ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

জনসচেতনতা-সরকারি উদ্যোগে কমবে মৃত্যুহার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩১ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২০
জনসচেতনতা-সরকারি উদ্যোগে কমবে মৃত্যুহার

বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনায় প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা। বাংলাদেশেও ইতিমধ্যে প্রায় সতেরশ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজারের কাছাকাছি। 

এই কঠিন সময়ে বসে নেই আমরা নারী দন্ত চিকিৎসকরা। ৫০ জনের অধিক চিকিৎসক নিয়ে গঠিত একটি ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম (EMERGENCY COVID 19 MANAGEMENT BY FDSB) থেকে ২৪ ঘণ্টা করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি আমরা।

৫ শতাধিক করোনা রোগী এবং হাসপাতাল ফেরত রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হয়েছে। যার মধ্যে অনেক বয়স্ক এবং বিভিন্ন কোমরবিটি রোগীও ছিলেন। যে সকল করোনা রোগীকে আমরা ইমার্জেন্সি অবস্থায় পেয়েছি, তাদের ইমার্জেন্সিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রাপ্তিতে সহযোগিতা করেছি। সঠিক সময়ে আমরা চিকিৎসা দেওয়ায় আমাদের টিম থেকে চিকিৎসা প্রাপ্ত কোনো রোগী এখনো মারা যায়নি।  
 
করোনা মহামারিতে রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর বেশ কিছু কারণ এবং করণীয় চিহ্নিত করেছি। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসে মৃত্যুহার কমাতে জনসচেতনতায় সরকারের কাছে আমাদের কিছু প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। আশা করছি এগুলোর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে দেশে করোনা রোগীর মৃত্যুহার অনেকাংশেই কমে আসবে।
 
১. অধিকাংশ রোগী বিশ্বাস করতে চান না তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এমনটা ঘটছে। করোনা রোগীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না করতে পারলে মৃত্যুহার বেড়েই চলবে।  
করণীয়: করোনা আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো ভালো করে জেনে নিতে হবে। করোনার লক্ষণের সাথে মিলে গেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।  
প্রস্তাব: সরকারি উদ্যোগে শহরের প্রতিটা এলাকায় ঘরে ঘরে, বস্তিতে, করোনার লক্ষণ সমূহের লিফলেট বিতরণ করতে হবে। বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্টের নোটিশ বোর্ডে বাধ্যতামূলক করোনার লক্ষণের লিফলেট লাগানোর নির্দেশ প্রদান করতে হবে।  
 
২. করোনা লক্ষণ দেখা দিলেও অনেক রোগীর আরেকটু দেখি, আরেকটু সময় যাক এই মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।  
করণীয়: মনে রাখতে হবে, করোনা ভাইরাস আক্রমণের প্রথম ১৪ দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা যত দ্রুত নেবেন, ততই সুস্থ থাকার সম্ভাবনা বেশি।  
প্রস্তাব: করোনার লক্ষণ দেখা দেওয়ামাত্র চিকিৎসা নেওয়ার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে সব ধরনের গণমাধ্যমকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।  
 
৩. করোনা টেস্টে ফলস নেগেটিভ বা ফলস পজিটিভ রেজাল্ট, করোনা শনাক্তকরণ কিটের ত্রুটি, দুষ্প্রাপ্যতা এবং টেস্ট করানোর বিষয়ে অনীহা রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।  
করণীয়: করোনা টেস্টের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। লক্ষণ দেখা দিলে করোনা টেস্টের পাশাপাশি রক্তের কিছু পরীক্ষা এবং এক্সরে করে করোনা হয়েছে কিনা ধারণা নেওয়া যেতে পারে। করোনা হতে পারে বলে ধারণা হলে চিকিৎসা নেওয়া শুরু করতে হবে। করোনার পাশাপাশি ডেংগু হচ্ছে, তাই এন্টিবায়োটিক শুরুর আগে অবশ্যই ডেংগু নয় তা নিশ্চিত হতে হবে। লক্ষণ আছে কিন্তু রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে, তবুও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।  
প্রস্তাব: ত্রুটিমুক্ত করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করা, সকল ব্যক্তির জন্য সহজেই টেস্টের ব্যবস্থা করা। টেস্ট করানোর সময় রোগীর ভোগান্তি কমানোর ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে অনলাইনে সিরিয়াল নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে টেস্টের জন্য উপস্থিত থাকার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, একজন করোনা আক্রান্ত রোগী থাকলেও আমরা কেউ নিরাপদ না।  
 
৪. অনেকেই দেখা যাচ্ছে ওষুধের সঠিক ডোজ না জেনে ফার্মেসি থেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ কিনে খাচ্ছেন।  
করণীয়: করোনার লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনভাবেই ওষুধ খাওয়া যাবে না। সোশাল মিডিয়া বা টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে চিকিৎসা নিলেও লিখিত প্রেসক্রিপশন নিতে হবে। কোন মতেই ফার্মেসি থেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কিনে খাবেন না।  
প্রস্তাব: ফার্মেসিগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। টেলিমেডিসিন সেবা আরও ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী ডাক্তার যারা নিজ উদ্যোগে টেলিমেডিসিন নিয়ে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন, তাদেরকে উৎসাহ প্রদান এবং প্রয়োজনে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। হাসপাতালের বহির্বিভাগের ডাক্তারদের পর্যাপ্ত পরিমাণ সুরক্ষার ব্যবস্থা করে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়িয়ে, ফ্লু-কর্নারে চিকিৎসা দেওয়া। বিভিন্ন ছোট বড় সব হাসপাতালে ফ্লু কর্নার চালু করতে হবে।  
 
৫. করোনায় আক্রান্ত হলে অনেকেই বৃদ্ধ দাদা দাদী, নানা নানীর কাছে ছোট বাচ্চা রাখছে। বৃদ্ধদের কোমরবিটি  ডিজিস বেশি থাকে এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্যদের চেয়ে কম থাকে।
করণীয়: এক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষদের কাছে বাচ্চা না রেখে অন্য কোনো উপায় বের করতে হবে। বাসায় কেউ করোনা আক্রান্ত হলে সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
প্রস্তাব: পরিবারে কারও করোনা হলে কিভাবে সেবা দিতে হবে এসব বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।  
 
৬. পরিবারের সব সদস্য একই সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে কেউ কারো সেবা করতে পারে না।  
করণীয়: এ ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে যিনি সুস্থ তাকে দায়িত্ব নিতে হবে সকলের সেবা যত্নের। প্রতিবেশীদের সাহায্য নিতে হবে। তুলনামূলক বেশি অসুস্থ, ইমার্জেন্সি রোগী হলে তাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যরা মাস্ক এবং নিরাপদ শারীরিক দূরুত্ব মেনে চলবেন। একে অপরের মনোবল বাড়াতে হবে।  
প্রস্তাব: এমন পরিবারকে এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে খাবার, ওষুধ এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।  
 
৭. অনেকেই করোনা লক্ষণ দেখা দিলেও সামাজিকভাবে হেয়-প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে রোগের বিষয়টি প্রকাশ করে না এবং চিকিৎসাও গ্রহণ করে না।  
করণীয়: করোনায় আক্রান্ত হলে লুকানোর কিছু নেই। এখন অনেকেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই আক্রান্ত হয়েছেন মনে হলে বা করোনার লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া।  
প্রস্তাব: করোনা রোগীকে কিংবা করোনা রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিতদের যদি সামাজিকভাবে অসম্মান করা হয়, তাকে আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে করোনায় অবহেলা বিষয়ক আইন তৈরি করা।
 
৮. হাসপাতালে করোনার রোগী আছে, সেখানে গেলে রোগী আরও অসুস্থ হয়ে যাবে, এই ধারণার ফলে অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণে অনিচ্ছা পোষণ করছেন।  
করণীয়: ইমার্জেন্সি করোনা রোগীকে কোনো অবস্থাতেই ঘরে রেখে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না।
প্রস্তাব: অ্যাম্বুল্যান্স সহজলভ্য করতে হবে। হাসপাতালে ইমার্জেন্সি চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা।
 
৯. হ্যাপি হাইপোকসিয়া-রক্তে অক্সিজেনের সেচুরেশন কমে যায়, রোগী বুঝে ওঠার আগেই। করোনা হলে এমনটা হয়। তাতে রোগীর নিশ্বাসে কষ্ট হয়। অক্সিজেন সেচুরেশন ৯৫ এর নিচে হলে ইমার্জেন্সি তৈরি হয়।
করণীয়: বাসায় পালস অক্সিমিটার কিনে রাখবেন। লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি অক্সিজেন সেচুরেশন মাপতে হবে। একইসাথে নিয়মিত নিশ্বাসের ব্যায়াম করবেন। এতে মানসিক চাপ কমবে। রক্ত সঞ্চালন বাড়বে। শরীর থেকে টক্সিন বের হয়ে যাবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
প্রস্তাব: পালস অক্সিমিটারের দাম কমিয়ে সহজলভ্য করা। হ্যাপি হাইপোকসিয়ার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। এলাকাভিত্তিক হাসপাতালে অক্সিজেন গ্রহণের ব্যবস্থা করা।
 
১০. রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা করোনা চিকিৎসায় একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
করণীয়: বেশি করে পানি পান করবেন। হাঁটার অভ্যাস করবেন । ব্যায়াম করবেন নিয়মিত। আশ জাতীয় শাক সবজি খাবেন। আদা চা, দারুচিনি, আনারস, লেবু, অলিভ অয়েল, ওমেগা ৩, এইসব খাবার রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। এগুলো নিয়মিত খাবেন।  
প্রস্তাব: করোনা ভাইরাসের বিষয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান বেশি বেশি প্রচারের ব্যবস্থা করা।  
 
১১. রোগী ৫/৬ দিন পার হলেই ভাবে, সে সুস্থ হয়ে গেছে। এর ফলে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ে।
রোগীর করণীয়: করোনা ভাইরাস আক্রমণে জ্বর হয়তো অল্প সময় থাকে, তাপমাত্রা কম থাকে, কিন্তু ভেবে নেওয়া যাবে না, ভাইরাস আক্রমণ শেষ হয়ে গেছে। তাই ১৪ দিন পর্যন্ত বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। ওষুধের পাশাপাশি ঘরোয়া প্রতিকারের নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। অন্যথায় সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে, মৃত্যু ঝুঁকিও বাড়তে পারে।  
প্রস্তাব: সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে করোনা নিয়ন্ত্রণে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। জনগণ সচেতন না হলে সরকারের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমাদের সব থেকে বড় অস্ত্র হচ্ছে দেশে এতগুলো টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়া, রেডিও। বর্তমানে করোনা মহামারিতে আমাদের বিশাল গণমাধ্যম ব্যবহার জনসচেতনতা গড়ে তুলতে পারলে করোনা নিয়ন্ত্রণ এবং মৃত্যু ঝুঁকিও কমানো সম্ভব।  

লেখকবৃন্দ: EMERGENCY COVID 19 MANAGEMENT BY FDSB- এর চিকিৎসক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।