোনও ভুল চোখে পড়লে বা বিরক্ত হয়ে যখন কথা বললেন, তখন মনে হতো তোতলাচ্ছেন। শিরোনাম দেওয়া বা এডিটিং-এর সময় চমৎকার ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করে নিউজ বা ফিচারকে অসাধারণ করে তুলতেন। কখনো আমার কপি দেখে ধরিয়ে দিতেন: ‘এই শব্দের বদলে ওই শব্দ দিন’। কিংবা বলতেন, ‘লাইনটিকে এভাবে সাজান। ’
তিনি সম্ভবত সবাইকে ‘আপনি’ করে বলতেন। ‘তুমি’ করে কাউকে ডেকেছেন, এমনটি মনে পড়ে না। শুধু আমাকেই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টার নাজমুল আশরাফ কিংবা অফিসের জুনিয়র রিপোর্টার, সাব-এডিটরদেরও তালিম দিতেন তিনি। সম্পাদনা সহকারী-প্রুফ রিডাররা কিছুক্ষণ পর পরেই এটা-ওটা বোঝার জন্য তাঁর শরণাপন্ন হতেন।
দীর্ঘকাল হাসান ভাই ইত্তেফাক ভবনের নিউ নেশনে কাজ করেছেন। পত্রিকাটিতে তার চেয়ে দীর্ঘ সময় অন্য কোনও সাংবাদিক ছিলেন বলে আমার মনে হয় না। অন্য কোথাও, যেমন, ইনডিপেন্ডেন্ট ইত্যাদি পত্রিকায় চলে গেলেও কিছুদিন পরেই তিনি সেই নিউ নেশনেই ফিরে আসেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেওয়ার পরেও আমি মাঝেমাঝে ইত্তেফাক ভবনে এলে হাসান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। স্নেহভরে বসিয়ে অনেক কথা বলেছেন। চা খাইয়েছেন। পরামর্শ দিয়েছেন। উপরে স্বল্পবাক ও মেজাজী মানুষ বলে মনে হলেও তিনি ছিলেন এক দরদী মনের অধিকারী। ব্যক্তিগত-মানবিক সম্পর্ক ও সহকর্মীদের সম্মান ও মর্যাদা দিতেন। পেশাগত নৈপুণ্যে সাংবাদিকতাকে সার্বক্ষণিকভাবে ও দায়িত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। এই ধরনের চরিত্র সাংবাদিকতার জগতে খুব বেশি আসে না।
বহু বছর দেখা না হলেও, জানতাম তিনি অসুস্থ। বয়সও হয়েছিল প্রায় ৭০ বছর। অকস্মাৎ তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করছি। রবিবার (৭ জানুয়ারি) রাত ৯টার দিকে তাঁর মৃত্যুর খবরটি পেয়েছি পরের দিন সোমবার (৮ জানুয়ারি) সকালে। চট্টগ্রাম থেকে আমি তাঁর জানাজায় অংশ নিতে পারবো না। শেষ দেখাটিও আর সম্ভব হলো না। তবু এক জীবনের অভিজ্ঞতায় মনে থাকার মতো অল্প কিছু প্রিয় মানুষের সারিতে হাসান ভাই অবশ্যই রয়ে যাবেন। তাঁর অনন্ত প্রস্থান শান্তিময় হোক। তাঁর বিদেহী আত্মার চিরকল্যাণ হোক।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৮
এমপি/জেএম