একজন চিকিৎসক হিসেবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আপনার চোখে মুখে উদ্বিগ্নতা-অস্থিরতার পাশাপাশি আমরা আরও যা দেখতে পাই তা হলো- ধৈর্যহীনতা, হাসপাতালের পরিবেশের প্রতি ঘৃণা, অযাচিত কালক্ষেপণের প্রবণতা এবং সেবাপ্রদানকারীদের ওপর কোনো কারণ ছাড়াই আস্থাহীনতা।
কেন এমন হয়? কেন এমন হলো? এমনটা কি হবার কথা ছিলো?
বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে প্রতিদিন অজস্র মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
রোগী বা রোগী হিসেবে উপযুক্ত সময়ে চিকিৎসাসেবা পাওয়াটা যেমন আপনার অধিকার। ঠিক তেমনি হাসপাতালগুলো কোন সিস্টেমে চলছে, এটা জানাও কর্তব্য।
বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্থানভেদে প্রায় ৪০ থেকে ৬০ কর্মচারীর পদ শূন্য। অর্থাৎ আপনি যে হাসপাতালেই সেবা নিতে যান না কেন, সেখানে বিদ্যমান সেবা প্রদানকারী টিম আগে থেকেই অপূর্ণ এবং দুঃস্থ!
হাসপাতালে চিকিৎসক আর সেবিকার সেবা পাওয়া যেমন আপনার অধিকার, ঠিক তেমনি ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বয়, সুইপার, এমএলএসএস, বুয়া, অন্যান্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী, ওয়ার্ড মাস্টার, নিরাপত্তা প্রহরী, লিফট ম্যান, ইলেকট্রিশিয়ান, মেকানিক, রেন্ট কালেকটর, রেকর্ড কিপার, কুক, সহকারী কুক, মালীসহ অন্যান্য কর্মচারীদের সেবা পাওয়াটাও আপনার অধিকার। কিন্তু আপনি অধিকারের ফল ভোগ করবেন কীভাবে? পোস্ট আছে, লোক নেই।
এতোগুলো পোস্ট ফাঁকা থাকার পরও কিন্তু রাষ্ট্র হাসপাতাল বন্ধ রাখেনি। অথচ এতোগুলো মানুষের সেবা পাওয়ার অধিকার আপনার ছিলো।
আপনি সরকারি হাসপাতালের গেটে আসা মাত্রই আপনাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে প্রযোজ্য সেবা ইউনিটে নেবার কেউ না কেউ থাকার কথা ছিলো। রোগীকে হুইল চেয়ারে কিংবা স্ট্রেচারে করে ওয়ার্ডে নিয়ে যাবার জন্য কারো থাকার কথা ছিলো। কিন্তু রোগীকে বেড পর্যন্ত নিতে হয় স্বজনদেরই। বিনিময়ে আপনার আস্থা নষ্ট হয়, ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, বিরক্তির উদ্রেক হয় এবং হাসপাতালকে 'অনাপন' মনে হয়। এ অবস্থায় আপনাকে চিকিৎসক যতোই সুচকিৎসা দেন না কেন, ভালো লাগার কথা না। আপনার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো অনুভূতি একই হতো।
শুধু যে কর্মচারী সংকট তা কিন্তু না। বরাবরের মতো সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক সংকট তো আছেই। চিকিৎসক সংকট আছে বাংলাদেশের প্রায় ‘অধিকাংশ’ সরকারি হাসপাতালে। এর কারণ কি? কেন প্রয়োজন মতো চিকিৎসক নিয়োগ হয় না? এসব প্রশ্ন আপনাদের করতে হবে। তবে সেটা হাসপাতালে এসে না। হাসপাতালে চিকিৎসকদের কাছেই আপনারা প্রশ্ন করেন। অথচ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকদের অবদান নগণ্য।
গত ৭ বছরে মেডিকেল কলেজ থেকে জেলা হাসপাতালগুলোতে রোগীর বেড সংখ্যা ২৫০০ করা হয়েছে (তথ্যসূত্র: স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়)। একবারও কি ভেবেছেন? এ আড়াই হাজার রোগীকে সেবা দেওয়ার জন্য নতুন করে কতোগুলো পদ সৃজন করা দরকার ছিলো? যেখানে আগের থেকেই কর্মচারী থেকে চিকিৎসকদের সংখ্যা সংকট প্রহসনের পর্যায়ে চলে গেছে, সেখানে নতুন করে বৃদ্ধি করা রোগীর চাপ সরকারি হাসপাতালগুলো কীভাবে মোকাবেলা করছে!
২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩৩২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। ৩১ শয্যার হাসপাতালেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক-সেবিকা-কর্মচারী ছিলো না। সেখানে নতুন ৫১ শয্যার হাসপাতালগুলোতে কতিপয় পদ সৃজন করা হলেও পূর্ণাঙ্গ পদায়ন কখনোই করা হয়নি। আবার ৫০ শয্যার হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সেবিকার যে পদগুলো আছে তাও কি পর্যাপ্ত?
কিন্তু তারপরও আমাদের হাসপাতালগুলো থেমে নেই।
আপনাদের জন্য আমরা সরকারি হাসপাতালের দ্বার খোলা রেখেছি সব সময়। আমাদের সীমাবদ্ধতাকে আপনার চিকিৎসা সেবার পথে অন্তরায় করিনি। সপ্তাহে ৭ দিন, দিনে ২৪ ঘণ্টা, বছরে ৩৬৫ দিন... দুর্যোগে-উৎসবে, ছুটির দিনে, ঈদে-পূজায়-হরতালে আমাদের সেবা নিরবিচ্ছিন্ন ছিলো।
এটাই আমাদের ইতিহাস। এটাই আমাদের আপনার প্রতি দায়িত্ববোধ।
আপনার প্রিয়জন ব্যাথামুক্ত রাত কাটাবেন, শুধু এ জন্য আমরা রাতজাগি। সাধ্যের বাইরে গিয়ে, সুবিশাল ঝুঁকি নিয়ে আপনাদের জন্য আমরা নিরলস কাজ করে গেছি, যাচ্ছি।
আমরা কী চাই?
অল্প-একটু সহানুভূতি আর ভালোবাসা নিয়ে আপনারা সরকারি হাসপাতালগুলোতে আসুন। হাসপাতালে অনেক কিছুই নেই। হাসপাতালে অনেক অনেক সীমাবদ্ধতা থাকবে। শুধু কমতি নেই আমাদের আন্তরিকতার, পরিশ্রমের।
হাসপাতালকে 'আপন' ভাবুন। চিকিৎসক-সেবিকাদের আপনার 'পরিবার' ভাবুন। আপনার মতোই বাংলাদেশের একজন নাগরিক ভাবুন। রোগীর ভালোর জন্য আমাদের সহযোগিতা করুণ। সীমাবদ্ধতার প্রশ্নে জর্জরিত করে আমাদের কর্মযজ্ঞকে অনুগ্রহ করে কঠিন করে দেবেন না।
বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে স্বাস্থ্যখাত। কথাটা আমাদের না। কথাটা বহিঃবিশ্বের পর্যবেক্ষক ও দাতা সংস্থাগুলোর।
বাংলাদেশে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুহার ৩২০ থেকে শুধু ৩৬ এ নেমে এসেছে (সূত্র: SVRS 2015)। অন্তত আপনার পরিবারের তথা গোটা জাতির যে শিশুর মৃত্যুহার আমরাই কমিয়ে এনেছি, তার যে কোনো চিকিৎসার জন্য আপনি আমাদের উপর ভরসা করবেন না কেন?
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭১.৮ বছরে দাঁড়িয়েছে (তথ্যসূত্র: বিশ্বব্যাংক রিপোর্ট ২০১৬)। আশেপাশের দেশেরটা কেমন তা গুগলে চোখ বুলিয়ে নিন। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোরটা গুগলকে জিজ্ঞেস করুন। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আপনাদের সহযোগিতাতেই কতোটা এগিয়ে গেছে একবার অনুভব করার চেষ্টা করুন। ভারত-সিঙ্গাপুর যান আপত্তি নেই। কিন্তু বছরের পর বছর যে হেলথ সিস্টেম আপনার জন্য করে যাচ্ছে, এতোটুকু সহানুভূতি কী সেই সিস্টেম পেতে পারে না?
বিশ্বের উন্নত দেশে যে রোগগুলোর চিকিৎসা কম হয় বা হয় না, আমাদের চিকিৎসকেরা ঝুঁকি নিয়ে অবলীলায় তা করে দেখাচ্ছেন। যখন আন্তর্জাতিক বিশ্ব আমাদের সাফল্যের প্রশংসায় সিক্ত করছে, তখন আপনি দেশের নামসর্বস্ব অনলাইন পত্রিকার ‘ভুল চিকিৎসা’র নিউজ শেয়ার দিয়ে নাগরিক দায়িত্ব পালন করছেন। কার সঙ্গে প্রতারণা করছেন ভেবে দেখুন।
চিকিৎসক সংকট মোকাবেলার জন্য সরকারি হাসপাতালে আমাদের চিকিৎসকেরা কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত পরিশ্রম করছেন। এর জন্য কোনো সম্মানী/ভাতা তো দূরে থাক, ন্যূনতম 'ধন্যবাদ' কোনো মহল কোনদিন দিয়েছে আমাদের? একজন চিকিৎসক 'বিসিএস' পরীক্ষা দিয়ে রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়ে 'নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট' কিংবা পুলিশের 'এএসপি'র একই র্যাংক নিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। অথচ একই পদমর্যাদার অন্যান্যদের সঙ্গে সবার যে আচরণ, একজন সরকারি চিকিৎসকের সঙ্গে মানুষ কি একই আচরণ করছে?
বিসিএস এর সব ক্যাডারে চাকরির বয়স বাড়লেই পদোন্নতি হয়, বেতন বাড়ে, মর্যাদা বাড়ে, অতিরিক্ত সুবিধা বাড়ে। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম সরকারি চিকিৎসকেরা। তাদের পদোন্নতি হতে ডিগ্রি লাগে। মজা হলো, ডিগ্রি অর্জন করার পরও আমলাদের কৃপা না হলে পদোন্নতি হয় না। পদোন্নতি হলেও নেই কোনো অতিরিক্ত সুবিধা বা মর্যাদা। আবার ডিগ্রি করতে হলে ঢাকায় বা বিভাগীয় শহরে আসতে হয়। সেটাতেও বিপত্তি। ‘ডাক্তাররা গ্রামে থাকেন না’ বলে রব তুলে ফেলে মিডিয়ার বাবুরা। ...বলতে পারেন চিকিৎসকেরা কোন দিকে যাবে? একটি অসুস্থ সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে বুড়ো হয় আমাদের চিকিৎসকেরা। এর দায় কার? চিকিৎসকদের?
তারপরো আমরা থেমে নেই। আমাদের সেবা কার্যক্রম চলছে। অপারেশন থিয়েটারগুলোতে অজস্র সার্জারি হচ্ছে। ক্যাথ ল্যাবে এনজিওগ্রাম হচ্ছে। এন্ডোসকপি, কলোনোস্কপি হচ্ছে, রক্তের নানা ধরনের পরীক্ষা হচ্ছে, এক্সরে সিটি স্ক্যান আল্ট্রাসাউন্ড হচ্ছে। থেমে নেই কোনো কিছুই।
তাই আপনার রোগীর চিকিৎসা সেবার স্বার্থেই আপনার একটু সহানুভূতি চাই আমরা। আমরা চাই, অনাস্থা না, ক্ষোভ না, একটু 'ভালোবাসা' নিয়ে আপনারা সরকারি হাসপাতালে আসুন। যে চিকিৎসক আজ সকালে আপনার রোগীকে দেখছেন, আমরা চাই আপনি জানুন যে ওই একই চিকিৎসক হয়তো অন্য কারো প্রিয়জনের জন্য গত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন। আমরা চাই আপনার রোগীর স্বার্থে আপনি একটু কম স্বার্থপর হোন।
হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা থাকবে হয়তো। হয়তো রোগীর চাপে দিশেহারা অবস্থা হবে আমাদের। কিন্তু আপনার রোগী আমাদের হাতেই নিরাপদ। আমরাই আপনার প্রিয় মুখকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠাবো।
রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে এদেশে ডাক্তার নির্মমভাবে মার খেয়েছে অনেকবার। মানুষ যেভাবে চোর ধরে পেটায়, একই স্টাইলে চিকিৎসককে পেটানো হয়েছে। আবার রোগীর চিকিৎসা করে ফৌজদারী মামলা খেয়েও আদালতে যেতে হয়েছে। স্যোশাল মিডিয়ায় সুধীজনের অকথ্য গালি তো আমাদের নৈমিত্তিক আহার।
আমরা চাই, অন্তত বাংলাদেশের ‘একজন’ মানুষ আমাদের ডেডিকেশনটা বুঝুক। সরকারি হাসপাতালটাকে আপন ভাবুক। আমরা চাই, ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে সেই ‘একজন’ মানুষ আপনি হোন।
অন্ততপক্ষে সেই একজন মানুষ অল্প-একটু ভালোবাসা আর সহানুভূতি নিয়ে সরকারি হাসপাতালে পা রাখুক।
ব্যস, এটুকুই চাওয়া...
লেখক: রেজিস্ট্রার (৩৩ তম বিসিএস), সার্জারি বিভাগ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০১৯
এসএইচ