মিলন ভাইয়ের বাসায় ফেলে আসলাম, একটা খয়েরি রঙের মিনি সাইজ টেলিফোন গাইড আর একটা একটা সাদামাটা চাবির রিং।
মোবাইলহীন আমলে টেলিফোন গাইড সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় সম্পদেও একটা; যার গাইডে যত বেশি ফোন নাম্বার তার বড় সাংবাদিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তত বেশি।
চাবির রিংটা বিদেশি, তাই মনে করি, ঠিক নিশ্চিত নই, বিদেশ থেকে এসে একজন দিয়েছে। আমি বিদেশ থেকে আসা বলে বেশ দেখিয়ে বেড়াতাম। এক বন্ধু বলল, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে না। বিদেশিরা এসে জিঞ্জিরা থেকে কিনে এসব মানুষজনকে দিয়ে বেড়ায়। একবার একজন আমাকে...। ’ অতএব সেটাও মোটামুটি ডাস্টবিন যোগ্য।
কী করা এখন? মিলন ভাইয়ের মত বড় মানুষকে ফোন করে কি সেটা জিজ্ঞাসা করা যায়? মিলন ভাইয়ের সঙ্গে মাত্রই কয়েকদিন আগে পরিচয়, আশাতীত প্রশ্রয় পেয়েছি যদিও তবু বড় মানুষদের কায়দা কানুন মাত্র শিখছি। ওদিকে যে জিনিস দুটো না হলে চলে না।
সাহস করে ফোন করে বসলাম হলের কয়েন বক্স থেকে। পাওয়া গেল। মিলন ভাইকে এবং আমার জিনিসগুলোকে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘লেখক সুলভ বেখেয়ালি হিসেবে ঠিকই আছে। ’ তার মানে আমি লেখকের স্বীকৃতি পেয়ে গেলাম! মিলন ভাই দুই সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো আমার হৃদয় জিতলেন।
তৃতীয়বার! ঠিকই আছে। প্রথমবার সপ্তাহ দুয়েক আগে ভোরের কাগজের বিশ্বকাপ কুইজের অনুষ্ঠানে দেখা। মিলন ভাই এসেছেন। আমার আশেপাশের লোকজন দিব্যি মিলন ভাইয়ের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে আর আশ্চর্য, মিলন ভাই এমন সহজভাবে কথা বলছেন যেন তাদেরই সমগোত্রীয় কেউ। বেশিরভাগের নামও জানেন। অত বড় একজন লেখক অত সহজপ্রাপ্য। সাহস হয়ে গেল। আমিও কথা বলি। তখন পরিচিত হওয়ার ক্ষেত্রে বড় অযোগ্যতা বয়স, ১৯-২০। দেখায় ১৪-১৫। যোগ্যতা অবশ্য আছে, ভোরের কাগজের স্পোর্টস রিপোর্টার। তখন এটা বেশ ভারী পরিচয় কিন্তু শরীর যে হালকা। এক সহকর্মীকে ধরলাম। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলে সুবিধা হয়। তিনি সাহায্য করলেন, ‘ মিলন ভাই ও হচ্ছে মামুন, মোস্তফা মামুন। আমাদের স্পোর্টস বিভাগে আছে। ’
ও, মামুন- বলে মিলন ভাই হাত বাড়ালেন। এবং আর সবার মতো প্রায় সমান গুরুত্ব দিয়ে এমনভাবে হ্যান্ডশেক করলেন যে সেদিন আমার হৃদয় জয় করলেন প্রথমবার।
কিছুদিনের মধ্যেই দেখা করার সময় চেয়ে ফোন করলাম। একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম। অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বড় মানুষরা কোনো অনুষ্ঠানে অনেকের মধ্যে থাকলে যে আন্তরিক রূপে দেখা দেন ওয়ান টু ওয়ানে তেমন নন। টেলিফোন ধরেন না। পুরো না শুনে রেখে দেন। মিলন ভাই ধরলেনই না শুধু, এমনভাবে ‘মামুন কেমন আছ?’ বললেন যে দ্বিতীয়বারের মতো আমার হৃদয় জয় হলো।
পরেরদিন দুপুরে মহাউৎসাহে রওনা হলাম। এমনিতে বাস-টাস চড়ি, সেদিন রিকশা। লম্বা রিকশা ভ্রমণ শেষে মিলন ভাইয়ের ড্রইংরুমে বসে আছি। তিনি এলেন, দেখে মনে হলো, মিলন ভাই-ই বেড়াতে এসেছেন। এত সুন্দর সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। পরিপাটি চুল। নিজের বাড়িতে এত বিন্যস্ত থাকা মানুষ জীবনে খুব দেখিনি। এমনিতেই আমার শীর্ণ শরীর, এলোমেলো পোষাক মিলিয়ে নিজেকে এমন বেমানান মনে হচ্ছিল যে একেকবার মনে হচ্ছিল, আমি এর উপযুক্তই নই। কিন্তু তিনি, মিলন ভাই, এত গুরুত্ব দিয়ে কথা বলছিলেন যেন বাংলা সাহিত্যে লেখক হিসাবে তাঁর পরই আমার স্থান। নিয়ে গিয়েছিলাম নিজের প্রথম বই। অচেনা প্রকাশনী থেকে অযত্নে প্রকাশিত। হাতে দেয়ার আগে লজ্জা পেতে হয়। মিলন ভাই পরম মমতায় হাতে নিয়ে বললেন, ‘তোমার নামটা সুন্দর কিন্তু, এটাকে আরেকটু স্মার্ট বানানো যায়। ’
‘জি?’
‘নামের প্রথম অংশটা বাদ দিয়ে দাও। ওটা তো টাইটেল। ’
একমুহূর্তে একমত। সেদিন থেকে আমি ‘মোস্তফা মামুন’। মাত্র দুই সপ্তাহের পরিচয়ে দুই বারের দেখায় তিনি একজন তরুণ লেখকের জন্য কত বড় ছায়া হয়ে গেলেন।
সেই দুই সপ্তাহ পরে দুই যুগ পেরিয়েছে। এখন হিসাব করে দেখছি, আমাদের ২৯ বছরের চেনাজানা। এর মধ্যে এক যুগেরও বেশি সময় সহকর্মী। ধীরে ধীরে বড় হয়েছি। সাংবাদিক হিসেবে কিছু নামও ছড়িয়েছে এবং একসময় মিলন ভাইয়ের প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে চাকরি করেছি। ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে জীবন্ত সেই ১৯৯৬ সালের মিলন ভাই, যিনি এক নবীন লেখককে পরম মমতা আর মর্যাদায় জায়গা করে দিচেছন। এবং এ ক্ষেত্রে আমি একা নই। পরের ১৫-২০ বছরে দেখেছি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা কোনো তরুণও তার প্রশ্রয় পায় অবলীলায়। যে তরুণকে দুরুদুরু বুকে নিজের ছাপা প্রথম বই হাতে তার অপেক্ষা করতে দেখেছি, সেই অপেক্ষা শেষ হয়েছে প্রাণখোলা হাসির তৃপ্তিতে। মিলন ভাই একবারও বুঝতে দেননি সে এমন কিছু নয়। বরং বুঝিয়েছেন, তুমি বহু কিছু।
একবার জিজ্ঞেস করলাম তরুণদের এমন গুরুত্ব কেন দেন? বললেন, ‘যাই লেখুক, লেখক তো। একজন লেখকের সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রাপ্য। ’
মমতা, মর্যাদা, ভালোবাসা দিয়ে তরুণদের কাছে তিনি ভরসার বিরাট ছাতা যে ছাতার তলে যে বা যারা এসেছে এর স্নিগ্ধতায় সিক্ত হয়েছে। অন্য অনেকের কাছে যেখানে মেলে নিরাসক্তি, মিলন ভাইয়ের কাছে গেলে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। অন্যরা জানান, পথ কঠিন। মিলন ভাই বোঝান, এই পথ চলাতেই আনন্দ।
ও, হ্যাঁ, এই তরুণদের বই একপাতা হলেও মিলন ভাই পড়বেন। একটু ভালো লাগলে পুরোটা। তারপর পছন্দ হলে বলবেন, এই ছেলেকে খুঁজে বের করো। এবং আমাকেও খুঁজে বের করেছিলেন!
এখানেও মৃদু ক্লাইম্যাক্স। সেই প্রথম দেখার পর আমি সাংবাদিকতায় এমন মত্ত হয়ে গেলাম যে লেখালেখি-বই বের করলেও সাহিত্য জগতের সঙ্গে আর খুব যোগাযোগ ছিল না। মিলন ভাইয়ের সঙ্গেও যোগাযোগটা অনিয়মিত হয়ে গেল। ২০০৩ সালের দিকে অনন্যার মনির ভাই বললেন, ‘তুমি থাকো কই মিয়া। মিলন ভাই তোমাকে খুঁজছে?
‘ইমদাদুল হক মিলন?’
‘হ্যাঁ। আজ বইমেলায় এসেই স্টলে চলে আসবা। মিলন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলো। ’
গেলাম। মেলার বিকাল মানে মিলন ভাইয়ের দম ফেলার সময় থাকে না। ভক্তদের ভিড়। এর মধ্যে গিয়ে বিরক্ত করা ঠিক হবে না ভাবছি। মনির ভাই তবু বললেন, ‘মিলন ভাই এই আপনার মোস্তফা মামুন’
মিলন ভাই এই ভীড়-অপেক্ষমান শত পাঠকের মধ্যেও আমার দিকে মনোযোগ। ‘তুমি তো মিয়া খুব ভালো লেখো। লেখার স্টাইল দারুণ। আমি বইটা একটানে পড়ে ফেলেছি। ’
সেবার বেরিয়েছিল আমার ‘কলেজ ক্যাপ্টেন’ বই। মোটামুটি আলোচনায় আছে, বিক্রিও বেশ কিন্তু মেলা চলাকালীন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই লেখকের একজন একটানে এক তরুণের বই পড়ে ফেলেন! এর মধ্যেও একটা খচখচানি। মিলন ভাই সে-ই আগের স্মৃতি ভুলে গেছেন। আমার নাম দিলেন তিনি অথচ চিনলেন নতুন করে। পরে কারণটা বুঝেছি। একসঙ্গে চাকরি করার সময় দেখেছি এত এত তরুণ লেখক তার কাছে আসে এবং তিনি সময় দেন- এখন যদি এদের নামও স্মৃতি মনে রাখতে হয় তাহলে লেখা বাদ দিয়ে স্মৃতি চর্চাই করতে হবে শুধু। যাই হোক, এরপর আর যোগাযোগহীনতা নয়। শত ব্যস্ততায়ও মিলন ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগে ভুল হয়নি। মোবাইল এসে যাওয়ায় কাজও তখন থেকে সহজ। আর যোগাযোগ না করেই বা উপায় কী! কলেজ ক্যাপ্টেনের পরবর্তী যুগে বিষয়টা এমন দাঁড়াল যে মিলন ভাই এখানে-সেখানে আমার লেখার প্রশংসা করেন। লোকজন শুনে বলে, ‘মোস্তফা মামুন, ঐ যে খেলা নিয়ে প্রথম আলোতে লেখে’
‘খেলা লেখে বটে কিন্তু ওর গল্প-উপন্যাসও খুব ভালো’
‘ও আচ্ছা’
লোকজন খুব একমত হয় না। আমার সাংবাদিক পরিচয়ের আড়ালে লেখালেখি ডুবে আছে; খেলার সাংবাদিকই বড় পরিচয়। একজনের কাছে নয়। মিলন ভাই। আজও মিলন ভাই দেখা হলে মনে করিয়ে দেন, ‘যতই সাংবাদিকতা করো তোমার আসল পরিচয় হলো লেখালেখি। ’
সম্পাদকের দায়িত্বজনিত ব্যস্ততায় গত কয়েক বছর লেখালেখি সেভাবে করিনি। সেই সময় ভালো কিছু করলেই, মিলন ভাইয়ের ফোন বা মেসেজ। সহযোগী আরেকটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে তিনি কিন্তু তাহলেও দেশ রূপান্তরের উদার প্রশংসা করতে তার কোনো আপত্তি নেই। অনুজদের প্রাণ খুলে প্রশংসায়, মনে হয় এই দেশে সবার আগে থাকাদের একজন তিনি। এর মধ্যেও আমার বই বের হচ্ছে না শুনে আবার হতাশ, ‘বলছ কি? বই বের হবে না তোমার। শেষপর্যন্ত মনে রেখো, তোমার লেখাটাই থাকবে। ’
সত্যি বললে, আমি যে লিখছি না, বই বের হচ্ছে না তাতে মিলন ভাইয়ের আফসোস দেখে মনে হচ্ছে যেন তারই কী যেন হচ্ছে না। আমাদের মিলন ভাই এমনই। লেখক আর লেখার প্রতি এমনই মগ্ন। কত যে পড়েন। বড় বড় সাহিত্যিকের লেখা মুখস্ত বলতে পারেন টানা এবং অখ্যাত লেখকদের ভালো কোনোলেখাও তার নজর এড়িয়ে যায় না। লেখার কথা সবাই জানে, আমি-আমরা জানি বাংলা সাহিত্যের পাঠকের তালিকা করলে তাতেও শীর্ষ কয়েকজনের একজনের নাম হবে ইমদাদুল হক মিলন। তাতে লেখার প্রতি ভালোবাসা বোঝা যায়, আরও বোঝা যায় মেধার সঙ্গে সাধনার সংযোগে এই তুঙ্গস্পর্শী সাফল্য । মিলন ভাই আবির্ভূত হননি, তিনি হয়ে উঠেছেন। সাহিত্যকে ভালোবেসে, নিজেকে নিবেদন করে, জীবনের অন্য সব অনুষঙ্গকে এড়িয়ে গিয়ে এক অপার্থিব মগ্নতায় তৈরি তার ভালোবাসার এই পৃথিবী। সে এমনই এক জগত যেখানে তিনি পথ চলেননি। পথ তৈরি করেছেন। সামনে কেউ ছিল না, আবছা সেই রাস্তা- মিলন ভাই হেঁটেছেন। সঙ্গে সোনালী কলম। সাহিত্যে সমর্পিত হৃদয়। সৃষ্টিশীলতা পুষ্ট মন।
এসব শিল্পীর থাকবেই। আরও অনেকের ছিল। কিন্তু মিলন ভাই শিল্প আর সাধনাকে মিশিয়েছেন এক অদ্ভুত মোহনায়। লেখকরা বেখেয়ালি হবে, এলোমেলো থাকবেন সেই ধারা ভেঙ্গে অবিশ্বাস্য গোছানো, চূড়ান্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ। ক্ষমতা অনেকেরই থাকে। কেউ কেউ বেখেয়ালে ওড়ায়। কেউ কেউ তাকেই যথেষ্ট ভেবে নিজেকে আর শাণিত করে না। মিলন ভাই শ্রম আর সাধনায় নিজের সক্ষমতাকে পূর্ণরূপ দিয়েছেন। শিল্পীর সৌন্দর্যের সঙ্গে সাধকের মগ্নতা আর পরিশ্রমীর শৃঙ্খলা এই তিনে তিনিই বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার লেখক। কে চাকরি-বাকরি বাদ দিয়ে স্রেফ লিখেই জীবন চালানোর সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পরে সেই সত্তর দশকে? কে ভাবে, যে আমি লিখব, টাকা রোজগার করব, চাকরি-ব্যবসার মতো আয় হবে এখান থেকে। আর কখন? যখন রয়্যালিটি শব্দটা এটি দেবের ডিকশনারির বাইরে বেরোয়ইনি খুব একটা। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম, যিনি নিজের ভিজিটিং কার্ডে লিখতেন, ইমদাদুল হক মিলন, লেখক। পরে আরও যে কেউ কেউ সেই পথ ধরেছেন তা সম্ভব হয়েছে একজন মিলন ছিলেন বলে। এই জায়গায় তিনি এক নম্বর।
জনপ্রিয়তার জায়গায়! ‘হুমায়ূন-মিলন’ শব্দ জোড়া বাংলাদেশের প্রকাশনা অঙ্গনের স্থায়ী শব্দ। তাতে মিলন ভাইয়ের নাম কেউ কেউ পরে বলেন। উদ্ধৃত করি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হুমায়ূন আহমেদকে। ‘দেশে ফিরেছি কয়েক বছর পর। শুনলাম একজন নতুন লেখক খুব জনপ্রিয় হয়েছে। ইমদাদুল হক মিলন নাম। লোকজন লাইন ধরে তার অটোগ্রাফ নিচ্ছে। আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম লাইনে’। লেখকের নাম, হুমায়ূন আহমেদ। জি, হুমায়ূন আহমেদ লাইন ধরে তার বই কিনে অটোগ্রাফ নিয়েছিলেন। বই কেনার পর যা লিখছেন, ‘লেখককে দেখে ঠিক লেখক মনে হলো না। জিন্সের প্যান্ট, পুরু গোঁফ, কেডস পায়ে...। ’ হাতের কাছে সে-ই লেখাটা নেই বলে উদ্ধৃতিতে এক-আধটু এদিক-সেদিক হতে পারে কিন্তু মূল সুরটা এমনই।
পুরু গোঁফটা এখন নেই। কেডস-জিন্স এখনও আছে। আছে দামী পারফিউম। বিন্যস্ত-ব্র্যান্ডের পোষাক। একসঙ্গে চলতে গিয়ে দেখেছি পোষাকে-প্রকাশে আভিজাত্যের একটা রং আছে। লেখকরা যে বিষয়টায় সাধারণত উদাসীন। পাঞ্জাবী-পাজামা-ঝোলার এই লেখকীয় ছবিকে তিনি অতীত করে দিয়েছেন একসময় তারুণ্যের চাঞ্চল্যে। এখন বয়সী বিন্যস্ততায়। কখনও জিজ্ঞেস করিনি কিন্তু বুঝতে পারি বেশ, মিলন ভাই দেখাতে চেয়েছেন, লেখক মানেই হেলাফেলার কেউ নন। এবং সে আর দশজন সামাজিক বিচারের সফল মানুষের মতো সমৃদ্ধ জীবনও যাপন করতে পারে। যে বা যারা তাকে দেখেছে, তারা জেনেছে লেখক হওয়া মানেই দরিদ্র-সংগ্রামের জীবন বেছে নেয়া নয়। ঠিকমতো নিজেকে প্রকাশ করতে জানলে তা দিয়েও সম্ভব। অনেকে বলবেন, শিল্পের সঙ্গে-সৃষ্টির সঙ্গে এটা ঠিক যায় না। সেই মতকে অশ্রদ্ধা করি না কিš‘ এটা তো ঠিক যে কেউ যদি মনে করে এই পথে আর্থিক সম্ভাবনাও আছে তাহলে তার পা বাড়ানোর সম্ভাবনা একটুও বেশি।
বেশি লোক সাহিত্যে এলে-সাহিত্য করলে বড় লেখক বের হওয়ার সুযোগ বেড়ে যায় আরেকটু। মিলন ভাই সেই সম্ভাবনার সলতেতে আগুন জ্বালিয়েছেন। এখানেও নাম্বার ওয়ান।
‘হুমায়ূন-মিলন’ লড়াই যখন বাংলাবাজারে চলছে তখন ওদিকে দেশের প্রত্যন্ত এক শহরে বসে আমরাও এর অংশীদার। স্কুলের ছাত্র তখন। হুমায়ূন-মিলন পড়া তাই একরকম বাধ্যতামূলক। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া প্রেমার্তরা মশগুল মিলনে। আপাত বখে যাওয়া তরুণের মোটরসাইকেলে সুন্দরী মেয়েকে বসার কাহিনিতে মফস্বলের এক সাধারণ যুবক নিজেকে খুঁজে পায়। বদ্ধ সমাজের তরুণী স্বপ্ন দেখে, একদিন আমিও...।
স্বপ্ন পাখা পায়। ভয়কে জয় হয়। মিলন ভাই জানেনও না এভাবে কত রঙহীন জীবনে যে তিনি রঙের ছোঁয়া। প্রেমহীনতায় তিনি প্রেমের ফেরিওয়ালা। ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ ‘ভালোবাসার সুখ-দুঃখ’ ‘নায়ক’ লাখ লাখ কপি বিক্রি হচ্ছে। প্রকাশকরা তাকে মাথায় তুলছেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্ফীত হচ্ছে। তিনি তৈরি করছেন গল্পের পর গল্প কিন্তু নিজেও তো গল্প হচ্ছেন। জিন্স পরে লেখক হওয়া যায়! লেখক হয়েও লাখ-কোটি রোজগার করা যায়। এই গল্প তো তার লেখা গল্পকেও কোথাও হার মানায়। তিনি লিখেছেন, যা সমাজে ঘটে। কিন্তু যা কখনো ঘটেইনি তাই ঘটিয়ে মিলন নিজেই তো হয়ে ওঠেন তার তৈরি ‘নায়ক’ উপন্যাসের চেয়েও বড় নায়ক।
এক পক্ষ এরকম পাগলের মতো তাঁকে পড়েছে। আরেক দল হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে। এখানেই মিলন ভাই, সমাজ এবং সাহিত্য- এই ত্রিকোণকে বোঝার বিষয়। মিলন ভাইয়ের বই যদি অত বিক্রি না হত, না হতেন অত জনপ্রিয় তাহলে দেখতেন সবাই বলত, মিলন কত ভালো লেখে কিন্তু মানুষ মূল্য দিল না। যাদের মানুষ মূল্য দেয় না তাদের নিয়ে আমাদের সাহিত্য সমাজের ভীষণ মাথাব্যথা। কিন্তু যাকে মানুষ মূল্য দেয় সে আবার তাদের মাথাব্যথা। কেউ জনপ্রিয় হলে যেন সেটা বিরাট অপরাধ। জনপ্রিয়, সাধারণরা পড়ছে, কাজেই সে আর পাতে দেওয়ার কেউ নয়। এবং এভাবে কি সাহিত্যমঞ্চ আসলে সাধারণকে অশ্রদ্ধা করে না! যে সাধারণ বা মানুষই সাহিত্যের ভোক্তা হওয়ার কথা তাকেই তো সরিয়ে দেয়া হয় দূরে। সাহিত্য সমাজ থেকে দূরে যাওয়ার এটাও কি পরোক্ষ কারণ নয়?
মিলন ভাইকে কিছু মূল্য দেওয়া হয়। সেই একই কাহিনি।
নুরজাহান, যেটার জন্য আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন এবং বাংলাদেশে বিদেশি পুরস্কার পেলে ভীষণ কদর। তাতে প্রমাণ, আমরা মেনে নেই যে আমরা সঠিক মূল্যায়নও জানি না। বিদেশিরা মূল্য দিলে তবেই বুঝতে পারি। এরপর শুনবেন ‘পরাধীনতা’, জার্মান স্মৃতির উপর লেখা। কেউ কেউ বলবে, কালো ঘোড়ার কথা। কিংবা কালাকাল। নিশ্চয়ই সেসব ভালো লেখা। গভীর দৃষ্টি আছে। বোধকে নাড়া দেওয়ার মতো ডিটেইলিং। কিন্তু আমার কাছে সেগুলোকে ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসলে সেই ১২০-১৫০ পৃষ্ঠার প্রেমকাহিনিই। ওটাই আসলে ইমদাদুল হক মিলন। তার যে ভালো লেখা তেমন লেখা বাংলা সাহিত্যে অনেকেরই আছে। আরও বেশিও হয়ত আছে। কিন্তু সাধারণ রোমান্টিক, এক বসায় শেষ করে ফেলা বইতেই আসলে তাকে বেশি মেলে। পুরান ঢাকার গলিতে পুরনো বাইক শব্দ করে চালিয়ে আর চুল উড়িয়ে চলা নায়কের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পায় মফস্বলের কেনো এক অখ্যাত তরুণ। তাঁর এই নায়কের কিছু নেই, আছে বুক ভর্তি ভালোবাসা। এবং সেটাও যে প্রচণ্ড একটা শক্তি সাধারণ বা অতি সাধারণের কাছে কিন্তু এই শিক্ষাটাই গুরুত্বপূর্ণ। সে ভাবে জীবনে তথাকথিত প্রতিষ্ঠা না পেয়েও তো আমি পেতে পারি সুন্দরী লাভলি-বিনুর প্রেম। উচ্ছিষ্ট আমি উচ্চতায় উঠতে পারি এভাবেই।
সত্তর, আশি দশক-তারুণ্য-পুরান ঢাকা-প্রেম- এসব তার চেয়ে বেশি করে চেনায়নি। তরুণের ঘুমন্ত তারুণ্যকে জ্বালানি দিয়েছেন তিনি, সুন্দরের সৌন্দর্যবোধকে। কিছু যৌনতার আভাসে কেউ কেউ অশ্লীলতা দেখেন, পাঠক দেখে পূর্ণতা। তারুণ্যে যৌন স্বপ্ন কার থাকে না? থাকে কিন্তু সবাই লুকায়। মিলন ভাই সাহসে সামনে এনেছেন। কাউকে মুগ্ধতায় ভাসাতে নিজের গুণ বাড়ানোর শিক্ষাটা তার, নিজেকে উপযুক্ত করার নেশায় কত তরুণ-তরুণী যে নতুন পথে পা বাড়িয়েছে। গড়েছে-শিখেছে-ভালোবেসেছে- এর মূল্যমান কী কম! প্রেমের শিক্ষা, বিরহের দুঃখ, সামালের শক্তি, ফেরার নেশা, নতুন আশা- এসবেই মিলন। এবং এই সাধারণ সৌন্দর্যকে সাদামাটা প্রকাশের মিলনই সেই সময়ের তারুণ্যের কাছে আসল মিলন। এর মর্যাদা যে সম্ভ্রান্তরা দেয়নি সে তাদের দৈন্য। মিলনের অপ্রাপ্তি নয় একটুও।
সেই মানুষটা তারুণ্য পেরিয়েছেন সময়ের নিয়মে। তারপর মধ্যবয়স পেরিয়ে এখন প্রায় বার্ধক্যে। শব্দটা লিখতে গিয়ে কী বোর্ড আটকে গেল। বার্ধক্য। মিলন ভাই! সিরিয়াসলি! দুর, কোথায় বৃদ্ধতা আর কোথায় আমাদের মিলন ভাই। মিলন ভাইয়ের ছেলে এসেছিল কয়েক বছর আগে কালের কণ্ঠ অফিসে। ‘বাবা’ বলে ডাকছিল। এমন বেমানান লাগল। মিলন ভাই বাবা হয়েও বাবাত্বটা ঠিক যেন মানায় না। যায়, ভাই। তরুণ। সেই সত্তর দশক-আশি দশক। না, সত্তরের মিলন নয়। সত্তর-আশি দশকের মিলনই ঠিক।
মিলন ভাই, যতই আপনার সত্তর হোক, আমরা আপনাকে সত্তরের সম্মান দিতে পারছি না বলে দুঃখিত। আপনাকে সত্তর মেনে নিলে যে সত্তর-আশির কোটি তরুণ-তরুণীর সঙ্গে আপনার বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। ওরাও এখন পঞ্চাশ-ষাট কিন্তু মাঝে মধ্যে যে বিশ-পঁচিশে ফিরে যায় সে আপনার কলমে তৈরি হৃদয়রঙা পালকিতে চড়ে।
এখন আপনার সত্তর মানলে ওদের হৃদয়রঙা পালকি হৃদয়ভাঙ্গার গাড়ি হয়ে যাবে।
থাক না মিলন ভাই। সত্তর তো অনেকেই আছে। ইমদাদুল হক মিলন তো একজনই!