ঢাকা: বাপ-মা ছেড়েছি, দেশ ছাড়িনি, স্বাধীনতাও ছাড়বো না বলে উল্লেখ করেছেন দেশের অন্যতম প্রবীণ বামপন্থি রাজনীতিবিদ, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
বৃহস্পতিবার (০২ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, পার্বত্য চুক্তির দুই যুগ পূর্তি আজ আমাদের বিষাদ, বেদনার ভারে পালন করতে হচ্ছে। আমরাও বেশিদিন বাঁচবো না, চলে যাবো, তবে যাওয়ার আগে বিবেকের তাড়নায় কিছু অকপট সত্য বলে যাওয়া উচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম সম্পূরক, পরিপূরক শক্তি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি জুম্মো জাতিগোষ্ঠীসহ সমতলের ৫০টির বেশি জাতিগোষ্ঠী, যারা মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রংপুরের বিধু সাঁওতালরা তিন দিন ধরে রংপুরের ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে রেখেছিল, ক্যান্টনমেন্টের পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা লড়েছিল। সেই বিধু সাঁওতাল এ দেশে থাকতে পারেনি, পাশের দেশে চলে গেছে। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়কে ‘উপজাতীয়’ অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু ২৪ বছরেও তার বাস্তবায়ন হলো না। পাহাড়ের অধিবাসীরা দেশে থেকেও পরবাসী, প্রাণ ত্যাগের আগে, তারা দেশ ত্যাগের চিন্তা করছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমি আজকে একটা অশনি সংকেত দেখছি, এইভাবে দেশ চলতে পারেনা। ব্রিটিশ আমলে যা শুনি নাই, পাকিস্তান আমলে যা দেখিনি, একটি জনগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব আক্রান্ত হয়, বিধস্ত হয় ৭২টি মন্দির মণ্ডপ। শুধু বিধ্বস্ত নয়, আক্রান্ত হয়ে তারা মৃত্যুবরণ করেন, ব্যবসা বাণিজ্য গৃহ লুণ্ঠিত হয়। এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সরকারের অধীনেই ঘটলো। ওই সম্প্রদায়ের একজন মানুষ হিসেবে নয়, বাংলাদেশের একজন নিবেদিত কর্মী হিসেবে আমার বুক ভেঙে যায়, যেদিন বাপ মা এদেশ ছেড়ে চলে যায়, সেদিন বলেছিলাম, তোমরা চলে যাও, আমাকে দেশের জন্য রেখে যাও। বাপ-মা যেদিন দেশত্যাগ করেছে, সেদিন আমার চোখে পানি আসেনি, কিন্তু আজকে প্রতি মুহূর্তে চোখে পানি চলে আসে।
প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ আরও বলেন, দেশে মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরের আয়োজন হচ্ছে, কিন্তু সারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, আমার পাহাড়ি আধিবাসী, সমতলে যারা বাস করে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান শ্রমজীবী মানুষ, কৃষকের জীবনে এই ৫০ বছর পালনের কোন আবেদন আছে বলে আমার চোখে পড়েনা। তাদের কোন রাজনৈতিক দলের ওপরে আস্থা নেই। রাষ্ট্র-প্রশাসন এবং নির্বাচনের ওপর তাদের অধিকাংশ জনগণের কোনো আস্থা নেই। রাজনীতির প্রতি এত অনাস্থা অতীতে কখনও দেখি নাই। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে এখন পরিচয় দিতে আমি লজ্জা পাই। আমি লজ্জিত হই, আমার বন্ধুরা হোন কি না জানিনা।
বর্তমান দেশের পরিস্থিতিতে আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, সব পণ্যের দাম অতীতে কখনও এভাবে একসঙ্গে বাড়েনি। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। কারণ এই রাষ্ট্র রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। এই রাষ্ট্র চলে গেছে দুই নম্বর ব্যবসায়ী, আমলাদের হাতে। কিছু তথাকথিত রাজনীতিবিদের হাতে, যারা পরবর্তীতে ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছেন। এই সিন্ডিকেট রুল আজকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তুলেছে। এই সিন্ডিকেট রুল ভাঙতে হবে। আমি তাই বলবো, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাঁচাও, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা বাঁচাও। সমতা-সমান অধিকারের সমাজ আমাকে ফিরিয়ে দাও, আমি কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে চাই, বাপ-মা ছেড়েছি, দেশ ছাড়িনি, স্বাধীনতাও ছাড়বো না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (শন্তু) লারমার সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের কো-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, ব্যরিস্টার সারা হোসেন, বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১০১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০২১
আরকেআর/এমআরএ