’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু’ কার্যালয়ে চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে আমার সভাপতিত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুর রউফ (প্রয়াত) ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী; ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক (প্রয়াত) ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা; ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহ; এবং ডাকসু’র জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী এবং আমি-ডাকসু’র ভিপি হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি।
ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি গণআন্দোলন-গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় গণঅভ্যুত্থান। ২৪ জানুয়ারির গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ১১ দফার প্রতি ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীসহ বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলাম। এরই প্রতিফলন দেখতে পাই আমাদের ঘোষণার স্বতঃস্ফূর্ত বাস্তবায়নে। আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম গুলিস্তানে-এখন যেখানে মহানগর নাট্যমঞ্চ তার পাশের পার্কটির নাম হবে শহীদ মতিউরের নামে, ‘শহীদ মতিউর পার্ক’; যেটি ছিল আইয়ুব গেট, সেটির নামকরণ করেছি শহীদ আসাদের নামে, ‘আসাদ গেট’; আর দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ঘোষিত আইয়ুব নগরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়, বাংলার কৃষক দরদী নেতা শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজুলর হকের নামে, ‘শেরেবাংলা নগর’। মুক্তিকামী বিক্ষুব্ধ জনতা স্বতস্ফূর্তভাবে নামগুলো পাল্টে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। পরম শ্রদ্ধাভরে সেই স্থানগুলোতে শহীদদের নামাঙ্কিত নামফলক স্থাপন করা হয়। দেশের সর্বত্র সর্বব্যাপী গণবিক্ষোভ এমন ছিল যে, স্বৈরশাসক ভীত হয়ে ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি সান্ধ্য আইন বলবৎ রাখে। ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে দেশের সর্বত্র গণবিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান বেতার ভাষণে রাজনৈতিক সমাঝোতার কথা বলেন। রাজনৈতিক নেতাদের কারাগারে রেখে এবং ১১ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোনো সমঝোতা হবে না পরিষ্কার জানিয়ে দিয়ে আমরা আইয়ুব খানের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করি।
৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন এবং এক সংবাদ সম্মেলনে দেশরক্ষা আইন ও অর্ডিন্যান্সের প্রয়োগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আমাদের ১১ দফা দাবির ২ নম্বর দফাটি ছিল, ‘প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক্ স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ওপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে। ’ এই দাবির একাংশ মেনে নিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক-এর ছাপাখানা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের ওপর থেকে স্বৈরশাসক আরোপিত বাজেয়াপ্ত আদেশ এবং দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে শহীদ আসাদ-মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীর-সার্জেন্ট জহুরুল হক-ড. শামসুজ্জোহাসহ সকল শহীদের রক্তের শপথ নিয়ে বলেছিলাম, ‘এই রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেবো না। ’ শহীদের আত্মদান বৃথা যায়নি। পরবর্তী ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে। তাদের আত্মত্যাগের ধারাবাহিকতায় আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
’৬৯-এর ৯ ফেব্রুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন এবং আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন। পল্টনে জীবনের প্রথম জনসভা। এদিনেই আমরা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দশজন ছাত্রনেতা লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে ‘জীবনের বিনিময়ে ১১ দফা দাবি আদায়ের শপথ গ্রহণ’ করি। ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ‘শপথ দিবস’ পালিত হয়। জনসভাতো নয়, যেন বিশাল এক গণমহাসমুদ্র! চারদিক কানায় কানায় পরিপূর্ণ। তিলধারণের ঠাঁই নেই। সেদিনের সুবিশাল পল্টন ময়দান সংগ্রামী জনতাকে ধারণ করতে পারেনি। কাজ বন্ধ রেখে দাবি আদায়ে কারখানার শ্রমিক, মেহনতি কৃষক, নৌকার মাঝি, জেলে, কামার-কুমার-তাঁতী, ছাত্র, অফিসের কেরানী, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী- সবাই জনসভায় ছুটে এসেছে প্রাণের টানে। মানুষ ঠাঁই নিয়েছে স্টেডিয়ামের দোতলা-তিনতলার বারান্দায়, কার্নিশে। যে যেখানে পেরেছে স্থান করে নিয়েছে। গণতরঙ্গে উত্তাল বিশাল সেই জনসভায় আগত জনসাধারণ ছিল শৃঙ্খলাবদ্ধ। তাদের মুখে ছিল স্বাধিকারের দৃপ্ত স্লোগান আর চোখ ছিল দুর্জয় সঙ্কল্পে অটল। সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যপট এখনো আমার স্মৃতিতে অম্লান। পল্টনের সেই জনসমুদ্রে শিল্পী অজিত রায়ের ভরাট কণ্ঠে যখন গীত হলো, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’, তখন জনতরঙ্গে যে ঢেউ উঠেছিল তা অভূতপূর্ব। সে দৃশ্য কোনোদিন ভুলবার নয়!
সেটি এমন একটি দিন, যে দিনে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এটি এক বিরল ঘটনা। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেদিন ডাকসু’র ভিপি হিসেবে যথাযথ ভূমিকা পালন করবার। সেদিনের শপথ দিবসের সভায় দেশের বিভিন্নমুখী সমস্যার উল্লেখ করে, ঐতিহাসিক ১১ দফা ব্যাখ্যা করে, ছাত্রদের রাজনীতি করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে, আইয়ুব খান প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠক প্রশ্নে ছাত্রসমাজের অভিমত ব্যাখ্যা করে দশজন ছাত্রনেতার প্রত্যেকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল, ‘অবিলম্বে আইয়ুব খানের পদত্যাগ, বর্তমান শাসনতন্ত্র বাতিল, রাজবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি এবং ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি সম্পূর্ণ নূতন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ভোটে গণপরিষদ গঠন। ’
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক এবং সভার সভাপতি হিসেবে পিন-পতন নীরবতার মধ্যে একটানা ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করি। সেদিনের বক্তৃতায় যা বলেছিলাম দৈনিক ইত্তেফাকের পাতা থেকে তার কিয়দংশ আজ পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি, ‘প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত আলোচনা বৈঠকের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য ছাত্র-জনতার কতিপয় দাবি আদায়ে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের আহ্বান জানাই। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের পত্রিকা ‘ইত্তেফাক’কে আমরা ছিনিয়ে এনেছি। দেশরক্ষা আইনের প্রয়োগ বন্ধ করেছি। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কারাগার হতে মুক্তি পেতে শুরু করেছে। এ দেশের যে নেতা জন্মের পর হতে বাংলার মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন, সেই প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। ছাত্র-জনতার দাবি-দাওয়া যদি পূরণ না করা হয়, শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দির যদি মুক্তি দেওয়া না হয়, তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটবে। সমগ্র পাকিস্তানে জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন বাঙালি। অতএব, আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান রচিত গ্রন্থ ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার’ গ্রন্থটি বাংলার কোনো ঘরে যেন না থাকে। রাজনীতির অর্থ যদি হয় শ্রমিক-কৃষকের অধিকার নস্যাৎ করা, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করা, ছাত্রসমাজ সেই রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু রাজনীতির অর্থ যদি হয়, দেশের ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নূতন সমাজ গঠন করা-ছাত্রসমাজ সেই রাজনীতি অবশ্যই করবে। ছাত্রদের ১১ দফা এই দৃষ্টিতেই প্রণীত হয়েছে এবং এই ১১ দফা কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তি সনদ। আমরা শিল্পপতি-জমিদারের ছেলে নই, আমরা কৃষক-মজুর-মধ্যবিত্তের সন্তান। আমাদের মাতাপিতার যদি অধিক ট্যাক্স দিতে হয়, তারা যদি পাটের ন্যায্য মূল্য না পান, তাহলে আমাদের পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছাত্রদের পড়াশোনার সাথে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বিচ্ছিন্ন নয়। পূর্ব বাংলার মানুষ বিশ্বাসঘাতকতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। জনকল্যাণের রাজনীতিই তাদের ধর্ম। গরিব ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য ঢাকার জগন্নাথ কলেজ, বরিশালের বিএম কলেজ, খুলনার বিএল কলেজ প্রভৃতিসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকার প্রাদেশিকীকরণ করেছেন। ভবিষ্যৎ বংশধরদের মনে বিষ ছড়াবার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ানো হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে কোন কিন্ডারগার্টেন এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুল রাখা চলবে না। যেসব বেসরকারি কলেজ সরকারি কলেজে পরিণত হয়েছে সেগুলিকে পুনরায় বেসরকারি মর্যাদায় ফিরিয়ে দিয়ে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের সমানাধিকার দিতে হবে। মিল মালিকদের হুঁশিয়ার করে বলছি, নিজেদের ভাগ্য গড়ার সঙ্গে সঙ্গে অচিরেই তারা যেন শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক দানের ব্যবস্থা করেন। যাতে ভবিষ্যতে তারা আর নিজেদের ফরিয়াদ জানাতে ছাত্রদের কাছে ধর্ণা দিতে বাধ্য না হয়। অন্যথায় দেশের ছাত্রসমাজ তাদের ক্ষমা করবে না। ’
বক্তৃতার শেষে সমবেত জনতার তুমুল গর্জনের সঙ্গে বজ্রকণ্ঠে স্লোগান তুলি, ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করবো; শপথ নিলাম শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করবো। ’ ৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণআন্দোলন সমগ্র জাতিকে উজ্জীবিত করে ৯ ফেব্রুয়ারি এক মোহনায় শামিল করেছিল। ভাবতে আজ কতো ভালো লাগে ঐতিহাসিক শপথ দিবসের এই স্লোগানের দু’টি লক্ষ্যই সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি। সোনার বাংলার ৩৯ জন সোনার সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে ’৬৯-এর ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করেছি। আর ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে গণরায় নিয়ে, ’৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষাধিক মানুষের সুমহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করে সেদিনের সেই শপথবাক্যের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করেছি। সেদিন পল্টনের জনসভা শেষে সংগ্রামী ছাত্র-জনতার বিক্ষুব্ধ মিছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে শ্লোগান দিতে থাকে। পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় আমরা তৎক্ষণাৎ সেখানে যাই এবং বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে শান্ত করে ইকবাল হলে (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ফিরিয়ে আনি। স্বৈরশাসকের শত উস্কানি সত্ত্বেও আমরা নৈরাজ্যের পথে যাইনি। নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আন্দোলন করেছি। নিজেদের মধ্যে মত ও পথের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আমরা সেদিন ১১ দফা দাবি আদায়ের প্রশ্নে ছিলাম ঐক্যবদ্ধ। দলীয় আদর্শ নিয়ে পরস্পরের মধ্যে মতদ্বৈততা থাকলেও আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ক ছিল চমৎকার। এক টেবিলে বসেই আহার করতাম। বিপদে-আপদে একে অপরের খবর নিতাম এবং হৃদ্যতাপূর্ণ এই সম্পর্কই ছিল আমাদের আন্দোলনের ভিত্তি। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে আমাদের সংগ্রামী ভূমিকা, কর্মসূচি পালনে নিষ্ঠা, সততা ও জনদরদী আবেদন মানুষের হৃদয়ে এতোটাই সাড়া জাগিয়েছিল যে, বাংলার মানুষ আমাদের মাথায় তুলে নিয়েছিল। ৯ ফেব্রুয়ারির শপথ দিবসের পর ১৪ ফেব্রুয়ারি ডাক-এর (ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি) মিটিংয়ে সভাপতি হিসেবে নুরুল আমীনের নাম প্রস্তাব করা হলে সংগ্রামী জনতা তা ঘৃণাভরে প্রত্যখ্যান করে আমাকে মঞ্চে তুলে নিয়েছিল।
১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে যেদিন হত্যা করা হয়, সেদিন আন্দোলন চরম উচ্চতায় উঠেছিল; ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা করে সান্ধ্য আইন জারি করা হলে বাংলার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়ার পর ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের স্বৈরশাসক তথাকথিত লৌহমানব আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আজ যখন ইতিহাসের সেই গৌরবোজ্জ্বল ৯ ফেব্রুয়ারি ‘শপথ দিবস’-এর সোনালী দিনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন ফেলে আসা সংগ্রামী দিনগুলোর জ্যোতির্ময় বৈপ্লবিক বহিঃপ্রকাশ, অনন্য-সাধারণ মনে হয়!
সংগ্রামমুখর সেই দিনগুলোর কথা এবার আরও বেশি করে মনে পড়ে। মনে পড়ার অনেক কারণ আছে। মনে হয়, আমরা বেঁচে আছি ঠিকই। কিন্তু আমাদের জীবনে এই দিনগুলোই ছিল শ্রেষ্ঠতম সময়। প্রতিনিয়তই ভাবি একদিন আমিও চলে যাবো। কিন্তু রয়ে যাবে আমাদের এসব ঐতিহাসিক কীর্তি। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুউবই সৌভাগ্যবান। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপজেলা ভোলার অবহেলিত গায়ের সন্তান আমি। সেই ছোট্টবেলায় কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। পায়ে হেঁটে স্কুলে গিয়েছি। সেই অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে এসে আজ জাতীয় রাজনীতির যে পর্যায়ে আমার অধিষ্ঠান, তা সম্ভবপর হয়েছে কেবলই গণমানুষের অপার ভালোবাসায়। সেই ’৭০-এ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছি; ৭২-এ প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব; আবার ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলে আমাকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী করেছেন। ’৯৬-এ বঙ্গবন্ধু কন্যা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করলে শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেছেন। ২০০৯-এ জাতীয় সংসদে শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছি। এরপর ২০১৩ সালে নির্বাচনকালীন সরকারে শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে, ২০১৪ সালের বিজয়ের পর বিগত ৫ বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছি। এবারের সর্বশেষ নির্বাচনে অষ্টমবারের মতো জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষের খেদমত করবার সুযোগ পেয়েছি। জীবনে যা প্রাপ্য তার সবই পেয়েছি।
যতদিন বেঁচে আছি স্মৃতির পাতায় ভেসে থাকবে ’৬৯-এর অগ্নিঝরা উত্তাল সেই দিনগুলো। যে দিনগুলো আমার মতো একজন অখ্যাত মানুষকে সারাবাংলার মানুষের কাছে পরিচিত করেছিল। পরম করুণাময়ের কাছে একটাই প্রার্থনা- আমি যেন নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কাজ করে দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে শেষজীবন কাটাতে পারি।
লেখক
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সংসদ সদস্য
ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৯
এইচএ/