ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

জাগো বাহে কোনঠে সবায় (প্রথম পর্ব)

ফরিদ আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৫
জাগো বাহে কোনঠে সবায় (প্রথম  পর্ব)

কাল পূর্ণিমার ডাক
প্রায় আড়াইশ’ বছর আগের ঘটনা।
ইংরেজদের শোষণ এবং লুণ্ঠনের সহযোগী এবং গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর প্রিয়পাত্র দেবী সিংহের ভয়াবহ অত্যাচার- নির্যাতনে রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চল মৃতপ্রায়।

দেবী সিংহ ছিলেন ইংরেজ মনোনীত এই অঞ্চলের ইজারাদার।

কিন্তু, তাঁর সীমাহীন লোভ লণ্ড-ভণ্ড করে দিয়েছিলো এই জনপদকে। শুধু এই অঞ্চলে নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা ও বিহারের দেওয়ানী লাভের পর সমগ্র বাংলাদেশ ও বিহারে যে অবর্ণনীয় অরাজকতা দেখা দিয়েছিলো, তার প্রধান কারণ ছিলো দেবী সিংহের লুণ্ঠন ও উৎপীড়ন। তাঁর অপরিসীম অত্যাচার ও অন্তহীন অবাধ লুন্ঠনে রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চল পরিণত হয়েছিলো শ্মশ্মানে। চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছিলো অসহায় কৃষকদের হাহাকার আর গগনভেদী দীর্ঘশ্বাস।

দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অসহায় হরিণও ঘুরে দাঁড়ায়, এই অঞ্চলের নিরীহ এবং নির্বিবাদী কৃষকরাও তেমনি ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো। এমনিতেই মৃত্যু হচ্ছে মহামারীর মতো, কাজেই মৃত্যুকে নিয়ে তাদের আর কোনো ভয়-ডর ছিলো না। বরং পরম পরাক্রমশালী দেবী সিংহ এবং সীমাহীন শৌর্যবান ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তারা।

খনির ঘন অন্ধকার থেকে যেমন করে উঠে আসে উজ্জ্বল হীরকখণ্ড, তেমনি সাধারণ কৃষকদের মধ্য থেকে উঠে আসেন এক অসামান্য মানুষ, একজন অমিতবিক্রমশালী সিংহ-হৃদয় পুরুষ। নিপীড়িত জনগণকে সংঘবদ্ধ করে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে প্রবল তেজে রুখে দাঁড়ান তিনি।

সেটি সতেরো শো তিরাশি সাল। এ বছরই এই অনন্য মানুষটি দেবী সিংহকে করে তোলেন নেংটি ইঁদুরের মতো ভীত, অসহায়। ইতর প্রাণীর মতো প্রাণভয়ে পলাতক হন দেবী সিংহ। আর এই মুক্তিকামী মানুষটি কাঁপিয়ে দেন বাংলার বুকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে। একের পর এক যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বিপর্যস্ত করে তোলেন তাদের।   তবে, শেষ রক্ষা হয় না। এরকমই এক যুদ্ধে আহত হয়ে বন্দি হন তিনি। তারপর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বন্দিদশায় মৃত্যু ঘটে তার। কৃষকদের এই  সর্বব্যাপী সশস্ত্র বিদ্রোহই রংপুর বিদ্রোহ নামে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে।

আর এই বিদ্রোহের যিনি নায়ক, জনগণের জন্য আত্মত্যাগকারী সেই বীরের নাম নূরুল উদ্দীন।

ইতিহাসে অন্ধকার পৃষ্ঠা থেকে নূরুল উদ্দিনের বিস্তারিত পরিচয় উদ্ধার করা যায় না। শুধু এইটুকুই জানা যায় যে, তিনিই প্রথম রংপুরের কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন। তিনি তাদের নিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন নিরীহ কৃষকদের রক্তনালী থেকে রক্ত চুষে খাওয়া দুর্বৃত্তসম দেবী সিংহের হাত থেকে রক্ষা করতে।   

রংপুরের বুকে নূরুল উদ্দিন যে বিপ্লবের লাল আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাকে নির্বাপিত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। আর যাকে কেন্দ্র করে এই বিদ্রোহ, সেই দেবী সিংহকে রংপুর ছেড়ে পালাতে হয়েছিলো জান হাতে নিয়ে। জনগণের চুড়ান্ত জয় হয়তো হয় নি সেদিন, কিন্তু এই সাময়িক জয়ও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে সগৌরবে। আর সেটাই যুগে যুগে সাহস এবং প্রেরণা যুগিয়েছে ভবিষ্যতের গণ বিদ্রোহ এবং জন-আন্দোলনকে।

সুপ্রকাশ রায় তাঁর "ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম" পুস্তকে এবং সুধাংশু পাত্র তাঁর "বাংলার বীর বিদ্রোহী" বইতে এই বীর বিদ্রোহীকে চিহ্নিত করেছেন নূরুল উদ্দিন নামে। অন্যদিকে, সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর বিখ্যাত নাটক "নূরলদীনের সারাজীবন"-এ নূরুল উদ্দিনকে আখ্যায়িত করেছেন নূরলদীন নামে।

বাংলাদেশে নূরুল উদ্দিনকে কেউ চেনে না, কিন্তু বহু সংখ্যক মানুষ নূরল দীনের কথা জানে। সেটা সৈয়দ হকের এই বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটকের কারণে। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর “নূরলদীনের সারা জীবন” নাটকের ভূমিকাতে লিখেছেনঃ

"ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় নামটি লিখেছেন - নূরুলউদ্দিন, আমরা বলবো ওটা হবে নুরুদ্দিন, কিন্তু আমি ব্যবহার করেছি - নূরলদীন, রংপুরের সাধারণ মানুষ যেমনটি উচ্চারণ করবে। "

আমার এই লেখাতেও আমি ব্যবহার করবো নূরলদীন। এই নামটার মধ্যে একটা ইস্পাতসম কাঠিন্য আছে, আছে অগ্নিশিখার অমিত আহবান, আছে আমার দেশের মাটির গন্ধের সাথে মিশে থাকা মাতাল এক অনুভূতি, আছে কাল পূর্ণিমায় রক্তলোলুপ হায়েনার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য  গগণবিদারী কণ্ঠে ডেকে ওঠা এক প্রতিধ্বণির আশ্বাস। জাগো বাহে কোনঠে সবাই।
 
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।
নূরলদীনের কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ি ঢলের মত নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে উঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, 'জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?'
 
বাংলার মাটি বাংলার জল
দিল্লীর সিংহাসনে আসীন তখন সম্রাট শাহ আলম। মুর্শিদাবাদে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবাদার নজমুদ্দৌলা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাত্র  কয়েক বছর আগে পলাশী প্রান্তরে পরাজিত করেছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীকে। ধূর্ত এই কোম্পানি কার কি ক্ষমতা, কার কি অধিকার, তা খুব ভালো করেই জানতো এবং বুঝতো। সে কারণে প্রথমেই তারা প্রাদেশিক শাসনকর্তা নজমুদ্দৌলাকে হস্তগত করে কোম্পানির কর্মচারী পাঠানোর ব্যবস্থা করলো দিল্লীতে সম্রাটের কাছে। দিল্লীর সম্রাট তখন নিজেই নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। মুগল সাম্রাজ্যের আগের সেই শৌর্য-বীর্য আর নেই। ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা তখন। কাজেই, কোম্পানির কর্মচারীর সাথে বেশি কথাবার্তা হলো না। বার্ষিক ছাব্বিশ লক্ষ টাকা সম্রাটকে আর তিপ্পান্ন লাখ ছিয়াশি হাজার টাকা নজমুদ্দৌলাকে দেবার অঙ্গীকার করে সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানী ফরমান নিলেন। নজমুদ্দৌলা আগেই রাজি ছিলেন, এখন এই বন্দোবস্তে সম্মত হয়ে একখান নিয়োগপত্র লিখে দিলেন।

দিল্লির সম্রাটের সাথে কোম্পানির এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বন্দোবস্ত পাকা হয়ে গেলো এতো কম সময়ে যে, একজন মুসলমান লেখক আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এতো কম সময়ের মধ্যে একটা গাধা বিক্রির কথাও শেষ হয় না। গাধা বিক্রি হয় না, কিন্তু দেশ বিক্রি হয়ে যায় ওই অতো অল্প সময়ের মধ্যেই।

এই সময়ে বাংলাদেশে রাজস্ব আয় ছিলো তিন কোটি টাকা। সম্রাট এবং নবাবকে দেবার পরেও কোম্পানির লাভ থাকে দুই কোটি টাকার উপরে। দেওয়ানি নেবার ছ’মাস পরেই ১৭৬৭ সালের এপ্রিল মাসে মুর্শিদাবাদে কোম্পানির পূন্যাহ হলো।

প্রথম পূন্যাহ, কাজেই খুব সমারোহের সাথে তা করা হলো। আমোদ-প্রমোদের কোনো ত্রুটি হলো না। বিলেতে বোর্ড অব ডিরেকটরদের কাছেও এই সুখবর গেলো। তাঁরা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের শতকরা ১২ ভাগ লভ্যাংশ দেবেন বলে ঘোষণা দিলেন। এই অপ্রত্যাশিত ধনাগমের উপর বৃটিশ সরকারেরও নজর পড়লো। তারা ইস্ট  ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে কর চাইলো এবং পার্লামেন্টে এই বিষয়ে এক আইন নিয়ে হাজির  হলো। পার্লামেন্টে বহুক্ষণ বিতর্কের পর আইন পাশ হলো যে, কোম্পানিকে কর হিসাবে সরকারকে চল্লিশ লাখ টাকা দিতে হবে। বলা বাহুল্য যে, এই অতিরিক্ত টাকা কোম্পানি তার নিজের পকেট থেকে দেয় নি। এই অতিরিক্ত টাকাটা বাংলার কৃষকদের কাছ থেকেই আদায় করার চেষ্টা করা হয়েছে। রেজা খাঁ তখন রাজস্ব সচিব। তিনি রাজস্বের আয় আরো বেশি করে দেখালেন।   তখন নবাব নামে মাত্রই ক্ষমতায়। কোম্পানির লোকদের ইচ্ছাতে সকল কর্ম হতো। সেই সময়ে এই লোকের নিজের বেতনও ছিলো বছরে নয় লাখ টাকা।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা অবস্থা চললেও, দেশের অবস্থা তখন বারোটা বাজার কাছাকাছি। পুন্যাহ করার এক মাসের মধ্যে নবাব নজমুদ্দৌলার নবাব-লীলা সাঙ্গ হলো। বসন্ত রোগে তাঁর মৃত্যু হলো। এর কিছুদিন পরেই দেশে অনাবৃষ্টি হলো। ১৭৬৮ সালে ফসলও তেমন ভালো হলো না। ফলে, ১৭৬৯ সালে প্রবল খাদ্যাভাব দেখা দিলো। কিন্তু, তারপরেও বাংলার নূতন কোম্পানি দেওয়ান খাজনা আদায়ে বিন্দুমাত্রও শিথিলতা প্রদর্শন করলো না।   তার পরিবর্তে খাজনা আরো কড়াকড়িভাবে আদায় করা হলো। ওই বৎসরই উত্তর বাংলায় অনাবৃষ্টি ও দক্ষিণ  বাংলায় অতিবৃষ্টি হলো। স্থানীয় কর্মচারীরা দুর্লক্ষণ দেখে গভর্নরকে আগতপায় দুর্ভিক্ষের সংবাদ দিতে লাগলেন। কিন্তু, গভর্নর সে সংবাদ কোম্পানির ডিরেক্টরদের জানালেন না।

অনাগত দুর্ভিক্ষের আশংকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও করেছিলো, কিন্তু এই সমাগত দুর্ভিক্ষের প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থাই তারা করে নি। দুর্ভিক্ষ বা দুর্ভিক্ষ প্রায় অবস্থা হলে রাজস্ব সম্পূর্ণ আদায় হবে না, এই চিন্তা কিছুটা হলেও ছিলো হয়তো তাদের মনে। কারণ, এক লাখ টাকার মতো কর সে বছর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। যদিও পরের বৎসরেই তা আদায় করে নেওয়া হয় শক্তভাবে।   আর ঠিক তার পরের বছরেই আশংকিত সেই দুর্ভিক্ষ এসে হাজির হয়।

বাংলার ইতিহাসে এ হচ্ছে সেরা দুর্ভিক্ষ। এক কোটি লোক না খেয়ে মারা গিয়েছিলো এই দুর্ভিক্ষে। বাংলার জনসংখ্যা এক তৃতীয়াংশ কমে গিয়েছিলো এই ভয়াবহ দুর্যোগে। এই দুর্ভিক্ষের বৎসরটা ১১৭৬ সাল। সেই জন্য এই সালের নাম অনুসারে এটাকে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ বলা হয়।

এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মধ্যেও কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের প্রতি বিন্দুমাত্রও কোনো অমনোযোগ ছিলো না। কর কমা তো দূরের কথা বরং দুর্ভিক্ষের বছরেই দশভাগ কর বেশি আদায় করা হয়েছিলো। বিহারে, যেখানে এক পাটনাতেই প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশজন মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যেতো, সেখানেও দুর্ভিক্ষের বছরে চার লাখ ছাব্বিশ হাজার টাকা বেশি আদায় করা হয়েছিলো। রুজুফ খাঁ নামের একজন ফৌজদার রিপোর্ট করেন যে, “অনাবৃষ্টি হেতু খরিফশস্য জন্মায়নি, রবি শস্য এক রকম ভালই জন্মেছে। তাই তিনি তাঁর তহশীলের সমস্ত টাকা আদায় করে বলেছেন দেশে যা জন্মেছিল তা তিনি সমস্ত আদায় করেছেন। “

কোম্পানির আরেকজন কর্মচারী মহম্মদ রেজা খাঁ বলেন যে, “ভয়ানক অনাবৃষ্টি, খাদ্যদ্রব্যের দুর্ম্মূল্যতা, পরে অত্যন্ত অভাব। এই সকল থেকে দেশে যে কি কষ্ট হয়েছে, তার আর কি বর্ণনা করব? জলাশয় সব শুকিয়ে গিয়েছে, জল দুষ্প্রাপ্য হয়েছে। এর উপর অনেক লোক গৃহদাহে সর্বস্বান্ত হয়েছে। দিনাজপুর ও পূর্ণিয়া জেলার রাজগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে যে শস্য সঞ্চিত ছিল তা পুড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এ সকল সহ্য করেও প্রজা আশা করেছিল বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসে বৃষ্টি হবে, কিন্তু জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত একবিন্দু বারিপাত হল না। জমিতে লাঙ্গল পড়ল না, বীজ বোনা হল না। “

দেশের যখন এই শোচনীয় অবস্থা তখনও অনেক স্থানে পূর্ণমাত্রার খাজনা আদায় করা হয়েছে। বর্দ্ধমানের রাজা তেজচাঁদ ১৭৭১ সালের মে মাসে রিপোর্ট করেন যে, “Notewithstanding the hardships and distressess that have befallen the ryots, the poor and  inhabitants of this country from the famine the revenues have been collected without balance.”অথচ এই রাজাই ১৭৬৯ সালের নভেম্বরে  রিপোর্ট করেছিলেন যে, “দেশে অনাবৃষ্টি, খাদ্যদ্রব্য মহার্ঘ, জমির ফসল শুকিয়ে গেছে এবং তা কেটে গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে, পুকুর সব জলশূন্য, অন্নকষ্টের সঙ্গে জলকষ্টও হয়েছে। রবিশস্য বিলম্বে বোনা হয়েছে, বৃষ্টি না হলে তাও মরে যাবে। দলে দলে লোক গ্রাম ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। “

পূর্ণিয়ার ফৌজদার মহম্মদ আলি খাঁ রিপোর্ট করেন যে, “এমন একটা দিন যাচ্ছে না যেদিন ৩০/৪০ জন লোক না মরছে। ক্ষুধার জ্বালায় দলে দলে লোক মরছে এবং মরছে; বীজের ধান, লাঙ্গলের গরু, চাষের যন্ত্রপাতি লকে বিক্রি করে ফেলেছে। শেষে সন্তান বিক্রি করছে, কিন্তু খরিদ্দার পাওয়া যাচ্ছে না। “

এই রিপোর্ট দেবার পরেও আবার এই লোকই গর্ব করেছে এই বলে যে,“আমি সরকারের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রজার এই দারুণ কষ্টের প্রতি দৃকপাত করি না, লোকের কাতর কান্না শুনি না। “

যশোরের আমীর উজাগর মল্ল রিপোর্ট করেন যে, “লোকে গাছের পাতা খাচ্ছে এবং সন্তান বিক্রি কচ্ছে; কিন্তু তার খরিদ্দার পাওয়া যাচ্ছে না। “

ইংরেজ রেসিডেন্ট রিপোর্ট করেছেন যে, “The scene of  misery, that intervened and still continues, shocks humanity too much to bear description. Certain it is that in several parts the living have  fed on the dead, and the number that has perished in these provinces that have most suffered is calculated to have been within these few months as six is to sixteen of the whole inhabitants.”

এই রকম শোচনীয় অবস্থার মধ্যেও যেখানে কোনো প্রজার ঘরে কিছু শস্য ছিলো, কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীরা তা জোর করে অল্প মূল্যে কিনে নিয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি করতেও দ্বিধা বোধ করে নি।

নবাবি আমলের শুরুতে সুবেদারি ফরমানে দিল্লির সম্রাট বাংলাদেশ “জেন্নেৎউল বিলেত” অর্থাৎ ‘পৃথিবীতে স্বর্গতুল্য বলে’ বর্ণনা করেছিলেন। আর সেই নবাবিূ আমলের শেষে সেই বাংলারই এই করুণ অবস্থা। কিছু লোভী মানুষের কারণে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাঙলা তখন মহাশ্মশ্মানে পরিণত।

এই রকম এক পরিস্থিতে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন। রাজস্ব সংগ্রহ প্রণালীর সংস্কার শুরু হলো। হেস্টিংস এসেই শুরুতে কালেক্টর ও তাঁর সহকারীদের বেতন বৃদ্ধি করে দিলেন। এঁদের বেতন খুবই অল্প ছিলো। তাঁদের এই স্বল্প বেতন তাঁরা পুষিয়ে  নিতেন অসাধুতার মাধ্যমে এবং গোপনে নিজে  ব্যবসা করে। বেতন বাড়িয়ে ধারণা করা হয়েছিলো যে,পর্যাপ্ত পরিমাণে বেতন পেয়ে, এরা আর অসাধু  পন্থা অবলম্বন করবে না। তবে, এতে করেই যে তারা সবাই সাধু সন্ন্যাসী বনে যাবে রাতারাতি, এই আশাও হেস্টিংস করেননি। কাজেই, সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে, পাঁচ বৎসরের জন্য ঠিকা দিয়ে খাজনা আদায় করা হবে।   একজন কালেক্টর একজন দেশীয় দেওয়ানের সহযোগিতায় এই কার্য সমাধা করবে।

এর আগে জমিদাররা রাজস্ব আদায় করে নবাবী গভর্মেন্টকে দিতেন। এই সব জমিদারদের খারিজ করে দেওয়া হলো না। কাউকে কাউকে অবশ্য সরানো হয়েছিলো। ঠিকার প্রস্তাবে নতুন, পুরাতন, সকলের কাছেই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা চাওয়া হলো। যারা সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা  দিতে স্বীকার করলো, তারাই নতুন ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব পেলো। আর যারা অস্বীকার করলো, তাদের জায়গায় অন্য  ঠিকাদার নিয়োগ করা হলো।

সর্বত্র ঠিকাদার নিযুক্ত হলো। কিন্তু কোম্পানির আশংকা হলো যে, ঠিকাদারেরাও প্রজাদের উপর অত্যাচার করে অতিরিক্ত কর আদায় করবে। এ  বিষয়ে কোম্পানি কিছু ব্যবস্থা নিলো। হৃষীকেশ সেন তাঁর ‘বাঙলার কৃষকের কথা’-বইতে লিখেছেনঃ

“প্রজা নবাব সরকারে যে কর দিয়ে আসছে তার অতিরিক্ত আর কিছু নেওয়া না হয়, তার জন্য যথারীতি আদেশ প্রচার করা হল। কিন্তু প্রজা যে কর দিয়ে আসছে তার মধ্যেই যে অনেক অতিরিক্ত কর প্রবেশ লাভ করেছে তা আর দেখা হল না। আদেশ হল যা হয়ে  গিয়েছে, তাত হয়েই গিয়েছে, সে সম্বন্ধে আর কিছু করা যাবে না, কিন্তু আর কোন নূতন  ‘আবওয়াব’ আদায় করা হবে না। যদি কেউ তা করে ত তা বে-আইনী হবে। ”

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।