ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কয়েকজন না ঘুমিয়ে | রাহেল আহমেদ শানু

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৫
কয়েকজন না ঘুমিয়ে | রাহেল আহমেদ শানু

হাসপাতালের বেডে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন মালেক সাহেব। ঠিক মত ওষুধ চলছে, তবুও তার ব্যথা সারছে না।

ট্রাকটা পুব দিক থেকে না এসে যদি পশ্চিম থেকে আসত? কী হতো তাহলে? মনের ভয় আর কাটে না। ট্রাক চাপায় আহত হয়ে পনের দিন হলো তিনি হাসপাতালে। আকবার আলী সাহেব এসে গতকাল তাকে দেখে গেছেন। সঙ্গে কিছু ফল এনেছিলেন। পাশের টেবিলেই রাখা আছে ফলগুলো—তার দিকে তাকিয়ে হাসছে যেন। হাতে নিতে চাইলেও নিতে পারছেন না। নিয়েই বা কী হবে! খেতে পারবেন না। সারা মুখ-মাথায় ব্যান্ডেজ। চোখ দুটো শুধু ইঁদুরের চোখের মত বেরিয়ে আছে। ডাক্তার বলেছে, একমাস চিবিয়ে খাওয়া বন্ধ। আর খাবেই কী করে! একপাটি দাঁতও আর অবশিষ্ট নেই।

‘এখন কেমন লাগছে’—আকবার আলী সাহেব জানতে চাইলেও তিনি কোনও কথা বলতে পারেননি। শরীরের ব্যথা আর ব্যান্ডেজ, তারচেও বেশি—কথা বলতে না পারার ব্যথায় অস্থির মালেক। মনের কত কথা ভেতরে ভেতরে নড়ে যাচ্ছে। বলতে পারছেন না। কথা না কয়ে মানুষ ক্যামনে বাঁচে!

আকবার আলী মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় মালেক সাহেব শুধু চেয়ে থেকেছেন। কষ্টের তীব্রতায় ছল ছল করে তার চোখ। আর জ্বলজ্বল করে দুচোখের পানি। কথা না কয়ে মানুষ ক্যামনে বাঁচে! ইঁদুরের মত কালো দুটি চোখ শুধু নড়ে। সবাই তাকে দেখছে। কথা বলছে কিন্তু তিনি পারছেন না। ইচ্ছে থাকলেও না। বুকের ভেতরে ফাঁপরে ওঠে কথা। ডাক্তার এসে বললেন, এখন কেমন? শুনতে পাচ্ছেন?
ভেতরে ফাঁপরে ওঠে মালেক—কী করে বলব, আমি শুনতে পাচ্ছি!
ডাক্তার বললেন, কিছু খেতে ইচ্ছে করে? তরল খাবার? ওদের বলবেন। আর কোনও সমস্যা হলে নার্সদের জানাবেন। কথা বলার চেষ্টা করেন।

সারা মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ। চোখ দুটি যখন নড়ে বোঝা যায় মালেক সাহেব বেঁচে আছেন। বুকের ভেতরে তোলপাড় করে কথা। আমাকে কথা বলতে দাও। ডাক্তার, আমার খেতে ইচ্ছে করে। চিবিয়ে চিবিয়ে গরুর মত করে খেতে ইচ্ছে করে। ডাক্তার আবার বললেন, বলেন তো ক..অ.. অ..। মুখ হা করে বলেন, ক.. অ.. অ..।

‘চিৎকার করে বলছি—আমি শুনতে পাই। তোমরা যা বলো সব শুনতে পাই। আমি বলতে পারি, ক-তে কাদের মোল্লা। তুঁই রাজাকার-তুঁই রাজাকার। ক-তে কাদের মোল্লা—তুঁই রাজাকার, তুঁই রাজাকার। ডাক্তার, আমাকে কথা বলার ওষুধ দাও। আমাকে কাঁদতে দাও। আমাকে কথা বলার স্বাধীনতা দাও। মানুষ কথা না কয়ে ক্যামনে বাঁচে রে...। ’

ডাক্তার চলে গেলেন। মাথার কাছে এসে বসে তার একমাত্র ছেলে। বাবার মুখের কাছে খাবার তুলে ধরে, ‘বাবা হা করার চেষ্টা করো। মুখটা নাড়াও। একটু হা করো বাবা। তুমি কি আমার কথা শুনতে পাও?’

মালেক সাহেবের বুকের ভেতরে উথাল-পাথাল করে। আমি তোমাদের সাবার কথা শুনতে পাই। আমাকে কথা বলার ওষুধ দাও। আমার খেতে ইচ্ছে করে। সবকিছু খেতে ইচ্ছে করে। গরুর মত চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করে। উহ্! মানুষ কথা না কয়ে ক্যামনে বাঁচে রে..।

দুই.
হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন রাতে। নামাজ শেষে বিষণ্ন মনে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছেন আকবার আলী। শীতের রাতেও তার ঘরের দরজা খোলা। দুলালী বেগম বললেন, ‘আর কতক্ষণ দরজা খোলা থাকবে? শীত আসছে তো। ’
‘আসুক। মনটা তবু জুড়াক’—বলে নীরব হয়ে রইলেন। মাথার ভেতরে দুলছে, নিশ্চল মালেক হাসপাতালের খাটে শুয়ে আছে। বোবা, অচল শরীরটা শুধু বাতাস টানছে। ইঁদুরের চোখের মত কালো দুটি চোখই শুধু নড়ে। পিট পিট করে, জলে ভরা চোখ!

মাথার ভেতরে খেলছে হায়দার আলীর কথা—‘বাতাসে গা ভাসানো লোক, আপনাকে ঠকাবে। পায়ের গোড়া চিকন লোক মিথ্যাবাদী হয়। ভালো হয় না’। কী করে জানলো! মালেক চাচার সঙ্গে আমার কি শত্রুতা! ফের মাথার ভেতরে সেই শব্দ ‘তোমার মালেক নানা মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করেছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার। ’ হায়দার আলী আগেই কিভাবে জানলো! তারপর উধাও লোকটি।

বারান্দার চেয়ারটাতে হায়দার আলী নেই। তবে চেয়ারটার পাশে তার ব্যাগ রয়েছে। ব্যাগের ভেতরে তালাবদ্ধ অবস্থায় কাঠের ছোট্ট একটি বাক্স। ভেতরে রয়েছে তার অমূল্য সম্পদ, হাজারো চিঠি। বিদ্যুতের আলোয় আকবার আলীর দৃষ্টি খেলছে ব্যাগের ওপর। লোকটি হঠাৎ এলো আবার চলেও গেল।

হায়দার আলী মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারে কিভাবে? উত্তেজনায় খাট থেকে নামলেন। নিচে নেমে দাঁড়াতেই দুলালী বেগম বললেন, ‘ঠাণ্ডায় কই যাও?’ নিরুত্তর আকবার আলী। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়।

মানুষ প্রকৃতির কাছে কিছু সময়ের জন্য একান্তে আত্মসমর্পণ করে। নিজের ভেতরে যখন আস্থাহীন কিছুর উপলব্ধি জন্মে, তখন প্রকৃতিতে ফেরে। প্রকৃতির উচ্ছ্বাস আদিমতা তার মনের ভেতরে দাগ ফেলে। জলতরঙ্গ, উদাস হাওয়া ও কুয়াশার ভেতরে সমর্পিত করে তার ইচ্ছাগুলো। শরীরের অসুস্থতাজনিত আইনের বিরুদ্ধে তখন ইচ্ছেশক্তি প্রবল হয়। অবাধ্য মন তখন প্রজাপতি হয়ে ওড়ে।

বারান্দার টিন বেয়ে টপাস টপাস করে পড়ছে বৃষ্টির মত কুয়াশার জল। চাদরের নিচ থেকে ৬৩ বছরের পুরনো হাত দুখানা বের করলেন। ঠাণ্ডা কুয়াশার জলে দুহাত এগিয়ে ধরলেন সামনে। হিম হাওয়ায় নিস্তব্ধ চারদিক। টিন বেয়ে নামা ঠাণ্ডা জল তার হাতের তালুতে টপাস টপাস করে পড়ছে। কয়েক ফোঁটা পড়তেই দুহাতের তালুতে ঘসে কপালে মুছে নিলেন।

দুলালী বেগমের চোখে বিস্ময় কাটছে না। হাজারো রোগের বাস তার শরীরে। টপ টপ করে শিশির জমছে হাতের তালুতে। প্রসারিত দুটি হাতে সমর্পিত করেছেন তার ইচ্ছাগুলো। কুয়াশার জল হাতের তালুতে পড়েই ছিটকে আসছে চোখে-মুখে। যতটুকু জমে তাই ফের দুহাতের তালুতে ঘষে দুচোখে মুছে নিলেন। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে বললেন, ঈশ্বর কষ্ট পেলে প্রকৃতিতে কুয়াশা নামায়। কুয়াশা হলো ঈশ্বরের কষ্টের জল।

দুলালী বেগম অন্যরূপে আবিস্কার করছেন তার স্বামীকে। রাতের নিস্তব্ধতায় দক্ষিণা দাওয়ায় হাত বাড়িয়ে দুটি মানুষ। যেন প্রকৃতির দুই দেবশিশু নিজেদের ঢেলে আবারও খুঁজছে। আকবার আলী বললেন, ‘ঈশ্বরকে তো আমি ভেতরে লালন করি। আমার ভেতরে আমি তাকে বড় করে তুলি। তার কষ্টগুলো পুড়ছে আমার ভেতরে। আর এ জলের ফোঁটা আমার কষ্টের কথা বলছে। তাই চোখে ছুঁয়ে নিলাম। দিলু, তুমিও ছুঁয়ে দেখ, ভালো লাগবে। ’

দুলালী বেগমের বিস্ময় কাটে না। ভয়ে ভয়ে অসীম শূন্যতায় মুষ্টি খুলে বাড়ালেন দুটি হাত। বারান্দার টিন বেয়ে নামা ঠাণ্ডা জলের ফোঁটা টপাস টপাস করে পড়ছে সাদা হাতের তালুতে। বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা জল। বৃষ্টির পানির চেয়েও হালকা। চোখের পানির চেয়েও পবিত্র।

উত্তরমুখী হতেই চোখে পড়ল হায়দার আলীর পড়ে থাকা ব্যাগটা। কয়েক গজ দূরে মাটিতে পড়ে আছে। যেন তাকে টানছে। ধীরে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে দুলালী বেগম বললেন, ‘খবরদার, ওই ব্যাগে হাত দিও না। ’

‘কেন বাঘ-ভালুক আছে?’—বলেই স্ত্রীর মুখের দিকে চাইলেন। দক্ষিণ দুয়ারী সুরভীর ঘরের দরজা খোলার শব্দ হলো। দুজনে তার দিকে চাইতেই শান্ত গলায় বলল, ‘ওখানে যাই থাক, ওটা তোমার কাছে আমানত। হাত দেয়া ঠিক হবে না বাবা। ’

নিরুত্তর। নিশ্চল হয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। মানুষ বিপদে পড়লে অদ্ভুত আচরণ করে। বিশ্বাসের অবস্থানটা তখন নড়বড়ে হয়ে পড়ে। আত্মার ভেতরে ঠাকুর ঘরের শুদ্ধ ডাক তখন কানে যায় না। আবেগের বদলে আশঙ্কা নিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ ও ভঙ্গিতে কথা বলে।

নীরবে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করলেন তার সবুজ রঙের বাঁশি। ঠোঁটের ডগায় বাতাস পেতেই মধ্য রাতের নীরবতা ভেঙে পু ..উ ..উ করে বেজে উঠল সেটা। বাবারা বয়সকালে ঠিক শিশুর মত হয়ে যায়। তার দিকে তাকিয়েই সুরভী ফিক করে হেসে দিল। আকবার আলীও হেসে ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। খাটের ওপর বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুলালী বেগমকে বললেন, ‘মালেক চাচার কথা একবার ভাবো। জ্যান্ত একটা মানুষ হাসপাতালে মরার মত পড়ে আছে। জীবনের কী কষ্ট দিলু! আর হায়দার আলী হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ’

মাঝের দরজা দিয়ে সুরভী এসে বাবার কপালে হাত রেখে বলল, ‘অসুখ শরীরে আর কত, রাত অনেক হলো। এবার ঘুমাও। অন্যের কথা ভেবে অযথা কেন শরীর খারাপ করো?’

মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আমিও তাই বলি, সে আমার কে? তার জন্য কেন চিন্তা করব। কিন্তু চিন্তা যে আমাকে ছাড়ে না মা। ’

সুরভী উত্তর করল না। শুধু আড়ালে তার চোখ মুছে নিল। এরই ফাঁকে বাবার হাত থেকে চাদরটা নিয়ে পাশে গুছিয়ে রেখে সে তার ঘরে চলে গেল। মেয়ের যাওয়ায় দিকে তাকিয়ে আকবার আলী বললেন, ‘দিলু মনে পড়ে আমাদের সেই অতীত দিনের কথা?’
কেন ও কথা বলছো? দুঃখের যে অতীত গেছে, তাকে তুলে কী লাভ?
আকবার আলী বললেন, ‘অতীত যে আমার শেকড়। তাকে ছুঁড়ে ফেলে বর্তমানকে কি ভাবা যায়?’

বলতেই স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। চারদিকে নীরবতা। নিস্তব্ধতার রাত যত গভীর হয় মানুষ তত সত্যবাদী হতে থাকে। জীবন থেকে শেখা সে অভিজ্ঞতা হীরকের মত চোখের ভেতরে জ্বলে। জুনিয়র সহকর্মীকে স্যার ডাকতে হবে, এ লজ্জা ঢাকতে স্বেচ্ছায় অবসর নেয়া আকবার আলীর মুখ ফসকাতে থাকে। বুকের ভেতরে জমা দগ্ধ ইতিহাস বাতাসে ভাসে—

তিন.
সাত ভাই তিন বোনের সংসারে সবার বড় হলাম আমি। এতগুলো মানুষের পেটের ভাত জোটে না। কখনও সারাদিনে একবেলা খাই, কখনও তাও জোটে না। তিস্তা নদীর পানি খেয়ে কখনও দিন-রাত কাটে। অভাবীদের চোখে আবার ঘুম বেশি। রাতে না খেলেও বেশ ঘুম আসে। কত বছর না খেয়ে ঘুমিয়েছি, সত্যি করে বলতে পারব না দিলু। বাবার ছিল এক একর ধানী জমি, তিস্তা নদী হঠাৎ গিলে খেল। বাড়িটাও গেল পরের বছর, তিস্তার পেটে। আমাদের পেটে আর ভাত জোটে না। ক্ষুধার কী জ্বালা...।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটু থামলেন। দুচোখে টল টল করছে পানি। এরপরে বলতে থাকলেন, পরের বছর নদীর এপারে এসে খুব কষ্টে তিনটে মাত্র খড়ের ঘর তুলল বাবা। এতগুলো মানুষের রাতে ঘুমাবারও জায়গা হয় না। এরমধ্যে আল্লাহর রহমতে আমার ব্যাংকে চাকরি হলো। পছন্দ করে বাবা ছেলের বউ হিসেবে নিয়ে এলো তোমাকে। তুমি বড় ঘরের মেয়ে। নতুন বউ হয়ে যখন এলে বিয়ে কি তাও বোঝ না!

লজ্জা পেলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব দুলালী বেগম। স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, এতদিন পরে পুরনো এসব কথা বলছো কেন?

কথা কি কখনও পুরনো হয় দিলু, হয় না। তখন সংসারে হাহাকার। অনাহারে দিন আর যায় না। খেয়ে-না খেয়ে দুশ্চিন্তায় বাবা অসুস্থ হলো। বাবার অসুখের কথা শুনে এক আত্মীয় একসের রসগোল্লা নিয়ে বাড়িতে এলো। রাতে মা গোপনে আমার হাতে একটা দিয়ে বলল, খেয়ে নে। সংসারে বড় ছেলের ওপর মায়ের আলাদা একটা দরদ থাকে।

রসালো আর গোল রসগোল্লা, হাতে পেয়ে আমার বুকের ভেতরে যন্ত্রণা শুরু হলো। রাতে কুপির আলোতে রসগোল্লা হাতে নিয়ে দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে মনে হলো, আর কেউ যদি না খেয়ে থাকে? দুই মায়ের পিঠে-পিঠি আমরা অনেক ভাইবোন। সকালে ওরা যদি কেউ চায়, কিভাবে দেব? পরের দিন রসগোল্লা হাতে নিয়ে সারাদিন ঘুরি আর দেখি। খাওয়া হলো না। রাতে আবারও রসগোল্লা দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে দেখি...

ফুঁপরে কেঁদে উঠলেন আকবার আলী। মিনিট তিনেক পরে বললেন, রাতে বিড়ালে খেয়ে ফেলেছে...

পুরুষ মানুষ যখন কাঁদে, তারা সত্যি কথা বলে। সব পুরুষ কাঁদতে পারে না। কিছু পুরুষ কাঁদে বোবা কান্না। কিছু পুরুষ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, যারা পলি মাটির মত সরল। বুকের ভেতরের গোপন কথা-দগ্ধ ব্যথা সব উজাড় করে ফেলে। আর বুড়ো মানুষ কাঁদলে শিশুদের মত গাল ফুলিয়ে-ফুলিয়ে কাঁদে। বুকের গভীরে থাকা ঈশ্বরের গৃহ থেকে সে কান্নার সুর ওঠে।

দুলালী বেগমও আর স্থির থাকতে পারলেন না। হু হু করে কেঁদে উঠলেন। ঘরের ভেতরে কান্নার সুর ছাড়া আর কিছু বাজে না। মিনিট পাঁচেক পরে আকবার আলী চোখ মুছে বললেন, আমার দেখে আসা অতীতে মেয়েটা যাক, বাবা হয়ে আমি ক্যামনে চাই—বলো? সচেতন, ভালো একটা জামাই চাই।

অবসরপ্রাপ্ত অসহায় বাবা একটু পরে অন্তরে আত্মসমর্পণ করে বোকার মত বললেন, ওই ছেলেটার পরিবারের লোক এলো। চাইলাম, তারা ঘরে আসুক। আসতে দিল না। অপমান করে তাদের বাসার গেট থেকে তাড়িয়ে দিল। এত কিছু হলো মালেক চাচার কথায়। আর এখন চলছে নারীভাগ্য নিয়ে খেলা...। থেমে একটু পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, মেয়েটার বিয়ে এবারে হবে তো দিলু?’—খুব কষ্টে উত্তরের আশায় স্ত্রীর মুখের দিকে চাইলেন—‘মালেক চাচার আনা বিয়ের ঘরটা এবারে টিকবে তো?’

দুলালী বেগমের ভেতরটা গুমরে ওঠে। কী করে বলি—এবার সুরভীর বিয়ে হবে! আমার ২৯ বছরের আদরের মেয়েটা কারও টুকটুকে বউ হবে!’ নানা আশঙ্কায় চোখ বড় বড় করে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। মুখে উত্তর আসে না। শুধু চোখের কোণে চক চক করে জল।
মধ্যরাতে চোখ ছোট হয়ে আসে। বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না। শীতের তীব্রতায় শরীর একটু এলিয়ে দিতেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। অমনি দুয়ার খুলে ঘরের বাইরে এলেন আকবার আলী। বারান্দায় পড়ে থাকা হায়দার আলীর ব্যাগটা একঝটকায় হাতে তুলে নিলেন। টেনে বের করে আনলেন তালাবদ্ধ কাঠের বাক্স।

খোলার আগেই চোখে পড়ল হলদে রঙের একটি চিঠির খাম। একটানে ছিঁড়ে ফেললেন। সাদা কাগজে হায়দার আলীর হাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা চিঠি—‘মিয়াভাই, মানুষের লোভের শরীর। জানতাম, আপনার হাত পড়বেই। মিয়াভাই, মাছের পানিতে মাছ পঁচে না। মাছ পঁচার ভয়ে যে পানি সরিয়ে নিচ্ছেন, ওই দুজনকে ফের একখানে করে দেবে। ’

চিৎকার দিয়ে হা হা করে কেঁদে উঠলেন আকবার আলী। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ঘর থেকে ছুটে এলেন দুলালী বেগম। তার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে দ্রুত ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলেন। হা হা করে শিশুর মত কাঁদছেন বাবা। পাশের দুয়ারে সুরভী স্থির। বুকের ভেতরে বয়ে চলা স্রোত চোখের কোণ ফেটে নামছে। গোপনে সে জলের ধরা মুছছে। সবার চোখে জলের উৎসব, যেন জলের বায়বীয় বসন্ত বইছে।

সকাল হতেই খবর এলো, মিথ্যাবাদী মালেকের শ্বাসে টান ধরেছে। সুরভীর বরপক্ষ জানিয়ে দিল, তারা বিয়েতে রাজি নয়। কারণ, কারও সঙ্গে মেয়ের গোপন সম্পর্ক রয়েছে।



বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।