বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব নিয়ে বিস্তারিত বলেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আজমল কবীর। তার সেই দীর্ঘ আলাপচারিতার প্রথম অংশ আগেই পাঠকদের কাছে পৌছে দেওয়া হয়েছে।
বাংলানিউজ: এখন তো কূটনীতির চেহারাটাই পাল্টে যাচ্ছে। যুক্ত হচ্ছে বানিজ্য কূটনীতি। সেখানে পরিসংখ্যান বলছে ঢাকা-জাকার্তার বাণিজ্য ঘাটতি বেশ হতাশার-
আজমল কবীর: বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে আমরা কাজ করছি। ২৬ কোটি মানুষের এ দেশে ফার্মাসিউটিক্যালসে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ১২৭টি দেশে বাংলাদেশের উৎপাদিত মানসম্মত ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। সেখানে ইন্দোনেশিয়ার বাজারে আমাদের ওষুধ থাকবে না- এটা মেনে নেয়া যায় না। এখানে বাইরের ওষুধ প্রবেশে নিয়ম কানুন বেশ জটিল ও সময় সাপেক্ষ। তা সত্ত্বেও উদ্যোক্তা এগিয়ে এলে এ দেশটিও হতে পারে ওষুধের সেরা গন্তব্য।
এ ছাড়াও পাটজাত পণ্যের বিষয়েও দেশটির মানুষের বেশ আগ্রহ। তারা পরিবেশবান্ধব। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) এর সঙ্গে এখানকার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ‘কাদিন’ এর সমঝোতা সাক্ষর হয়েছে ২০০৩ সালে। জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিলকে গতিশীল করতে সর্ব প্রথম এগিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের।
তাদের এখানে এসে দেখতে হবে সম্ভাবনার দিকগুলো। খুঁজতে হবে নতুন পণ্যের বাজার। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে সব সহযোগিতার জন্য আমরা প্রস্তুত।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশ বিভিন্ন সূচকে ঈর্ষণীয় উন্নতি করছে। এখন বাংলাদেশকে কি চোখে দেখছে ইন্দোনেশিয়া?
আজমল কবীর: অবশ্যই অত্যন্ত সন্মান আর শ্রদ্ধার চোখে দেখছে। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিই। এবার দূতাবাস মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আয়োজন করেছিলো পাঁচ তারকা বড় বদুর হোটেলে।
সেখানে এসেছিলেন দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রীসহ দেশটিতে কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। দুজন মন্ত্রীর উপস্থিতিও একটি ইতিহাস।
অসুস্থতা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আর তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নত দেশ পরিচালনায় যে প্রশংসা করেছেন, তাতে ভিন্ন এক বাংলাদেশকে নতুন করে চেনার সুযোগ পেয়েছেন ভিনদেশি কূটনীতিকরা।
আরেকটি কথা বলি। বাংলাদেশে ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত পদে যিনি যোগ দিতে যাচ্ছেন, তিনি পেশাদার ও নাম করা একজন নারী কূটনীতিক। তাকে নিয়োগ দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেবার বহি:প্রকাশ দেখিয়েছে জাকার্তা।
বাংলানিউজ: প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কথা বললেন। আপনি নিজেও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য। ঢাকা তো জাকার্তা থেকে ডিফেন্স উইংস গুটিয়ে ফেলেছে বহু আগে। তাহলে প্রতিরক্ষায় দু’দেশের সস্পর্কটা ঠিক কোন পর্যায়ে?
আজমল কবীর: এমনিতেই আমাদের দূতাবাস ছোট। কাজের পরিধিও কম। খরচের বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার নানা বিবেচনায় হয়তো প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে রাখেনি। যে কারণে ঢাকাতেও ইন্দোনেশিয়া এই পদ রাখেনি। তবে আমি দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। শিগগির তিন বাহিনী প্রধানের সফরের বিষয়ে কাজ শুরু করবো।
বর্তমানে প্রতিরক্ষায় কিছু কোর্সে অংশ গ্রহণেই সীমিত রয়েছে আমাদের এ বিষয়ক সম্পর্ক। আমরা প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা বাড়াতে পারি। কারণ ইন্দোনেশিয়া ভারি যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরি করে।
আমি মনে করি, এখন সময় এসেছে, দূতাবাসে প্রতিরক্ষা অ্যাটাশের পদ পুনরায় সৃষ্টি করার। তখন হয়তো দূতাবাসের পরিধিও বাড়াতে হবে।
বাংলানিউজ: ইন্দোনেশিয়া যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম মুসলিম দেশ। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এই দুটি দেশ জাতিসংঘ এবং আরও অনেক বহুজাতীয় সংগঠনের সদস্য, বিশেষত জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কমিটি, উন্নয়নশীল ৮টি দেশ, নিরপেক্ষ আন্দোলন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং ইসলামী সমবায় সংস্থা ওআইসি এর সদস্য। তা সত্ত্বেও পারস্পারিক সম্পর্কটা কতটুকু উষ্ণ?
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের পর বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দেশ হিসেবে কিন্তু ইন্দোনেশিয়া প্রথম দিকেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
বঙ্গবন্ধুই সূচনা করেন ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ভাতৃপ্রতিম সম্পর্ক। ইন্দোনেশিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ১৯৭২ সালের ২৯ মে জাকার্তায় দূতাবাস খোলে বাংলাদেশ। তেমনিভাবে ইন্দোনেশিয়াও একই সময়ে ঢাকায় দূতাবাস খুললে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় কূটনৈতিক সম্পর্ক। আমার লক্ষ্যই হচ্ছে, জাতির জনকের কন্যার নেতৃত্বে আমরা সেই সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবো। পয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট থেকে দেশের জন্যে কাজ করবো।
বাংলানিউজ: ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আমাদের এয়ার সার্ভিস এগ্রিমেন্ট হয়েছে ১৯৯৭ সালে। তা সত্ত্বেও দু’দেশের মধ্যে সরাসরি আকাশ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সহজ যোগাযোগের বাধাটা আসলে কোথায়?
আজমল কবীর: ট্রান্সজিট প্যাসেঞ্জার হয়ে আসা যাওয়া সত্যিই খুবই কষ্টকর আর বিড়ম্বনার। এটা নিশ্চিত, আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমানের জন্যে এই পথ লাভজনক নয়। তেমনি এখানকার এয়ারলাইন্স গারুদাও আগ্রহ দেখায়নি। তবে শ্রী বিজয়া নামে বেসরকারি একটি সংস্থা ঢাকা-জাকার্তার মধ্যে সরাসরি উড়োজাহাজ চলাচলে আগ্রহ দেখিয়েছে। এটা হলে ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরে আর যাত্রা বিরতির নামে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এখন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখছে। এটা হলে সাড়ে ৫ ঘণ্টার জার্নিতে সরাসরিই উড়ে আসা যাবে।
বাংলানিউজ: গত বছরের ২ মার্চ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে জকো উইদোদো ১৬৯টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকদের এ দেশে প্রবেশে ভিসা ফ্রি সুবিধা বা অন অ্যারাইভাল সুবিধা দিচ্ছে। তবে এটার অপব্যবহার তো বাড়ছেই। এটা বহাল থাকলে তো বাংলাদেশেরই লাভ।
আজমল কবীর: এটা সত্যিই একটা বড় প্রশ্ন। আমরা নিজেরাও উদ্বিগ্ন। আমার কাছে এ বিষয়ে সরাসরি উদ্বেগ জানিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিষয়টি নিয়ে আমি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকে যদি যাচাই করা হয়, তবে এ সমস্যা অনেকটাই কেটে আসবে। তবে আদম পাচারকারিরা এই সুবিধার অপব্যবহার করায় এখানকার বিমানবন্দরে আটক হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। খবর পেয়ে আমরা ছুটে যাই। এসব ঘটনা আমার দেশের মর্যাদাকে ছোট করে। ক্ষুণ্ন করে দেশের সন্মান।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৭
জেডএম/