বাংলাদেশের ধ্যান-ধারণা এবং ভাষা-সংস্কৃতির প্রসারে লক্ষ্য করা যাচ্ছে দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ। সুদূর ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে বাংলায় পত্র-পত্রিকা বের হচ্ছে।
বাংলাভাষী মানুষেরা যেখানেই আছেন, অবধারিতভাবেই সেখানে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন। অঞ্চলভিত্তিক সেসব সংগঠনে কখনও কখনও কোন্দল বা দলাদলির খবর রটলেও ভালো কাজও কিছু হচ্ছে। বাংলাদেশের নানা জাতীয় দিবস উদযাপন, ঋতু বা পার্বণ উদযাপন ইত্যাদি দেশজ সংস্কৃতির পুষ্টিবর্ধক কাজ। প্রবাসী সমাজের নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসারে এসব সাংগঠনিক ভূমিকাকে অস্বীকার করা উচিত নয়। কারণ সরকারিভাবে কেবল দূতাবাসের মাধ্যমে বিশাল সংখ্যক মানুষকে ভাষা-সংস্কৃতির প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত রাখা প্রায়-অসম্ভব।
প্রবাসের জীবন-যাপনে আজকের বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বজুড়ে অজস্র নরগোষ্ঠীর ঐতিহ্য সংস্কৃতির পাশাপাশি আপন অস্তিত্বের প্রসারণ ঘটিয়ে নিজ জাতিসত্তার রক্ষণাবেক্ষণ একটি অতীব জরুরি কাজ। সেজন্যই নানাভাবে অগ্রসর প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে বাংলার ঐতিহ্য, ভাষা ও সমাজ-সংস্কৃতির মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার সচেতন অভিপ্রায়ও লক্ষণীয়। এভাবেই সুদূর প্রবাসে নিজ ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের নানা দেশে বাংলাদেশি সংগঠনগুলোর চমৎকার সাংস্কৃতিক তৎপরতার খবর আশার সঞ্চার করে। প্রবাসে বাংলাভাষার চর্চা গৃহকেন্দ্রিক জীবনের বাইরে সম্প্রসারণের জন্য, সত্তার স্বাতন্ত্র্যকে অক্ষুণ্ন রেখে বিকশিত করার জন্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গড়ে তোলা হয়েছে নানা ক্যাটাগরির বাংলাদেশি সংঘ।
দৃষ্টান্তস্বরূপ সাউথ অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশি কমিউনিটি অর্গানাইজেশন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব হংকং। দ্য বাংলাদেশি কানাডিয়ান কমিউনিটি সারভিসেস, টরন্টো অন্টারিও। বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন অব বাহরাইন ও জার্মানির বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদি। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব অঙ্গরাজ্যেই বাংলাদেশিরা গড়ে তুলেছেন অঞ্চলনির্ভর ছোট ছোট সোশ্যাল কমিউনিটি। ফলে বিরূপ সমাজ, ভাষা ও মানবসমুদ্রে বাংলাভাষীরা সহজেই খুঁজে পান একখণ্ড সবুজ-শ্যামল-রক্তিম বাংলাদেশ।
চর্চা ও প্রসারের পাশাপাশি ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে বুদ্ধির দীপ্তিকে নিরন্তর সৃষ্টিকার্যে নিয়োজিত করতে না পারলে জীবনকে গভীরভাবে স্পর্শ করার উপলব্ধি হ্রাস পায়। সম্ভবত এজন্যই বাংলাদেশিরা মাতৃভাষায় চিন্তাভাবনা আর স্বপ্নকল্পনাকে রূপদানের জন্য ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় প্রকাশনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রিন্টেড ভার্সনসহ ইলেক্ট্রোনিক ও অনলাইন ভার্সনে বাংলা সংবাদপত্র, সংবাদ ম্যাগাজিন, সাহিত্য ম্যাগাজিন, চ্যানেল, সাইট কিংবা প্রযুক্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞান বিষয়ক ম্যাগাজিনগুলো বাংলাভাষায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বলেও তথ্য রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবেও ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক উদ্যোগগুলো সফল হচ্ছে। ফলে মাতৃভাষায় বিবিধ বিষয়ে নিরন্তর চর্চা করে সুদূর প্রবাসেও জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন লেখকগোষ্ঠী।
এসবের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘ফোবানা’র কথাও। উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশিদের সমন্বিত উদ্যোগে কয়েক বছরের সফল প্রচেষ্টায় বাস্তবতা ও ধারাবাহিকতা পেয়েছে ‘ফোবানার’ মতো (ফেডারেশন অফ বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা) একটি মহাসম্মেলন। যেখানে বিপুল জনসমাগমে উত্তর আমেরিকার প্রধান বঙ্গ সম্মেলনের রেশ তৈরি হয়। তিনদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয় স্বদেশ থেকে আগত প্রকাশকদের বইমেলা। সামাজিক সম্মিলনে প্রবাসী ও বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আসা শিল্পীদের নৃত্য, গীত, নাটক পরিবেশনে উপভোগ্য হয়ে ওঠে সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রবাসী কিংবা আমন্ত্রিত স্বদেশি কবি-সাহিত্যিকরাও এখানে সাহিত্যপাঠের আসর জমান। প্রদর্শিত হয় সুবিখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্র। প্রকাশিত হয় সব অঙ্গরাজ্য থেকে সংগৃহীত লেখকগোষ্ঠীর রচনার সমন্বয়ে ভারী আকারের বিজ্ঞাপনবোঝাই বাংলা হরফের ম্যাগাজিন। শাড়ি, জুয়েলারি, বাংলাদেশি খাবারের বিভিন্ন স্টলের পরিবেশে, বাস্তব অর্থেই ক’দিনের জন্য ‘ফোবানা’ সম্মেলন মুখরিত হয়ে ওঠে প্রিয় মাতৃভূমির পরিমণ্ডলের স্পর্শ পেয়ে। যার মূল প্রেরণাই হলো বাংলাভাষা আর সংস্কৃতি।
অবশ্য প্রবাসের বাংলাভাষার চর্চা কেবল যে প্রবাসীরাই করছেন, তা নয়। বাংলাদেশ থেকেও প্রবাসীদের বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ‘প্রবাসে বাংলাদেশ’ নামের আলাদা বিভাগে ভাষা, শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ উন্মোচিত করেছে বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের জন্য। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সব বয়সের নারী-পুরুষই নিজ অন্তরের সুখ-দুঃখের অনুভব, প্রবাসজীবনের তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতা কিংবা স্বদেশের স্মৃতিচারণে বাংলাভাষার চর্চার অনাবিল উদ্দীপনা পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮
এমপি/জেএম