বিশ্বের সব শহরকে পেছনে ফেলে মেগাসিটি ঢাকা এখন এক নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে। করোনা মহামারিতে গোটা বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত, তখন ঢাকাবাসীর জন্য এমন সংবাদ স্বস্তি নিয়ে আসার কথা ছিল।
বৈশ্বিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন বলছে, দূষণের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে ঢাকা। এর সঙ্গে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাও।
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে বাংলাদেশ। সেই দেশের প্রধান শহরের এই বেহাল অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। যদিও এই শহরকে ঠিক করার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ ভাগ করা হয়েছিল। এতে সেবার মান বাড়েনি, কিন্তু নেতাদের ‘খাওয়ার রাস্তা’ তৈরি হয়েছে ঠিকই।
বৃষ্টি পড়লে তলিয়ে যায়, শীত এলে দূষণে ভরে ওঠে—এটাই যেন ঢাকা শহরের নিয়তি। সঙ্গে কলকারাখানর দূষণ, রাস্তাঘাট পালা করে খনন করার দূষণ, গাড়ির দূষণ, মশার উপদ্রপ—সব মিলে বসবাস অযোগ্য এক নগরীতে এখন থাকতে বাধ্য হচ্ছেন অন্তত ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ। তারা না চাইলেও এখন এই শহর ছাড়তে পারছেন না।
অস্ট্রেলিয়ার মতো একটা বিশাল দেশের জনসংখ্যা এখন মাত্র আড়াই কোটি। সেখানে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা তার প্রায় কাছাকাছি। তাই এই শহর নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, সেটা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কিন্তু এই নগরীকে বাসযোগ্য করার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য দেন, তারা কার্যকরী কোনো উদ্যোগ নেন না।
এ কারণেই দেশের বাতাসে দূষণের উপাদান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা পরিমাণের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি। এটা ধীরে ধীরে যে আরও বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরপরও যে কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে না, এতেও কোনো সংশয় থাকার কথা নয়।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বায়ু দূষণের ফলে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় ৫ বছর ৪ মাস।
সাধের শহর ঢাকায় বসবাস করা মানুষদের অবস্থা যে আরও শোচনীয়, সেটা গবেষণা করে বের করার দরকার নেই। প্রতিনিয়তই এই শহরের মানুষ ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, দূষণে আক্রান্ত রোগী দিন দিন বাড়ছে। এর ফলে এই শহরের মানুষদের আয়ু কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষমতাও যে কমছে, সেটা করোনাকালে এসে আরও বেশি বোঝা যাচ্ছে।
এই বায়ুদূষণ মোটেও হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। কেননা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর চতুর্থ কারণ এই দূষণ। দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু বায়ুদূষণে, যেখানে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। (প্রথম আলো অনলাইন, ১৯ নভেম্বর ২০২১)
পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৪ সালে ঢাকা বায়ু বিপজ্জনক ছিল ১৬৫ দিন, ২০১৫ সালে ১৭৮ দিন, ২০১৬ সালে ১৯২ দিন, ২০১৭ সালে ২১২ দিন, ২০১৮ সালে ২৩৬ দিন, ২০১৯ সালে ২৮৩ দিন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ ও ২০২১ সালের বিভিন্ন সময় বায়ুদূষণের তালিকায় প্রথম ছিল ঢাকা।
শুধু যে ঢাকার বায়ু স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ তা নয়, এর পাশের শহর গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের বায়ু অস্বাস্থ্যকর। বায়ুদূষণের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে ইটভাটা, কারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের ধুলা। সঙ্গে রয়েছে আন্তসীমান্ত বায়ুদূষণ।
এত দূষণের মধ্যেও চাকরি বা জীবিকার জন্য জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশকে এই শহরে বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। প্রতিদিন গ্রামে ফেরার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সকাল শুরু করলেও হতাশা নিয়ে রাতে এই শহরেই ঘুমাতে হয়। এটাই বিশ্বের এক নম্বর শহরের শক্তি। বিশাল জনগোষ্ঠীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে ‘টেনে ধরতে’ পারে, ‘বেঁধে রাখতে’ পারে। হয়তো একদিন এই সঙ্কট কেটে যাবে, প্রত্যাশা রাখছি।
জাকির হোসেন তমাল: সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বাংলানিউজ
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০২২