লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ এবং টুমচরের কালিরচর এলাকার কৃষকরা প্রতি বছর শীতের সবজির আবাদ করেন। বিশেষ করে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, শসা, শিম, কাঁচা মরিচ, মুলাসহ বিভিন্ন সবজির চাষাবাদ করেন এ অঞ্চলের শত শত কৃষক।
বাণিজ্যিকভাবে উন্নত জাতের সবজি চাষাবাদের জন্য বরাবরই জেলার অন্যান্য এলাকার থেকেও এ অঞ্চলের কৃষকরা এগিয়ে থাকেন।
কিন্তু এবার সবজি উৎপাদনে যেন ভাটা পড়েছে। ক্ষেতে সবজির চাষাবাদ থাকলেও বাজারে ফলন তুলতে পারছেন না তারা। কারণ ক্ষেতে বাজারজাত করার উপযোগী ফলন একেবারে কম।
এর কারণ হিসেবে কৃষকরা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করছেন। গেল বছরের শেষদিকে সবজি চাষাবাদের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির তাণ্ডবে বিপর্যস্ত কৃষকরা চেষ্টা করেও এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। এবার দেখা দিয়েছে অতিমাত্রায় শীত এবং ঘন কুয়াশা। যা সবজি ক্ষেতকে কাবু করে ফেলেছে।
কৃষকরা বলছেন, নভেম্বর মাসে অসময়ের ঝড় এবং অতিবৃষ্টির কারণে ক্ষেত নষ্ট হওয়ার পর পুনরায় ক্ষেত তৈরি করতে সময় লেগেছে। শীতের সবজি উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট সময় হাতে নিয়েই চাষাবাদ শুরু করতে হয়।
কৃষকরা জানায়, অতিশীতের প্রভাবে ফলনের গ্রোথ কমে গেছে। এতে ভরা মৌসুমে তাদের ফসল-উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে লাভের বদলে লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের।
আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে কৃষকরা বার বার প্রাকৃতির দুর্যোগের মধ্যে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ ও সংশ্লিষ্টরা।
গত ১৭ নভেম্বর মেঘনা নদীর উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরে ঘূর্ণিঝড় 'মিধিলি' ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। এসময় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ওই ক্ষতির ফলে এখন হাট-বাজারে সবজির সংকট। ভরা মৌসুমেও বাজারে শীতের সবজি ব্যাপক আকারে দেখা মেলেনি। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে চলতি মৌসুমটাই যেন ব্যতিক্রম।
মিধিলির তাণ্ডবে ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে তার একটি হিসেবে করেছে কৃষি বিভাগ। এতে দেখা গেছে, জেলায় কৃষিতে ১২৮ কোটি ৮০ লাখ ৮০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমন ধান এবং শীতের সবজির। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুসারে মিধিলির আঘাত হানার আগে প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমিতে শীতের সবজির আবাদ শুরু করেন কৃষকরা। এর মধ্যে ৮৭৫ হেক্টর জমির শীতকালীন সবজি নষ্ট হয়ে যায়। সবজিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা তাদের এ ক্ষতি আর পুষিয়ে নিতে পারেননি। তবে ঝড় কাটিয়ে পুনরায় চাষাবাদ শুরু করলেও নির্দিষ্ট সময়ে ফলন তুললে পারেননি চাষিরা।
লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জ এবং টুমচর এলাকায় প্রতি শীত মৌসুমে যে সবজি উৎপাদিত হয়- তা জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য জেলাতেও পাঠানো হয়। কিন্তু এবার জেলার বাজারেও চাহিদা অনুযায়ী এখানকার সবজি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। কারণ শীতের ভরপুর মৌসুমে ফসলি ক্ষেতগুলোতে সবজির উৎপাদন হয়নি।
কৃষক, কৃষি বিভাগ ও স্থানীয়রা বলছেন, বছরের ঠিক এ সময়টাতে ক্ষেতেও প্রচুর পরিমাণে সবজির উৎপাদন হতো, আর বাজারগুলোতে শীতের সবজি ভরপুর থাকতো। কিন্তু উল্টো চিত্র হওয়ার বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। কয়েকগুণ বেশি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
লক্ষ্মীপুরের বাজারগুলোতে এবার প্রতিকেজি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা করে। কিন্তু গেল কয়েক বছর ধরে ঠিক এ সময়ে প্রতি কেজি টমেটোর খুচরা মূল্য ছিল ৮-১০ টাকা। প্রতিকেজি ফুলকপির মূল্য ছিল ১৫-২০ টাকা, এবার ৪০-৫০ টাকা। বাঁধাকপির দাম ছিল ১০-১৫ টাকা কেজি, এবার ২৫-৩০ টাকা। শিমের দাম ছিল ২০-২৫ টাকা কেজি, এবার ৫০-৬০ টাকা। মুলার কেজি ছিল ৫-১০ টাকা, এবার ৩০ টাকা। ছোট আকারের একটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার ওপরে, কিন্তু গেল বছর ২০-৩০ টাকার মধ্যে লাউ কিনতে পারতেন ক্রেতারা।
লক্ষ্মীপুর শহরের সবজি বাজার থেকে সবজি কিনতে আসা ক্রেতা ফরহাদ হোসেন বলেন, যে পরিমাণে দাম, সবজি কেনায় যায় না। ছোট আকারের একটি লাউয়ের দাম যদি একশ টাকার ওপরে হয়, তাহলে কিনবো কীভাবে? টমেটোর কেজি ৫০ টাকা। কিন্তু গেলবার ৫০ টাকা দিয়ে ৫ থেকে ৬ কেজি টমেটো কিনতে পেরেছি। এখন এক কেজি কিনতে কষ্ট হয়।
বাজারে দাম বাড়তে থাকলেও কৃষকদের যেন পোষাচ্ছে না। কৃষকরা বলছে, ফলন বেশি হলে দাম কম থাকে, তখন বাজারে চাহিদাও বেশি থাকে। আর লাভও বেশি হয়।
ভবানীগঞ্জের মিয়ার বেড়ি এলাকার কৃষক গফুর মাঝি বাংলানিউজকে বলেন, এবার ৯০ শতক জমিতে টমেটোর আবাদ করেছি। খরচ হয়েছে দুই লাখের মতো। এ সময়টায়তে ক্ষেতে প্রচুর টমেটো থাকার কথা৷ কিন্তু গাছে ফলন নেই। এ পর্যন্ত মাত্র ২৮-৩০ হাজার টাকার টমেটো বিক্রি করেছি। কিন্তু গেল বছর ৬০ শতক জমিতে টমেটো আবাদ করেও প্রচুর ফলন পেয়েছিলাম। মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় চার লাখ টাকার টমেটো বিক্রি করেছিলাম।
তিনি বলেন, বাজারে টমেটোর দাম আছে ঠিকই, কিন্তু ক্ষেতে তো ফলন নেই। বেশি ফলনে দাম কম হলেও আমাদের লাভ বেশি হয়।
একই এলাকার কৃষক মহিউদ্দিন বলেন, সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে এক একর জমিতে টমেটো আবাদ করেছি। ক্ষেতে ফলন নেই, তাই বিক্রি করতে পারছি না। কিছু কাঁচা টমেটো আছে, সেগুলো পাকেও না। শুধু আমার নয়- এ অঞ্চলের প্রত্যেক কৃষকের একই অবস্থা।
কৃষক আবদুল মালেক বলেন, এ অঞ্চলের শীতকালীন সবজি পুরো জেলায় সয়লাব থাকতো। অন্য জেলার বড় বড় পাইকারি ব্যবসায়ীরা ক্ষেতের কিনারা থেকে টনে টনে সবজি নিয়ে যেত। কিন্তু এবার ক্ষেতেই তো সবজি নেই।
লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের সবজি বিক্রেতা রিয়াজ হোসেন বলেন, আমরা নিজেরাই সবজি চাষাবাদ করে বাজারে এনে বিক্রি করি। কিন্তু এবার সবজি উৎপাদন কম। দেরিতে চারা লাগানোয় ফুলকপি আকারে বড় হয়নি। শীতের কারণে গাছে থাকা টমেটোও পাকছে না। তাই বাজারে উঠাতে পারছি না। কিন্তু বাজারে সবজির প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
কৃষকরা প্রশ্ন রেখে বলেন, ক্ষেতে ফলন থাকবে কীভাবে? কয়দিন আগে তো ঝড় এবং বৃষ্টি হলো। যখন ঝড় হয়েছে- তখন সবগুলো ক্ষেতে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, শিম, মুলা, কাঁচা মরিচসহ নানা জাতের শাক-সবজির গাছ ছিল। টমেটো গাছে ফুল ছিল। কিন্তু ঝড় সবগুলো গাছ বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। ফুল ঝরিয়ে ফেলেছে। টমেটো গাছের ডালপালা ভেঙে গেছে। টানা বৃষ্টিতে ক্ষেতে পানি জমে থাকায় গাছ সব মরে গেছে। বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। চরম ক্ষতির মুখে পড়েছি আমরা। নতুন করে আবার বীজতলা তৈরি করে চারা লাগিয়ে বাগান করতে সময় লেগেছে। আবার অনেক ক্ষেত শুকানোর আগ পর্যন্ত চারা লাগানো যায়নি। ক্ষেতগুলোতে এখন সবজির গাছ আছে, গাছে ফুলও আছে। কিন্তু এবার আবার শীত বেশি পড়েছে। শীতের কারণে টমেটো পাকে না। কুয়াশার কারণে ফুল নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে আবার বৃষ্টিও হয়েছে, অসময়ের বৃষ্টিতে টমেটোতে ফাটা দাগ পড়ে। আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে আমাদের ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়ে আমাদের খরচও দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু ফলন তুলতে পারছি না।
তারা জানান, শীতকালীন সবজি শীতের মৌসুমেই ভালো হয়। তবে শীতের পাশাপাশি রোদ থাকলে ফলন ভালো হয়। শেষ মৌসুমে ক্ষেত থেকে ফলন উঠবে। তখন আবার বাজারে চাহিদা কমে যায়, দাম পাওয়া যাবে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদকৃত কৃষকদের পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে গ্রামাঞ্চলগুলোতে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার সবজি উৎপাদন হয়নি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. জাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, গেল বছরের থেকেও এবার শীতের সবজির উৎপাদন অনেক কম। যার কারণে বাজারে দাম বেশি।
তিনি জানান, এ অঞ্চলে শীতের সবজি চাষাবাদের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কবলে পড়ে অনেক সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। কৃষকরা পুনরায় চাষাবাদ শুরু করলেও ঘন কুয়াশার কবলে পড়ে সবজি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলন আকারেও ছোট হচ্ছে।
জাকির হোসেন বলেন, জালবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অসময়ে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এর ফলে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অতিমাত্রায় শীত এবং কুয়াশাকে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব হিসেবে দেখছেন এ কৃষি কর্মকর্তা৷
বাংলাদেশ সময়: ১০০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২৪
আরএ