এবার দেশেই পুকুরে চাষ করবো কোরাল আর ভেটকির মতো মাছ। এই মাছ উপকূল থেকে পৌঁছে দেবো দেশের উত্তরের জনপদে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বাংলানিউজের মুখোমুখি হয়ে দেশের মৎস্য খাত নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ।
দেশের মৎস্য খাতের উন্নয়নে ঢাকা- জাকার্তার মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধিতে সমঝোতা করতেইগত ২৬ মার্চ ইন্দোনেশিয়া আসেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ।
এ দেশের সরকারি বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক এবং মৎস সেক্টরে অগ্রগতির বিষয়গুলো সরেজমিনে দেখার ফাঁকেই সেন্ট্রাল জাকার্তায় পাঁচ তারকা ক্যাম্পেনস্কি হোটেলের কক্ষে সময় দেন প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ।
সেখানেই মৎস্য খাত নিয়ে নিজের মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা, বিশেষ করে সমুদ্র অর্থনীতির নানা সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন প্রতিমন্ত্রী।
এখানে সরকারি প্রতিনিধি দলে প্রতিমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান ও প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে প্রতিবেশী দুটি দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের উন্নয়নে সমুদ্র অর্থনীতির (ব্লু ইকোনমি) বিষয়ে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ ক্ষেত্রে যথাযথ পরিকল্পনা, উপযুক্ত জ্ঞান ও প্রযুক্তি ঘাটতি কাটিয়ে দ্রুত পরিকল্পনার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। যার অংশ হিসেবে গত বছরের নভেম্বরে আমরা মালয়েশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছি গবেষণা জাহাজ।
নারায়ণ চন্দ্র বলেন, আমাদের বছরে ৬ থেকে ৭ মাসই সমুদ্র থাকে উত্তাল। আমাদের জেলেরা সাধারণত সাগরে ১শ’ মিটারের বেশি গভীরতায় যেতে পারেন না। অথচ অন্যান্য দেশ দুই থেকে তিন হাজার ফুট গভীরতায় যাচ্ছে মৎস্য শিকারে।
যে কারণে সামুদ্রিক মাছ আহরণ, সরবরাহ, সংরক্ষণ, বিপণন ব্যবস্থাপনা আর অভিজ্ঞতা গ্রহণের নানা ক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে ইন্দোনেশিয়ায়।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, তাদের সেই দক্ষতা, কৌশল ও প্রযুক্তিকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা জানতেই এখানে আসা। আমাদের উদ্দেশ্য, সামুদ্রিক সম্পদের উৎস্য অক্ষুন্ন রেখে সঠিক ও যুগোপযোগী পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে চলা। এর মাধ্যমে মৎস্য সম্পদ যেমন বাড়বে, তেমনি আয়ও বাড়বে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার চাইছে সমুদ্র সম্পদের সম্প্রসারণ ঘটাতে। তাই এলোমেলো নয়, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে চাই আমরা। আমাদের পদক্ষেপগুলো এমনভাবে নিতে হবে যাতে সমুদ্রে সম্পদের উৎস ঠিক থাকে। উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা যাতে সম্পদ আহরণ করতে পারি।
যেমন জনপ্রিয় একটি সামুদ্রিক মাছ টোনা। টোনা খুবই কম ধরা পড়ে। সমুদ্রে এর অবস্থান কোথায়, কতটা ধরবো, তা ঠিক করতে হবে এর কতোটা রিজার্ভ আছে তার ওপর।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে কুমিল্লায় একটি জনসভায় বলেছিলেন, মাছ হবে আমাদের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাত। সেটা আজ বড় বাস্তবতা। আমরা সেটা অর্জন করেছি। বিশ্বে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ চতুর্থ। তবে আশংকার কথা হচ্ছে, দিন দিন স্বাদু পানির মাছের আবাসস্থল যে হারে কমে আসছে তাতে সামুদ্রিক মাছে নির্ভরতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, স্বাদু পানির মাছ গ্রহণে আমাদের অভ্যস্ততায় পরিবর্তন আনতে হবে। স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী সামুদ্রিক মাছ। উপকূলীয় অঞ্চলে এই অভ্যাসটা রয়েছে।
বুদ্ধিদিপ্ত জাতি গঠনে মাছ, বিশেষ করে লোনা পানির মাছের রয়েছে অধিক ভূমিকা। সামুদ্রিক মাছের অভাবে উত্তরবঙ্গে গলগন্ড রোগ দেখা গেলেও উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রবণতা কম। কারণ সামুদ্রিক মাছ মেধার বিকাশে সহায়তা করে। আয়োডিনের অভাবে যে গলগেন্ড রোগ হয়, তার প্রতিকার করে।
কিন্তু হঠাৎ করে কোরাল বা ভেটকির ওপর গুরুত্ব কেন?
উত্তরটা সোজা। কারণ দিন দিন এই মাছের চাহিদা বাড়ছে। এ মাছের কাঁটা যেমন কম, তেমনি স্পষ্ট দেখাও যায়।
স্মৃতির পাতা হাতড়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমিও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। খুলনার ডুমুরিয়ায় আমাদের গ্রামের বাড়ির ঘটনা। তখন ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি।
বড়শিতে টাকি মাছ গেঁথে পুকুর থেকে পরপর তুলে আনা হলো ৫ সের ও তিন সের ওজনের দুটি মাছ। আমাদের সেই পুকুরটিতে ছিলো লোনা পানির সংমিশ্রণ।
একটু বলে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এসে প্রতিমন্ত্রী বলেন, মেজো ছেলে সত্যজিৎ চন্দ্র মাছের চাষ করে। আগে রুই, তেলাপিয়া চাষ করতো। দু'মাস আগে বাড়ি গিয়েছি। বৌমা পাতে তুলে দিলো ভেটকি। খেতেও দারুণ সুস্বাদু।
বললো, রুই ও তেলাপিয়া সেভাবে বেড়ে না ওঠায় পুকুরে ভেটকির ২০টি পোনা ছেড়েছিলো। আট মাসেই এক একটির ওজন হয়েছে দুই কেজি। তখন থেকেই মাথায় এলো, উপকূলীয় অঞ্চলে এই মাছ চাষের সত্যিকারের সম্ভাবনা রয়েছে। উপকূলীয় সাতক্ষীরা থেকে চট্রগ্রাম পর্যন্ত এই মাছের চাষ করা যেতে পারে।
মন্ত্রী বলেন, চিংড়ি বিশেষ করে গলদার দাম পড়ে গেছে। রয়েছে সিরিঞ্জ দিয়ে জেলি প্রবেশের ভয়। তারওপর আবার রয়েছে চিংড়ি চাষে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত নানা হুমকি।
তিনি বলেন, আর আমরাই বা কেন চিংড়ির ওপর নির্ভরতা বাড়াবো। পাইকগাছায় পারসে ও কাঁকড়া এবং শান্তাহার ও ময়মনসিংহে কুচিয়া আর বাইনের ওপর কাজ চলছে। ইতিহাস থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে চাই দাঁতিনা, কাইন মাগুর, রেখা আর চিত্রার মতো সুস্বাদু মাছ।
ফলি, পাবদা, দেশি সরপুঁটি সংরক্ষণেও কাজ চলছে।
তবে ভেটকি বা কোরালের চাষ করতে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করে এগুনো যাবে না। চিংড়ির মতো হ্যাচারি করতে হবে। এর অভিনব কৌশল বা প্রযুক্তি দেখানো হলো ইন্দোনেশিয়ায়।
আগে ইলিশ নিলে জিজ্ঞেস করতো কতো দিয়ে কিনলেন। এখন এটা আর কেউ জিজ্ঞেস করে না। কেন? কারণ ইলিশের উৎপাদন বেড়ে গেছে। গত বছরও প্রায় সবার নাগালে ছিলো ইলিশ। আর এভাবেই মাছে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। -জানান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ।
** প্রবাসে ভবিষ্যত বাংলাদেশ
** ইন্দোনেশিয়ায় অনন্য বাংলাদেশকেই মেলে ধরছেন হুমায়রা
** সন্ধ্যা হতেই বাতি নেভে শাহজালালের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের
** এবার ইন্দোনেশিয়ার পথে বাংলানিউজের জাহিদ
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৭
জেডএম/