আমার এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য মোকসেদুল ইসলামের যুক্তিখণ্ডন তথা ইংরেজিকে কেন দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা প্রাজ্ঞোচিত হবে না, তা তুলে ধরা। মোকসেদুলের যুক্তি অনুসারে, বাংলা ইংরেজির মতো কার্যকর ভাষা নয়, যেহেতু একাডেমি, রিট, আপিল শব্দগুলো ইংরেজি থেকেই এসেছে।
ইংল্যান্ডে আইন পড়াশোনা করলেও মোকসেদুল ইসলাম এটা ওয়াকিবহাল নন যে খোদ ইংরেজি ভাষায় যত সংখ্যক ও যত শতাংশ বিদেশি ঋণ করা শব্দ রয়েছে, তা বাংলায় নেই। ৭০ শতাংশেরও বেশি ইংরেজি শব্দ বিদেশি উৎসজাত। সব আইনবিদেরই জানার কথা যে ইংরেজি ভাষার প্রায় সব আইনি পরিভাষা এসেছে ল্যাটিন ও ফরাসি থেকে।
একাডেমি, আপিল যদি বাংলা না হয়, তাহলে সেগুলো ইংরেজিও নয়। কেননা ব্যুৎপত্তিগতভাবে একাডেমি গ্রিক শব্দ, আপিল ল্যাটিন শব্দ।
বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যবশত বিদ্যমান ভাষিক অতিশুদ্ধিবাদ থেকে ঋণ করা বিদেশি শব্দ ব্যবহার পরিহার করা হয়। অথচ ঋণ করা বিদেশি শব্দের জোরেই ইংরেজি সব ক্ষেত্রে কার্যকর ভাষা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদা পাচ্ছে। তাই বিদেশি ঋণ করা শব্দ নিয়ে শুচিবায়ুতা সম্পূর্ণ অযথা। ইংরেজিতে নিত্যনতুন যে বৈজ্ঞানিক শব্দগুলো তৈরি হচ্ছে তা নেওয়া বিচিত্র সব ভাষা থেকে। যেমন, প্রোটিনের একটি শ্রেণী নেট্রিন, যা সংস্কৃত ‘নেতৃ’ ও প্রোটিনের পিণ্ডারিশব্দ।
ইংরেজির পক্ষে মোকসেদুল ইসলামের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে বাংলাদেশে সব ছাত্রছাত্রী আবশ্যিক বিষয় হিসেবে বাংলা ব্যবহার করে। দ্বিতীয়/তৃতীয় ভাষা অধ্যয়ন বিশ্বের সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রথা। দক্ষিণ কোরিয়ায়ও সব শিক্ষার্থী আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ইংরেজি অধ্যয়ন করে। বিশ্বের আরো অনেক দেশেই ইংরেজি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে অধ্যয়ন করা হয়। তাই বলে তো ইংরেজিকে দ্বিতীয় ভাষা ঘোষণার ধুয়া তোলা হয় না।
ফ্রান্সে মাত্র ৮৭ শতাংশের মাতৃভাষা ফরাসি, অথচ ফ্রান্সের একমাত্র জাতীয় ও দাপ্তরিক ভাষা ফরাসি। অন্যদিকে বাংলাদেশ একটি একভাষী জাতিরাষ্ট্র যেখানে ৯৮ শতাংশের বেশি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা।
রিটকারীর মতে, বাংলা ইংরেজির মতো উৎকৃষ্ট নয়। অথচ আধুনিক ভাষাশাস্ত্র বলে, পৃথিবীতে উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট ভাষা বলে কিছু নেই। মোকসেদুল ইসলাম যদি বাংলা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে না পারেন, তা তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ও তার ব্যক্তিগত শিক্ষার ফল।
মধ্যযুগে সব ইউরোপীয় ভাষা ল্যাটিনের চেয়ে নিকৃষ্ট ভাবা হতো। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও শিক্ষার মাধ্যম ছিল ল্যাটিন। অষ্টাদশ শতকে, ফরাসি ভাষা লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ল্যাটিনকে স্থলাভিষিক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ছায়াতলে ইংরেজি বৈশ্বিক লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা বনে যায়।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, খোদ ইংল্যান্ডে প্রায় তিন শতাব্দী ধরে রাজদরবার ও আদালতের বহিঃরঙ্গে ইংরেজি ভাষা নির্বাসিত ছিল। ১০৬৬ সালের নরমানদের আগমন থেকে শুরু করে ১৩৬২ সালের প্লিডিং ইন ইংলিশ অ্যাক্ট পর্যন্ত আদালতের সওয়াল-জবাবও ইংরেজিতে করা যেত না। সরকারি ভাষা ছিল ফরাসি। আর ধর্মের ভাষা তো সততই ল্যাটিন ছিল। ১৩৬২ সালের প্লিডিং ইন ইংলিশ অ্যাক্টেরও ৫০ বছর পর রাজা অষ্টম হেনরির শাসনামলে সব সরকারি কাজে ইংরেজি ব্যবহার শুরু হয়। ইংরেজি সরকারি ভাষা হলেও ভূতপূর্ব ফরাসি থেকে অবারিতভাবে সরকারি ও আইনি পরিভাষা নিতে ইংরেজরা কোনো কুণ্ঠা করেনি।
বাংলাদেশিদের মানসিকতা থাকলে ইংরেজি ভাষা ফরাসির স্থলাভিষিক্ত হওয়া তো দূরে থাক, হয়তো ফরাসির ছায়াতলে ইংরেজি হারিয়ে যেত। শেক্সপিয়র তার শ্রেষ্ঠ রচনা ইংরেজিতে না লিখে ফরাসিতে লিখতেন।
বর্তমানে ইংরেজি ভাষার মোট ব্যবহারকারী ১.১৩২ বিলিয়ন, যেখানে চাইনিজ ম্যান্ডারিনের মোট ব্যবহারকারী ১.১১৬। ব্লুমবার্গ বিজনেসউইকের মতে, ইংরেজির পরেই ব্যবসার জন্য সবচেয়ে উপযোগী ভাষা ম্যান্ডারিন। কয়েকশ বছর পরে ম্যান্ডারিন যে ইংরেজির স্থলাভিষিক্ত হবে না তা কে জানে? যখন আবার অনুবাদপ্রযুক্তি তরতরিয়ে এগিয়ে মানব দোভাষীর চেয়েও দ্রুতি অর্জন করছে।
মোকসেদুল ইসলাম আরো যুক্তি দিয়েছেন যে, বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা যদি বিদেশি হতে পারে, তবে ইংরেজিকে দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়? পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই পররাষ্ট্রীয় কাজে ইংরেজি ব্যবহার করে; তাই বলে কি ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা স্বীকৃতি দিতে হবে? কোরিয়া বা জাপানও তো পররাষ্ট্রীয় কাজে ইংরেজি ব্যবহার করে। কই? তারা তো ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা করেনি।
অনেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা দেয়, যা একদমই ঠিক নয়। কেননা ভারত একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র যা বাংলাদেশের চেয়ে ২২ গুণ বড়। ভারতে ২ হাজারের বেশি নৃগোষ্ঠী রয়েছে। হিন্দির বাইরে ২২টি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছে। ভারতের একক কোনো রাষ্ট্রভাষাও নেই। কাজেই ভারতের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দির আধিপত্য ঠেকাতে খোদ পশ্চিমবঙ্গে ‘বাংলা পক্ষ’ নামে একটি সংগঠন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ভাষা আন্দোলন আমাদের জন্য অতীত হলেও, ভারতে তা চলমান বাস্তবতা।
মোকসেদুল ইসলামের ইংরেজির পক্ষে যুক্তি ১৯৮৭ সালের আগের সব আইন ইংরেজিতে রচিত; তাই ইংরেজি ছাড়া আমাদের গত্যান্তর নেই। একে বলে স্ট্যাটাস ক্যুও বায়াস, অর্থাৎ সবকিছু যেমন আছে, তেমন থাক। যেহেতু মোকসেদুল ইসলাম ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংরেজিতে আইন পড়েছেন, ইংরেজিতেই তার পক্ষপাত স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলা বিনে যে সুবিচারের গর্ভপাত হচ্ছে, তার কী হবে? ইংরেজিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বর্ণজয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা করলে, বাংলা আর কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।
এমনিতেই বাংলা এখনো উচ্চশ্রেণীর কাছে অপথ্য হয়ে রয়েছে, এমতাবস্থায় ইংরেজিকে দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দিলে সমাজের উঁচুশ্রেণীর কাছে বাংলা আর জাতে উঠবে না, পাতেও উঠবে না। ইংরেজিকে দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দেওয়া হবে ভাষা আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। দেশের ১৬ কোটি মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
তাই বলে, ইংরেজি যে শিখবো না, তা নয়। আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বহুভাষিকতা কোনো বিলাসিতা নয়, প্রয়োজনীয়তা। ইংরেজি ছাড়াও অন্যান্য বিদেশি ভাষা আমাদের শিখতে হবে।
পরিশেষে, বাংলাকে পরিপূর্ণ আইন ও বিজ্ঞানের ভাষায় পরিণত করতে একটা অনুবাদ ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে হবে। খোদ সুপ্রিম কোর্টের একটি অনুবাদ বিভাগ থাকা উচিত। এমনকি জাতীয় পর্যায়ে পরিপূর্ণ ভাষানীতি প্রণয়নেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন, আইনকে অবজ্ঞা করা যায় না বলে অনেকে ইংরেজির পাশে ক্ষুদ্র ফন্টে বাংলা ব্যবহার করে, যা আরো বেশি অবমাননাকর। পরিপূর্ণ ভাষানীতি থাকলে তা হতো না।
এস এম মনিরুজ্জামান
লেখক ও গবেষক।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ০২, ২০১৯
এএ