রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জুলাই মাসে যেখানে ৩১ দিনে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ২৫৩, সেখানে আগস্টের গত ৭ দিনেই এ সংখ্যা ১৫ হাজার ৮৭৯।
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে না পারা বা এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক হুঁশিয়ারি আমলে না নেওয়া আজকের এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ, এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তারপরও আমরা যদি একটু ইতিহাস ঘাঁটি, খুব উন্নত দেশ ছাড়া ডেঙ্গুতে সবারই উল্লেখযোগ্য প্রাণহানি হয়েছে। তাই বলে আমি কোনোভাবেই এই মৃত্যুকে ছোট করে দেখছি না। আমার মনে হয় বাংলাদেশের মতো একটা ঘনবসতিপূর্ণ দেশে মৃত্যুর সংখ্যাকে এখন পর্যন্ত অনেক কমের মধ্যেই রাখতে পেরেছি আমরা।
ডেঙ্গুর বিস্তার লাভে আপনার আমার সবার হাত আছে। আমরা কতটুকু সচেতন? এমন কি এই প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরেও আমরা কতটুকু নিজের বা আশপাশের পরিচ্ছনতার কাজে হাত লাগিয়েছি? অনেকেই দায়সারা কথাবার্তা বলেছি আর সিটি কর্পোরেশনকে দুষেছি, যদিও ডেঙ্গুর প্রজনন বেশিরভাগ সময়ই আপনার আমার আবাসস্থল। আমাদের নেতারা বোঝেন না ডেঙ্গু রাজনীতির বিষয় নয়, তারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, আমাদের অফিসের সামনে ডেঙ্গুর লার্ভা ফেলে রাখা হয়েছে! কী অদ্ভুত! কোন বিষয় নিয়ে রাজনীতি করতে হবে আর কোনটা নিয়ে নয়, এটা তাদেরকে কে বোঝাবে? যদিও প্রধানমন্ত্রী দেশে আসার পর পরিস্থিতির দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে। প্রায় সব প্রতিষ্ঠান তার নিজ নিজ আঙিনা পরিষ্কারে নেমেছে। শহর-নগরে ডেঙ্গু প্রতিরোধ অভিযান জোরদার করতে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে সাড়ে ৫২ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন ওষুধ আনার প্রক্রিয়া শেষে পরীক্ষা চলছে। মোদ্দাকথা এই জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা কোনোভাবেই সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। দরকার সবার সমন্বিত চেষ্টা আর নিজের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করা।
দু’দিন আগে একটা জাতীয় দৈনিকে একজন দেশবরেণ্য লেখকের কলাম পড়ছিলাম, তিনি বেশ হতাশার সুরে লিখেছেন, আমরা এমন কেন হলাম? তার মতে আজকে কেউ আর আগের মতো অন্যের সমস্যায় এগিয়ে আসে না। আসলে ডেঙ্গু সমস্যা এত বিস্তার লাভ করতো না। এইতো ’৮৮ এর বন্যায় তারা সবাই মিলে রুটি বানিয়েছেন, এখন তিনি আর এসব দেখতে পান না জাতীয় কথাবার্তা। আমি একটা ধাক্কা খেলাম, আসলেই কি তাই? আমরা কি আসলেই এতটা স্বার্থপর হয়ে গেছি? এ প্ৰজন্ম কি শুধুই নানা ধরনের ডিভাইস-গ্যাজেটে মুখ লুকিয়ে পড়ে থাকে? তাহলে কি ফায়ারম্যান সোহেলের আত্মাহুতি মিথ্যে? কত আর বয়স হবে? ২৫ বা ২৬ বছরের টগবগে যুবক নিজেকে বিলিয়ে দিলেন আগুনে আটকে পড়াদের বের করে আনতে। এই প্রজন্মকে নিয়ে রসিকতা করার আগে আমার মনে হয় সবার একবার ঢাকার হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা দরকার। গত দু’সপ্তাহ ধরে বেশ কিছু ছাত্র ডেঙ্গু আক্রান্ত থাকায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কয়েকবার যাওয়া হয়েছে। চোখে না দেখলে আপনাদের বিশ্বাস হবে না কী অমানুষিক পরিশ্রম আমাদের চিকিৎসকরা করছেন। এক তিল জায়গাও খালি নেই হাসপাতাল দু’টিতে, কোনো কোনো বেডে একাধিক রোগী রাখতে হচ্ছে, হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ড ছাড়িয়ে সার্জারি, শিশু, নারী-পুরুষ ওয়ার্ড, লিফটের পাশে, বাথরুমের সামনে, মেঝে, সিঁড়ির গোড়ায় ও লবিতে বসানো হয়েছে নতুন বেড। এমনকি সিসিইউ, আইসিইউতে পর্যন্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য। আর এসব রোগীদের সেবা দিচ্ছেন নির্ঘুম, বিশ্রামহীন একদল ডাক্তার, বয়সে যারা অধিকাংশই তরুণ। গভীর রাতে যখন ঢাকা মেডিক্যালের লিফট বন্ধ হয়ে যায়, আমি একজন ইন্টার্ন ডাক্তারকে দেখেছি ডেঙ্গু রোগীকে সিঁড়ি দিয়ে ওঠাতে হাত লাগাতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কীভাবে এতো রোগীর সেবা দিচ্ছেন তারা সে এক বিস্ময়! অথচ এই ডাক্তারদেরই পান থেকে চুন খসলে গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করি না কেউ কেউ।
সপ্তাহখানেক আগে একদল যুবককে আমি দেখেছি ধানমণ্ডির রাস্তায় রাস্তায় প্রচারণা চালাতে। তারা মানুষকে দেখাচ্ছিল কোন কোন জায়গায় এডিস মশার সম্ভাব্য জন্ম হতে পারে। কীভাবে দিনে মাত্র পনেরো মিনিট কাজ করে এডিস মশামুক্ত থাকা সম্ভব। তারা আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিংয়ে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করছিল। স্কুলের ছাদ ও পাশের ভবনের ছাদ পরিষ্কার করে দিচ্ছিল। স্কুলের বাচ্চাদের বোঝাচ্ছিল বাসায় কীভাবে পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়। এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করতে তারা যাচ্ছেন মসজিদ, মাদ্রাসায় এমনকি বিভিন্ন হাসপাতালে। তাদের সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে কথা শুরু করলাম, জানার উদ্দেশ্য তারা কারা? কীভাবে সংগঠিত হয়েছে? অল্প কথায় যা জানলাম, তারা ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে নাগরিক উদ্যোগ’ থেকে একত্রিত হয়েছেন। নিজ উদ্যোগে ও খরচে এই মহৎ কাজটি করে চলেছেন। একেবারে তরুণ এই দলটিকে দেখে আমি আপ্লুত হয়ে ভাবছিলাম, আমরা ডেঙ্গুর কাছে হারবো না! দু’দিন পরে আমি আরও একটি দলকে পেয়েছিলাম যারা পুরোপুরি স্বেচ্ছাশ্রমে এডিস মশা নির্মূলে কাজ করছে, তাদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির নাম ইয়ুথ ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।
পাকিস্তানি ডন পত্রিকায় বছরের শুরুর দিকে বিখ্যাত পদার্থবিদ পারভেজ হুদভয়ের লেখা নিবন্ধটির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। ‘কেন পাকিস্তানের থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে’ শিরোনামের ওই লেখায় অত্যন্ত আক্ষেপ করে তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালে ‘শূন্য’ থেকে ২০১৮ সালে এসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি ডলারে। অন্যদিকে পাকিস্তানের রপ্তানি আয় দেখা যাচ্ছে আড়াই হাজার কোটি ডলারেরও কম। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাকিস্তানের চারগুণ বেশি। সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রতিটি খাতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এগিয়ে। এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার মূলে তারুণ্য আর সঠিক নেতৃত্ব! আমার বিশ্বাস এই তারুণ্যেই! যে দুর্বার গতিতে আমরা আমাদের সব বাধাকে দূর করে সামনে এগিয়ে চলেছি, একইভাবে ডেঙ্গুর মতো দুর্যোগকেও কাটিয়ে উঠবো, নির্মূল করবো। আমরা হারবো না, এ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠবোই!
লেখক
খায়ের মাহমুদ
সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৯
এইচএ/