প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় আলীমকে দেখতে হাসপাতালে যাই। বাইশ বছরের বন্ধুত্ব আমাদের।
তিলোত্তমা তাকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে, কথাগুলি বলতে বলতে আলীমের দু’চোখ পানিতে ভরে ওঠে। সন্তানদের কাছে শোনে তাদের মা প্রায় প্রতিসন্ধ্যায় বেরিয়ে যায়। কখনও রাতে বাড়ি ফেরার পথে তাকে হাসপাতালে দেখে যায়। আলীম বলে, “কি নিখুঁত তার সাজগোজ, চোখে আইলাইনার, পাপড়িতে মাসকারা। চেষ্টা করে আমার সাথে প্রগলভ আর আন্তরিক হতে। সম্ভবত অপরাধবোধ থেকে করে। তিলোত্তমাকে শেষমেষ আমি মাফ করে দেই। আমার ক্যান্সার ধরা পড়ার শুরুর দিনগুলোতে তিলোত্তমা উন্মাদের মতো অস্থির ছিল, আমাদের উত্তরার ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল আমাকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠাতে। ”
আমি বলি, “হ্যাঁ, আমারও মনে পড়ে তিলোত্তমা ভেঙ্গে পড়েছিল। ” আলীম বলে, “তিলোত্তমাকে নিয়ে আমার মা, ভাই-বোনেরা যখন বাজে মন্তব্য করে—আমার ভালো লাগে না। টানা তিনচার বছর ধরে আমাকে নিয়ে হাসপাতালে টানাটানি আর হতাশা তাকে ক্লান্ত করে তুলেছে। ”
মৃত্যুর আগে আলীম কালো মলাটবাঁধা একটা ডায়রি আমার হাতে তুলে দেয়। আমি জিজ্ঞাসা করি, এটা কি তোর ডায়রি নাকি ক্রিয়েটিভ রাইটিং? সে হেসে বলে, ডায়রি বা আত্মজীবনীও তো ক্রিয়েটিভ রাইটিং, তাই না?
ডায়রির প্রথম পৃষ্ঠায় পাবলো নেরুদার কবিতা, পরপর কয়েক পৃষ্ঠায় তার প্রিয় কবিতা এবং কোটেশন। তারপর বেশ অনেক পৃষ্ঠা টানা টেক্সট:
বর্ষাকালে সুনামগঞ্জের এসপি সহ টাঙ্গুয়ার হাওর, যাদুকাটা নদী ঘুরে ট্যাকেরঘাট পৌঁছাই। প্রায় বিকাল হয়ে গেছে তখন। এককালে এখানে চুনা পাথর উত্তোলন প্রকল্প ছিল। এখানে মানুষ গমগম করতো, চুনা পাথর প্রকল্পের ম্যানেজার, শ্রমিক, কর্মকর্তা নানা শ্রেণীর মানুষ । চারপাশে উন্মুক্ত, অবারিত লালচে পাথুরে মাঠ, পাথুরে পাহাড় আর পুরানা পরিত্যক্ত লাল দালান। বিকালে পুলিশ সুপার মাহমুদ সহ পুরো এলাকা হেঁটে বেড়াই। সন্ধ্যায় পুলিশ ফাঁড়ির অদূরে ঘাসের মখমলে ছাওয়া খোলা মাঠে চেয়ার পেতে বসি। আমগাছের অন্ধকারে তাকিয়ে বিয়ের আগে আমার দীর্ঘদিনের প্রেমিকা নাঈমার গল্প করি। মাহমুদের বড় ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। পরে মাহমুদের সাথে সম্পর্ক তার বড় ভাইয়ের চেয়েও বেশি গাঢ় হয়।
নাঈমারা নাটোরে মাহমুদদের পড়শী ছিল বহু বছর। আড্ডার সুবিধার জন্য আর্দালি, বডিগার্ড সবাইকে দূরে পাঠিয়ে দেই। অন্ধকারে আমাদের সিগারেটের টকটকে লাল আগুন জ্বলতে থাকে। কয়েকটা গাছে অগনিত জোনাকপোকা ঝিকমিক করে । রাতজাগা পাখির তীক্ষ্ণ কণ্ঠ সন্ধ্যার নিস্তব্ধতায় মিলিয়ে যায়। আঁধার ফুঁড়ে দাড়িওয়ালা একজন প্রৌঢ় আমার ঠিক গলার কাছে চাপাতি ধরে বলে, “একটা শব্দ করবি না, করলে এক্ষুণি লাশ পড়ব। ” আরও আট দশজন লুঙ্গিপরা মানুষ আমাদের ঘিরে ধরে। কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মুখ, হাত, বেঁধে তাদেরকে অনুসরণ করতে বলে। এদের সাথে অন্ধকারে ঠিক কত মাইল হেঁটে যাই ঠাহর করতে পারি না।
আমাদের মুখ, হাতের বাঁধন যখন খুলে দেয়া হয় তখন ভোর হয়ে গেছে। চারপাশে পাথুরে মাঠ আর পাহাড়। যারা আমাদের ধরে নিয়ে এসেছে সবাই লুঙ্গিপরা, চোয়ালভাঙ্গা, জীর্ণ, অপুষ্ট তরুণ, পৌঢ়, যুবক—নানা বয়সী লোকজন। পান খাওয়া জীর্ণ প্রৌঢ় মানুষটি আমাকে বলে, “এইবার আমরা তুমরার বিচার করমু। ” সম্ভবত সে দলের প্রধান। মাহমুদ ফিঁসফিঁসিয়ে বলে, “এই ফকিরের বাচ্চাগুলা কী কারণে আমাদের এখানে নিয়া আসছে? পান দোকানদার, রিকশাওয়ালা, পিয়ন মার্কা চেহারা এদের । এইখান থিকা শুধু বের হই, সবগুলা বাস্টার্ডকে ক্রসফায়ারে দিব। ”
পাথুরে মাঠের অদূরে একটা জলাভূমি। অর্ধেক শরীর ডোবানো প্রকাণ্ড একেকটা গাছ গুম হয়ে বসে আছে জলাশয়ের এখানে সেখানে। জলের ধারে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে আধা উলঙ্গ নারী পুরুষেরা। এদের বেশিরভাগেরই শীর্ণ শরীর, দরিদ্রক্লিষ্ট মুখ। মাঝে মাঝে তারা উলুধ্বনি দেয়, তাদের কণ্ঠস্বর ফেটে পড়ে উৎসবের আমেজে। এইসব উৎসব-উল্লাসের মাঝে নতমুখে মাটি খুঁটছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিন, তার পাশে এসপি রুম্মান, জেলা জজ রাকিব ভাই, চেনামুখ সাংসদ—এমন কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা এবং তরুণ রাজনীতিবিদ বসে আছেন। আমিনের মলিন পোশাক, দীর্ঘদিন শেভ না করা কাঁচা পাকা দাড়ি। যখন চিটাগাংয়ে আমার পোস্টিং ছিল, আমিন ছিল সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি ইউনিটে কমান্ডিং অফিসার । আমার সাথে চোখাচোখি হতে আমিন চোখের ইশারায় তার পাশে যেতে বলে। “এখানে প্রতিদিন তামাশা চলে, এক বেশ্যা প্রতিদিন বিচার করতে বসে। চোর ডাকাত ছ্যাচোড়রা সাক্ষী দেয় দিনমান। সাংসদ, মন্ত্রী, মিলিটারি অফিসার, পুলিশ, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট সবার বিচার করে এইসব চোর ছ্যাচোড় আর বেশ্যারা। এখানে খাবার বলতে কলা। কোত্থেকে বিশাল বিশাল কলার কাদি ফেলে রাখবে কে জানে, পানি খেতে হলে ওই জলাশয়ের পানি খেতে হবে। ” আমিন বলে।
বিচারকের আসনে একটা বড় পাথরের উপর উঠে বসে প্রধান বিচারক লিন্ডা রহমান। ডাকসাইটে সুন্দরী। উন্নত নাক, কোমর ছাপানো দীর্ঘ চুল, টকটকে ফর্সা মুখে উজ্জ্বল, আকর্ষণীয় একজোড়া চোখ। তিনি ঢাকা শহরের নামকরা পতিতা ছিলেন। বিরোধী দলের এক নেতার বান্ধবী হবার কারণে পুলিশ তাকে পতিতাবৃত্তির দায়ে জেলে পাঠায়। দুর্নাম আশংকায় বিরোধী দলের নেতা যিনি একজন বিখ্যাত লেখকও—লিন্ডার জামিন পেতে কোনও ধরনের চেষ্টা তদবির করে না। এমনকি লিন্ডার পুত্র, কন্যা ওই রাজনৈতিক নেতাকে ফোনে যোগাযোগ করলে তার অফিসে, বাড়িতে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি লিন্ডার সন্তানদের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করেন।
দীর্ঘদিনের প্রণয়, দম্পতির মতো সম্পর্ক রক্ষা করে শেষকালে প্রেমিকের বেঈমানি লিন্ডা মেনে নিতে পারেননি। জেলখানায় আত্মহত্যা করেন। লিন্ডা একজন গায়িকাও ছিলেন। প্রতি ভোরে নিয়ম করে গানের রেওয়াজ করতেন। বিচারকের আসনে বসেও প্রতিদিন চার পাঁচটা রবীন্দ্রসংগীত অথবা নজরুলগীতি গেয়ে শোনান বাদী, বিবাদি, আসামী সবার উদ্দেশ্যে। কোনও কোনও গান তার রাজনীতিবিদ প্রেমিকের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। গাইতে গাইতে বিচারকের আসনে বসেই কখনও অঝোরে কাঁদেন। বিচার শুরু করার ঠিক আগে তিনি পুলিশ, আমলা, মন্ত্রী, এমপি সবাইকে তাদের পিতা, মাতা, বোন, ভাগ্নি, কন্যা সবার নাম নিয়ে অকথ্য গালাগাল করেন।
বাদী হাফিজুর রহমান। মায়াবী একজোড়া চোখের কুচকুচে কালো রংয়ের পনের বছর বয়সী কিশোর। পুলিশ ইন্সপেক্টর হামিদের দিকে অভিযোগের তীর। ...
ই-ম্যাগাজিন থেকে পুরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন। অথবা বাজার থেকে ম্যাগাজিনের হার্ডকপি সংগ্রহ করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৫