ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

মৎস্য সেক্টরে করোনার প্রভাব ও করণীয়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০২০
মৎস্য সেক্টরে করোনার প্রভাব ও করণীয়

বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদে ভরপুর। বিগত কয়েক দশক ধরে মৎস্যচাষে অভূতপূর্ব উন্নতির কারণে আজ বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমতাবস্থায় হঠ্যাৎই করোনার প্রভাবে মৎস্য শিল্প রয়েছে চরম সংকটে। গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি চলছে। কার্যত লকডাউন হয়ে পড়েছে গোটা দেশ। এ অবস্থায় মৎস্য সেক্টরের সকল পর্যায়ের কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হচ্ছে। এ সেক্টরে করোনার প্রভাব নির্ণয়য়ের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী কিছু বিষয় চিহ্নিত করা গেছে। 

অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমছে:
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান- বিআইডিএসের এক হিসাব অনুযায়ী, করোনার প্রভাবে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ২০ মিলিয়ন জনসংখ্যা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। কর্মহীন মানুষের খাবার তালিকায় সুষম খাদ্য তো দূরের কথা বাঁচার মতো ডালভাত খাওয়াই মুশকিল হচ্ছে।

ফলশ্রুতিতে, এ ধরনের কর্মহীন জনগোষ্ঠী মাছকে তাদের খাদ্যের তালিকায় রাখতে পারছে না। এছাড়া রেস্টুরেন্ট, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় অভ্যন্তরীণ মাছের চাহিদা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর কারণেও মাছ খাওয়ার সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

রপ্তানি আদেশ বাতিল হচ্ছে:
বিশ্বব্যাপী করোনার পরিস্থিতিতে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় বন্ধ আছে এবং পৃথিবীব্যাপী লকডাউন থাকার কারণে বিদেশি ক্রেতারা তাদের ক্রয়াদেশ ধারাবাহিকভাবে বাতিল করছেন। ফলে বাজারে মাছের সরবরাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ক্রমশ মাছের দাম কমে যাচ্ছে। আমাদের বৈদেশিক আয়ের উল্লেখ্যযোগ্য উৎস চিংড়ি সেক্টরে খুবই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। একইভাবে স্বাদুপানির উৎসের মাছের রপ্তানিও উল্লেখ্যযোগ্য হ্রাস পাচ্ছে। সার্বিকভাবে ব্যাপক সম্ভাবনাময় মৎস্য সেক্টর প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

নিম্ন মূল্য:
কোভিড-১৯- এর কারণে জন্য চাষকৃত মাছ এবং চিংড়ির দাম ক্রমাগত নিম্নগামী হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লকডাউন এবং স্থানীয় ক্রেতার অপর্যাপ্ততা বাজারকে অস্থিতিশীল ও মূল্যকে হ্রাস করছে।

পরিবহন জটিলতা:
যোগাযোগ স্তব্ধ হওয়ার কারণে মৎস্য শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, খাবার, ঔষধসহ অন্যান্য দ্রব্যের পরিবহন জটিলতা দেখা যাচ্ছে। এমনকি মাছ আরোহণত্তোর বাজারে সরবরাহ এবং মাছের পোনা পরিবহন সমস্যার কারণে গোটা মৎস্য শিল্প প্রায়ই থমকে গেছে।

গ্রীষ্মকালীন পোনা মজুদ সমস্যা:
এই সময়, পুকুরে মাছ মজুদ করার সঠিক সময় যা আগামী বছরের মাছ উৎপাদনকে নিশ্চিন্ত করবে। কিন্তু এ সময়টা বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বিভিন্ন কাঁচামাল তথা অ্যাকুয়ামেডিসিন, জীবাণুনাশক, শ্রমিক স্বল্পতা, মাছের পোনা ও খাদ্য ইত্যাদির অভাবে। অন্যদিকে মাছের দাম কম হওয়ায় মাছচাষীরা মাছ বিক্রি করতে আগ্রহ পাচ্ছেন না। ফলে গ্রীষ্মকালীন মাছ মজুদ করতে দেরি হচ্ছে।

কারিগরি পরামর্শের অভাব:
অচলাবস্থার কারণে মাছ চাষীরা অভিজ্ঞ পরামর্শকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ পাচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে চাষীরা সময়োপযোগী সমস্যার সমাধান পাচ্ছে না।

করণীয়:
অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধিকরণ:
খবরের কাগজ, টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রোগপ্রতিরোধে মাছের প্রোটিনের বিভিন্ন উপকারী দিক প্রচারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ মাছের চাহিদা বৃদ্ধি করা যায়। গ্রাম পর্যায়ে, ই-মার্কেট ও খোলা জায়গায় মাছের বাজার স্থাপনের মাধ্যমে মাছ ক্রয়-বিক্রয় সুনিশ্চিত করে অভ্যন্তরীণ মাছের চাহিদা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থা সহজীকরণ:
উৎপাদনকারী ও মাছের পাইকারদের জন্য একটি সমন্বিত ইলেকট্রিক পোর্টালের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ের তথ্য সেবা কেন্দ্র ও উপজেলা ফিসারিজ অফিস যুগপৎ ভাবে সমন্বয় করতে পারে। এ সেবার মাধ্যমে উৎপাদক এবং ক্রেতার মধ্যে সহজেই সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব বলে মনে হয়।

শ্রমিকপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা:
শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে তাদেরকে পুনরায় অ্যাকুয়াকালচারের বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমিক প্রাপ্তির সহজলভ্য ও বিচরণ করানো সম্ভব। প্রয়োজনে ফার্মের মালিক শ্রমিক কার্ড সরবরাহ করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ সহজীকরণ:
সরকারি পর্যায় থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চলাচলের অনুমিতপত্র প্রদান করা যেতে পারে। যার ফলে সাধারণ চাষী সহজেই বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে তাদের সমস্যা সমাধান করতে পারে। এক্ষেত্রে জেলা মৎস্য/ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করতে পারেন।

কাঁচামালের সহজলভ্যতা:
অ্যাকুয়াকালচারের জন্য সকল ধরনের কাঁচামাল সরবরাহকারী অ্যাকুয়াফার্ম দোকানকে উন্মুক্ত রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে পরিবহন সেবা নিশ্চিত করতে হবে।

স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সহায়তা প্রদান:
অ্যাকুয়াকালচারের স্টেকহোল্ডারদের জন্য স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী সুদমুক্ত আর্থিক সহায়তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখ্য যে, মৎস্য শিল্পের মধ্যে চিংড়ি খাত আমাদের দেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ সেক্টর এমনিতেই নানাবিধ সমস্যার কারণে চিংড়ি উৎপাদন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। তাই আমি মনে করি, এ সেক্টরের সমস্যাকে সমাধানের জন্য বিশেষভাবে আর্থিক প্রণোদনা জরুরি।

লেখক: অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।