ঢাকা, শুক্রবার, ১১ আশ্বিন ১৪৩২, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৭

অন্যান্য

সেনা সাফল্যে খেই হারানো গুজববাজরা ফের সক্রিয়

মোস্তফা কামাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:২৯, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫
সেনা সাফল্যে খেই হারানো গুজববাজরা ফের সক্রিয় মোস্তফা কামাল

দমেও দমছে না সেনাবাহিনীকে নিয়ে গুজবকাণ্ড। বরং নির্বাচন সামনে রেখে এর আয়োজক ও এজেন্ডাধারীরা নয়া উদ্যমে সক্রিয়।

সেনাপ্রধানের সঙ্গে তাঁর পরবর্তী কয়েকজনের কল্পিত বিরোধ রচনা করা হচ্ছে। মাঠে কর্মরতদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডের মতবিরোধের  কল্পকাহিনি রটানোর মাত্রা বাড়ানো হচ্ছে।

মব দমনের পাশাপাশি গুজব ফ্যাক্টরির দিকে সেনাবাহিনীর বিশেষ নজরদারি আঁচ করে গুজববাজরা অনেকটা খেই হারিয়ে মরণকামড়ের পর্বে নেমেছে। সেনাবাহিনীকেই গুজবে-বিতর্কে ঘায়েল করতে উঠে-পড়ে লেগেছে। সেনাবাহিনীর আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু অবাধ করতে সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার নমুনা বুঝে চক্রটি চোখে অন্ধকার দেখছে। সেনাবাহিনীর এ ভূমিকা তাদের অসহ্য।

দেশের এবারের সামগ্রিক অনিবার্য পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেসি সক্ষমতা নিয়ে এখনো মাঠে থাকা তাদের কাছে বিষ হজম করার মতো। সেনাবাহিনী মাঠে থাকাতে সম্ভাব্য অনেক বিপদ থেকে দেশ রক্ষা পাওয়া তাদের কাম্য নয়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার সমান্তরালে সেনাবাহিনীর জননিরাপত্তা, অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কারসাজি রুখে দেওয়া, মিল-কারখানা সচল রাখা, রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাগুলোকে রক্ষা, সড়ক-মহাসড়ক বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার, মাদক কারবারে বাধা, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনীর দৃষ্টান্ত তারা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না।  

সেনাবাহিনী কী করছে, কী করবে- এ বার্তা চক্রবিশেষের কাছে আরো আগেই পরিষ্কার।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূসকে গুজবে বিভ্রান্ত না হতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের আহবানটি তাদের আরো ঘাবড়ে দিয়েছে। বাড়া ভাতে ছাই পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে তাদের। সরকার থেকে সেনাবাহিনীকে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ সংযুক্ত থাকার প্রস্তুতি নিতে বলা তাদের মাথায় বাজ ফেলেছে। নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু হয়েছে অনেকটা আওয়াজ ছাড়াই। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকার পরও শোআপ, হাঁকডাক বা বল প্রয়োগে না গিয়ে নিজস্ব স্টাইলে সেনাবাহিনী এই অভিযানে অংশীজন হয়েই থাকছে।

চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময় খোয়ানো ৮০ শতাংশের বেশি অস্ত্র এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ উদ্ধারের জন্য জাল ফেলা হয়েছে। মবের বিরুদ্ধে বিশেষ এবং সাঁড়াশি  অ্যাকশনের ছকও চূড়ান্ত। যেখানেই মবের তথ্য পাচ্ছে, সেখানে দ্রুত ছুটছেন সেনা সদস্যরা। শিগগিরই এতে আরো মাত্রা যোগের পরিকল্পনামাফিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত, যা একটি মহলকে যারপরনাই ঘাবড়ে দিয়েছে। গুজবের বিরুদ্ধে কিছু অ্যাকশনের পরিকল্পনার তথ্যও রয়েছে।
গুজববাজদের জন্য এটি অশনিসংকেত। তাই দিগ্বিদিক হারিয়ে সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত ও ক্ষিপ্ত করা, চটানোর নতুন জাল ফেলা হয়েছে। আশা মতো কাজ না হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ-ক্রুব্ধ। এর জেরে তাদের যত বেপরোয়াপনা। তাই যাকে-তাকে নাস্তানাবুদ করে মান-ইজ্জত ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার নতুন আয়োজন। এর মূল টার্গেট সেনাবাহিনী। আজগুবি নানা তথ্য দিয়ে রচনা-রটনা।

প্রায় প্রতিদিনই দেশে-বিদেশে দুই জায়গা থেকেই সেনাবাহিনী সম্পর্কে অসত্য, অরুচিকর, নিম্নমানের গুজবের ঢোল বাজানো। এই দুষ্কর্মে তাদের ভরসা ফেসবুকসহ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া। মূল ধারার কিছু গণমাধ্যমও এসব গুজবকে সংবাদ হিসেবে পরিবেশনের জোর চেষ্টা করছে। এতে দেশের ক্ষতি বিবেচনার বোধ হারিয়ে গেছে তাদের। নির্বাচন দোরগোড়ায় চলে আসায় এরা আরো বেপরোয়া। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও গুজব এবং এআই দিয়ে বানানো নানা কনটেন্ট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনের সময় এরা বড় ঝামেলা পাকাতে পারে বলে শঙ্কা অনেকেরই। আন্ডারগ্রাউন্ড এবং ফেক আইডি থেকে ছড়ানো গুজব কেবল সেনাবাহিনীর ইমেজ নষ্ট নয়, আসন্ন নির্বাচনের পথেও আচ্ছা রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।

এর পরও উসকানি, টিপ্পনী হজম করে ধৈর্যের চরম এক পরীক্ষা দিয়ে চলছে সেনাবাহিনী। বল প্রয়োগে না গিয়ে মাঠে কাজ করছে যথাগতিতে। অঘটনের অপেক্ষমাণরা চাচ্ছে সেনাবাহিনীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটুক। বেপরোয়া হোক। মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক সেনাবাহিনীর প্রতি। এ ক্ষেত্রে মাঠে কর্মরতদের মনোবল ভাঙা জরুরি। শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের একটা অবিশ্বাস, স্নায়ুবিরোধ দরকার। তাই নিয়মিত সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের নানা কল্পিত রচনা ছড়ানো হচ্ছে।

মাঠের এই অপতৎপরতা দৃষ্টে কয়েক জায়গায় বাজারে, মাজারে হামলা, মুক্তিযোদ্ধাদের নাজেহালের পদক্ষেপ প্রশ্নে এরই মধ্যে সেনাবাহিনী তাদের ভূমিকা স্পষ্ট করে জানান দিয়েছে সেনা সদরের ব্রিফিংয়ে। সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান, জানমালের ক্ষতিসাধন, ‘মব ভায়োলেন্স’ এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টির বিরুদ্ধে সামনে প্রয়োজনে আরো কত কঠোর হবে সেনাবাহিনী। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও স্থাপনার নিরাপত্তাসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে রুটিন কাজের পাশাপাশি এ কাজগুলোর সমান্তরালে জরুরি ছিল এমন একটি বার্তার। এর বাইরে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং বল প্রয়োগে মায়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনী সদস্যদের কাজের ভলিউমও কারো কারো জানা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজার এবারের আয়োজনও বেশ বড়। আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। সংগত কারণেই দুর্গাপূজা একটু স্পর্শকাতর।

অঘটন ঘটানোয় পটীয়সীদের কাছে একটি মৌসুম। এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনো তথ্য বা হুমকি নেই। তার পরও পূজা নির্বিঘ্নে উদযাপনে বিপুলসংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হচ্ছে। পূজার সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য একটি অ্যাপ চালু করা হয়েছে। এই অ্যাপের সহায়তায় যেকোনো ঘটনা ঘটলে তার তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তথা সরকারের কাছে পৌঁছে যাবে।  

এবার নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে পূজা হওয়ায় রাখতে হয়েছে বাড়তি সতর্কতা। দুর্গাপূজা একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও এতে কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বী নয়, অন্যান্য ধর্মের লোকজনও অংশ নেয়। নির্বাচনেও অংশ নেবে সব ধর্মের লোক। মন্দ মহলের কাছে তাই এটি ভেজাল বাধানোর মোক্ষম সময়। ফেক নিউজ, সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যার ছড়াছড়িতে কমতি নেই। দুর্গাপূজা ঘিরে বানোয়াট সংবাদ ছড়ানোর প্রবণতা অবশ্যই একটি সতর্ক বার্তা। আমাদের দেশে ৩৩ হাজারের বেশি পূজামণ্ডপ রয়েছে। এগুলোর যেকোনোটিতে সামান্য গোলমাল ঘটলেই সেটিকে বিশাল করে ছড়ানো হবে, সেটা পরিষ্কার দেশের প্রধান দল বিএনপি থেকেও দলের নেতাকর্মীদের একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। শারদীয় দুর্গাপূজা সামনে রেখে ষড়যন্ত্রকারীদের যেকোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও প্রতিরোধের প্রস্তুতি রাখার আহবান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ ক্ষেত্রেও বিশেষ ভরসার জায়গায় রয়েছে সেনাবাহিনী। চব্বিশের ৫ আগস্টের পর সাম্প্রদায়িক ভেজাল বাধানোর চেষ্টা রুখে দিয়েছে তারা। নানা ছবি, কাহিনি দিয়ে রটানো সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের কাহিনি সেই সুবাদে বাজারে খাওয়ানো যায়নি। সেনাবাহিনী মাঠ থেকে সরেনি। দুর্গাপূজার নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রস্তুতিও আছে। তাদের মাঠে থাকা মহল বিশেষের জন্য খুব কষ্টের-অপছন্দের।

সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের যে কারোরই বোধগম্য, দেশ একটি জটিল-কঠিন সময় পার করছে। যেকোনো সময় যেকোনো অজুহাতে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা একটুও থামেনি। বরং নির্বাচন সামনে রেখে তা আরো বেড়েছে। তার আগে পূজা একটি উপলক্ষ হতে পারে। তা কারো কাছে ভাবগাম্ভীর্যের, কারো কাছে মতলব হাসিলের। নির্বাচনের আগে এটি সেনাসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর জন্য একটি প্রিটেস্ট। এই প্রাক-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। তাই পূজামণ্ডপগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থেই নয়, জাতীয় ঐক্য ও সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্যও অপরিহার্য।
 
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।