কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জনগোষ্ঠীর জীবনে নতুনতর সাহিত্যবোধ, সাহিত্যদৃষ্টি এবং সাহিত্য-স্বরূপ-আদর্শ উপস্থাপন করেছেন। তিনি সত্যিকারভাবে বাঙালির চেতনার কবি।
নবজাগ্রত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণীর চৈতন্যের রূপকার এই রোমান্টিক কবি। তাঁর সৃষ্টিতে বিষয়ের বৈচিত্র্য আর পরিবশেন-ভিন্নতা পাঠককে মোহিত করে। ব্যক্তিক অস্তিত্বের অব্যাহত প্রতিধ্বনি আর আত্ম-উপলব্ধির প্রখরতায় তিনি স্বতন্ত্র এক কণ্ঠস্বর। নজরুলের অবির্ভাব এমন এক সমাজ-প্রতিবেশে, যখন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতনে অস্থির ও অসহনীয় ভারতের সাধারণ মানুষ। তখন তিনি স্বভাবতই মানবতাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। সমকালীন ভারতীয় মুসলমান সাহিত্যিকদের মতো, কাব্য-সাধনার প্রথম থেকেই নজরুল ইরান ও তুরস্কের প্রতি মনোযোগী ছিলেন—এটি তাঁর চেতনার একটি বিশেষ দিক। সম্ভবত ইসলামি চেতনার প্রতি বিশ্বস্ততাই তার প্রধান কারণ। কাজেই তাঁর কবিতায়, কথাসাহিত্যে, গানে ইসলামি ঐতিহ্য ও চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে অনিবার্যভাবে।
কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রায় শুরুতেই, ১৯২০ সালে নজরুল লেখেন ‘খেয়াপারের তরণী’। আর তখন থেকেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রতি তাঁর বিশেষ সম্মান ও নির্ভরতা প্রকাশ পায়। কবিতাটিতে তিনি লিখেছেন—‘নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতেও;/ কাণ্ডারী আহমদ, তরী ভরা পাথেয়!/ আবুবকর উস্মান উমর আলী হায়দর/ দাঁড়ি যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর!/ কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা / দাড়ি-মুখে সারি গান—লা শরীক আল্লাহ্!’—এই যে অবিচল-অশেষ আস্থা মুহাম্মদের প্রতি, সৃষ্টিকর্তার প্রতি, তা সম্প্রসারিত হয়েছে নজরুলের পরবর্তী চিন্তাধারায়। ১৯২০ এ ১৯২১-এ মহানবীর জন্ম ও মৃত্যু বিষয়ে লিখেছেন পূর্ণাঙ্গ কবিতা—যথাক্রমে ‘ফাতেমা-ই-দোয়াজ দহম (আবির্ভাব)’ এবং ‘ফাতেমা-ই-দোয়াজ দহম (তিরোভাব)’। উপরিউক্ত তিনটি কবিতাই ছাপা হয় মোসলেম ভারত-এ। মরু-ভাস্কর (প্রথম প্রকাশ: ১৯৩০, প্রথম কবিতা ‘অবতরণিকা’ মাসিক সওগাত পত্রিকায় ‘মরু-ভাস্কর’ শিরোনামে বেরিয়েছিল; গ্রন্থাকারে প্রকাশ: ১৯৫০, প্রভিন্সিয়াল বুক ডিপো, ঢাকা) নামক কাব্যে আমরা পাই মহানবীর পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত। গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ ও সরবরাহ করেছিলেন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ। সওগাত-এ কবিতাটির পাশে তারকা-চিহ্ন দিয়ে পাদটীকায় সম্পাদক লিখেছেন—‘কবি হযরত মোহাম্মদের (দ.) জীবনী কাব্যে লিখিতেছেন, এই কবিতাটি তাহার পূর্বাংশ। ’
মরু-ভাস্কর চারটি সর্গে বিভক্ত। কবিতা সংখ্যা সর্বমোট ১৮। প্রথম সর্গে নবীজির আবির্ভাবকাল, দ্বিতীয় সর্গে তাঁর শৈশব, তৃতীয় সর্গে কৈশোর এবং চতুর্থ ও শেষ সর্গে সংসার-জীবন এবং বিশ্ব-মানবতার জন্য সংগ্রামের প্রারম্ভকথা স্থান পেয়েছে। গ্রন্থটি রচনার জন্য বিপুল প্রস্তুতি ও আয়োজন সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত মহানবীর জীবনের মাত্র ২৫ বছরকাল কবি রূপায়িত করতে পেরেছেন। নজরুল-প্রকাশক ‘শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী অ্যান্ড সন্স’-এর প্রধান নির্বাহী মনোরঞ্জন চক্রবর্তীর আগ্রহে নজরুল মরু-ভাস্কর লিখেছেন বলে জানা যায়। তিনি সেই সময়ে—১৯৩১ সালে, মনোরঞ্জনের আতিথেয়তায় কিছুকাল দার্জিলিঙ এবং শিলঙে অবস্থানও করেছিলেন। তখন, দার্জিলিঙে রবীন্দ্রনাথ এবং সাহিত্যিক জাহানারা বেগম চৌধুরীর সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়েছিল। যাইহোক, গ্রন্থটির প্রথম কবিতা ‘অবতরণিকা’ আরম্ভ-অংশ থেকে কিছুটা পাঠ নিয়ে আমরা বর্তমান আলোচনার ভেতরে প্রবেশ করি—
জেগে ওঠ তুই রে ভোরের পাখি,
নিশি-প্রভাতের কবি!
লোহিত সাগরে সিনান করিয়া
উদিল আরব-রবি।
ওরে ওঠ তুই, নূতন করিয়া
বেঁধে তোল তোর বীণ্!
ঘন আঁধারের মিনারে ফুকারে
আজান মুয়াজ্জিন। ...
দখিনে ভারত-সাগরে বাজিছে শঙ্খ, আরতি-ধ্বনি,
উদিল আরবে নূতন সূর্য—মানব-মুকুট-মণি।
সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য নতুন বারতা নিয়ে হাজির হয়েছেন ‘আরবের রবি’ মুহাম্মদ। তাঁর আগমন-বার্তার আওয়াজ যেন সর্বত্র-প্রসারিত। বিশ্বময় মানুষ যখন স্বপ্নঘোর, তখন শস্য-কুসুমের ডালি নিয়ে আবির্ভুত হলেন তিনি—মহানবী সম্বন্ধে এই হলো নজরুলের পর্যবেক্ষণ। কবি অনুভব করতে পেরেছেন, মহানবীর আবির্ভাব-আলোকে পৃথিবী জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছে। আরব দেশে ‘অনাচার মিথ্যা পাপের নিপীড়ন-উৎসবে’ সমাজ-রূপান্তরের সুরের বীণা আর আগুনের-আবেশ নিয়ে যে মহামানবের আগমন, তাঁর প্রতি কবির শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হয়েছে এভাবে—
বাদলের নিশি অবসানে মেঘ-আবরণ অপসারি,
ওঠে যে সূর্য—প্রদীপ্ততর রূপ তার মনোহারী।
সিক্তশাখায় মেঘ-বাদলের ফাঁকে
‘বৌ কথা কও’ পাপিয়া যখন ডাকে—
সে গান শোনায় মধুরতর গো সজল জলদ-চারী!
বর্ষায়-ধোওয়া ফুলের সুষমা বর্ণিতে নাহি পারি!
কবি ও সাহিত্য-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মরু-ভাস্কর সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন—‘অলংকারের স্ফুলিঙ্গ-বৃষ্টি। ’ নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা যায়—সাম্যবাদী কবি, সত্যনিষ্ঠ কবি নজরুল এখানে অনেকটা আবেগাপ্লুত হলেও সত্যের অপলাপ বা যুক্তিহীনতায় নিপতিত হননি। মহানবীর জীবনী বর্ণনায় সত্যের প্রতি অবিচল ও নিষ্ঠাবান ছিলেন তিনি। আর তা পরিবেশনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর ভঙ্গিকে আশ্রয় করেছেন। শৈল্পিক-সাহিত্যিক আভিজাত্য যেন নমিত না হয়, সেদিকে তাঁর সচেতন দৃষ্টি ছিল। ইতিহাসের প্রসঙ্গতে, ঐহিত্যকে তিনি সাজিয়েছেন সাহিত্যের সাদা কাগজে। কল্পনার রঙ—কবি-কল্পনা সেখানে প্রযুক্ত হলেও মিথ্যার আশ্রয় নেই। এ প্রসঙ্গে ছন্দ-বিশারদ আবদুল কাদিরের মন্তব্য তুলে দিচ্ছি—‘আমাদের পরম প্রিয় কবি নজরুল ইসলাম তাঁর “মরু-ভাস্কর” কাব্যে হজরতের আবির্ভাব থেকে নবুওত প্রাপ্তি পর্যন্ত ঘটনাবলী ১৮টি খণ্ডে কবিতায় বিবৃত করেছেন, কিন্তু তা-ও অসম্পূর্ণ। তবে নজরুলের কাব্যখানির সার্থকতা এ জন্য যে, তাতে মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও ছন্দের নানা বিচিত্র ভঙ্গি তাঁর অসামান্য ভাবের উপযুক্ত বাহন হয়েছে। ’ (‘হজরত মোহাম্মদ কাব্য’, মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ১৯৮৯)
হযরত মুহাম্মদের (স) জীবনী লেখার জন্য নজরুলের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছিল। আর সমকালীন মুসলিম সাহিত্য সমাজের চিন্তার দিকেও মনোযোগী নজর ছিল তাঁর। বিষয়ের কারণেই গ্রন্থটিতে আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ করেছেন বেশি। তবে সেগুলোর অধিকাংশই সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের পরিচিত শব্দ। তাই কাব্যটি পাঠের ক্ষেত্রে কোনওরকম দুর্বোধ্যতা তৈরি হয়নি। লক্ষণীয় বিষয়—নজরুল তাঁর কবিতার মূল সুর ‘সর্বহারা’ এবং ‘সাম্যবাদী’ প্রবল সতর্কতার সাথে মরু-ভাস্কর-এও প্রয়োগ করেছেন। দ্বিতীয় সর্গে ‘সর্বহারা’ আর চতুর্থ সর্গে ‘সাম্যবাদী’ শিরোনামের দুটি ভিন্ন কবিতা বিশেষ অভিনিবেশের কারণ। সর্বহারাদের যাতনা দূর করার যে প্রত্যয় নজরুলের কবিতায়, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার যে লড়াই তিনি করে গেছেন সারাজীবন, তার সাথে মহানবীর জীবন ও সংগ্রামের এই যে অপূর্ব সাদৃশ্য-তুলনা, তা সত্যিই বিস্ময়কর। এমনকি মহানবীর ব্যক্তিগত মহান দারিদ্র্যের সাথে নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতার অভিব্যক্তিরও সুন্দর সাদৃশ্য আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। তাহলে কি নজরুল এই মহামানবের জীবনদর্শন ও বাণীকেই ধারণ করেছিলেন চিন্তা ও চর্চার সমস্ত প্রহর জুড়ে? তাঁর সাহিত্য-সাধনা কি সত্যিই সত্য ও সুন্দরের পথে পরিচালিত হয়েছিল মহানবীর জীবনযুদ্ধ ও অর্জনের অনুপ্রেরণা থেকে? প্রসঙ্গত, আমরা কবিতা দুটি থেকে কিছুটা পাঠ নিতে পারি—
১।
সকলের তরে এসেছে যে জন, তার তরে
পিতার মাতার স্নেহ নাই, ঠাঁই নাই ঘরে।
নিখিল ব্যথিত জনের বেদনা বুঝিবে সে,
তাই তারে লীলা-রসিক পাঠাল দীন বেশে!
আশ্রয়হারা সম্বলহীন জনগণে
সে দেখিবে চির-আপন করিয়া কায়মনে—
বেদনার পর বেদনা হানিয়া তাই তারে
ভিখারি সাজায়ে পাঠাল বিশ্ব-দরবারে!
(‘সর্বহারা’)
২।
আদি উপাসনালয়—
উঠিল আবার নূতন করিয়া—ভূত প্রেত সমুদয়
তিন শত ষাট বিগ্রহ আর মূর্তি নূতন করি’
বসিল সোনার বেদীতে রে হায় আল্লার ঘর ভরি।
সহিতে না পারি এ-দৃশ্য, এই স্রষ্টার অপমান,
ধেয়ানে মুক্তি-পথ খোঁজে নবী, কাঁদিয়া ওঠে পরান।
খদিজারে কন—“আল্লাতালার কসম, কাবার ঐ
‘লাৎ’ ‘ওজ্জা’র করিব না পূজা, জানি না আল্লা বই!
নিজ হাতে যারে করিল সৃষ্টি খড় আর মাটি দিয়া
কোন্ নির্বোধ পূজিবে তাহারে হায় স্রষ্টা বলিয়া। ”
সাধ্বী পতিব্রতা খদিজাও কহেন স্বামীর সনে—
“দূর কর ঐ লাত্ মানাতেরে, পূজে যাহা সব-জনে।
তব শুভ-বরে একেশ্বর সে জ্যোতির্ময়ের দিশা
পাইয়াছি প্রভু, কাটিয়া গিয়াছে আমার আঁধার নিশা। ”
(সাম্যবাদী)
মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস এবং সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি বিষয়ে নিঃসংশয়বাদ কবি-চেতনাকে আলোড়িত করেছে সব সময়। কবি নজরুলের সবচেয়ে আবেদন-সৃষ্টিকারী কবিতা ‘বিদ্রেহী’তেও আছে সেই অনুভবের স্বীকৃতি। ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ’ কিংবা ‘আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!’—সম্ভবত সেই প্রত্যয় ও সত্যনিষ্ঠারই বহির্প্রকাশ। নজরুল-সাহিত্যে ধর্ম-প্রসঙ্গ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, মানুষ আর ধর্ম তাঁর কাছে একার্থবোধক। মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ-প্রতিষ্ঠায় নজরুলের শ্রদ্ধা যেমন অপরিসীম, তেমনই তাঁর স্রষ্টাভাবনাও মানবতাবাদের পরিপোষক।
তাঁর দৃষ্টিতে আল্লাহ্ হচ্ছেন—‘আল গফুরুর ওদুদ’, ‘আল-ফাজালিল আজিম। ’ তবে ধর্মের নামে গোঁড়ামিকে কখনওই তিনি স্বীকার করেননি। তাঁর এই বিশ্বধর্মবোধ ও মানবতাবাদের চিত্র কেবল মরু-ভাস্কর রূপায়নের ভেতর দিয়েই নয়; বরং কবিতা-কথাসাহিত্য-প্রবন্ধ-গান—সমগ্র সাহিত্য-পরিসর জুড়েই প্রসারিত। নিজস্ব ধর্মচিন্তার দর্শনকে আশ্রয় করে তিনি মরু-ভাস্কর-এর মাধ্যমে মহানবী মুহাম্মদ (স)-এর বার্তাকেই কেবল মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪২ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৫