মহিলার সঙ্গে কথা বলবার কোনো দরকার নেই, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই ক্যাভালিয়েরে ক্যভারাডোসি নিজের ওপর তার সব নিয়ন্ত্রণই হারিয়ে ফেলেছে। লোকটার মতামত, তার সন্দেহজনক বন্ধুত্ব, আর এখনকার এই ঈশ্বরনিন্দুক অঙ্গভঙ্গি... আমার ভয় হচ্ছে, হায়রে, সেদিন বুঝি খুব বেশি দূরে নয় যেদিন বিশিষ্ট এই ক্যাভালিয়েরেকে স্বর্গের দরজায় সঙ্গ দেয়াই আমার একমাত্র কাজ হবে।
এর মাঝে সত্য হলো এই যে, তার পদমর্যাদার একটা লোক চিত্রকরের দক্ষতা দেখাবার জন্য, জনসম্মুখে নিজের কাজ প্রদর্শনের আগে, সর্বতভাবে আন্তরিকতার মাধ্যমে নিজের প্রতি অনুরক্ত থাকা উচিত, এটা আপনা থেকেই স্বাভাবিকতার ব্যত্যয়, আর তাই অনুচিতও। অন্তত যেখানে তাকে ধর্মীয় বিষয়াদিতে বিরত থাকা উচিত, কিন্তু না, সে তার প্রেমিকাকে ঈশ্বরের গৃহে স্থাপন করতে ইচ্ছুক, একটা বেদির ওপর ওকে রেখে, এবং তার চেয়ে বড় কথা হলো তাতে তার শৈল্পিক ঐতিহ্যের তাৎপর্যগত দৈন্যতাও ফুটে উঠবে। সত্যি, আমি খুব অবাক হচ্ছি, যেখানে অন্য সবাই পবিত্র কুমারী মাতার প্রতিনিধিত্ব করা জমকালো অঙ্গভঙ্গির চিত্রকর্মটিকে দেখতে পাবে, ওর কুচকুচে কালো চোখ জোড়া ঠিক লুসিফারের মতো, বরং, এধরনের তুলনার মাধ্যমে এর মডেলের প্রতি অনেক বেশি সম্মান দেখানো হবে, তারচেয়ে বরং অন্য কোনো পতিত দেবদূত কি হতে পারত না? যদি এর উদ্দেশ্য ধর্মীয় বা নৈতিক নিন্দার বিষয় হয়ে থাকে, এর ফলাফল হিসেবে, একথা বলতেও আমার কষ্ট হবে, নান্দনিকতার দিক দিয়েও এটা অপছন্দের, চিত্র প্রতিযোগিতাতে যেমনটা সব সময়ই দেখতে পাওয়া যায়, তখন সেটাকে সমর্থন জানানো উচিত এমন একটা ধারণাও আমাদের ভেতরে কাজ করে। ক্যাভালিয়েরের মাঝে ভালো জিনিসটা হলো সে তাকে একজন বিসদৃশ চিত্রকর হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে, শৈল্পিক অসঙ্গতির একজন স্রষ্টা, যেন নতুন একটা কিছু তৈরির প্রয়োজন ছাড়া আমাদের বিশ্বে এধরনের কাজের যথেষ্ট পরিমাণে অস্তিত্ব নেই।
...চলাচলের পথের সবটা খুঁটিয়ে দেখি, বন্ধ চ্যাপলসমূহের গরাদগুলোর ভেতর খুব কাছ থেকে উঁকি মেরে দেখি, পেছনে কেউ কিছু ফেলে গেল কিনা তা দেখতে বেঞ্চিগুলো সব চষে ফেলি, একটা রুমাল, একটা হাত পাখা, অথবা হতে পারে একটা রঙতুলি; অন্যভাবে বলতে গেলে আমি যেটা আগে থেকেই জানতাম তা আদৌ সত্য কিনা প্রচলিত পদ্ধতিতে সেটা খতিয়ে দেখতে চাইছিলাম, যে, সেই ক্যাভালিয়েরে ক্যভারাডোসি, সেই বিখ্যাত চিত্রকর এবং কুখ্যাত দুষ্কৃতকারী, এখানকার দেয়ালের আড়ালে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে কিনা...
কিন্তু এর সবই অপ্রাসঙ্গিক, কেননা আমি যে চার্চে যাই তারা আসলে জানেই না যে ছবিটা এরই মধ্যে প্রদর্শিত হয়ে গেছে; অন্য একটা কারণেও আমি ক্যাভালিয়েরেকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে উঠি, এবং সেটা ভুলে যাওয়া আর তাকে খুঁজবার কথা চিন্তা না করে সেখান থেকে চলে যাওয়া ছিল আমার ওপর তার চূড়ান্ত অবহেলার নজির। তাই আমার অফিসকে অপ্রশম্য ঐকান্তিক উৎসাহ নিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হয়, এবং একইভাবে বাকি আরো যাদের সন্দেহ হয় তাদের বিরুদ্ধেও, যেহেতু অপরাধ সংক্রামক রোগের মতো, ক্যানসারের মতো, এবং আরো বেশি এলাকা জুড়ে এর ছড়িয়ে পড়া রোধে জায়গাটাকে আলাদা করার মতো কঠোর পদক্ষেপের নেবার জন্যে আদেশ জারি করবার প্রয়োজন দেখা দেয়। তারপরও, নিয়ন্ত্রণহীন নিষ্ঠুরতার বোধ, যার দ্বারা আমি আগেও আক্রান্ত হয়েছি সেই সংস্কারদূষণ আমার দায়িত্ব অবহেলার খুব ভালো একটা ছুতা হতে পারত। চার্চটা ছিল অন্ধকার, গির্জার মূল অংশে বা এর প্রধান বেদির সামনে প্রার্থনারত অবস্থায় কেউই ছিল না, কেবল গোটা কতক দীপের আলো অন্ধকার ভেদ করে সোনালি বিন্দুটাকে মলিনভাবে দীপ্তিময় করে রেখেছিল। যে কেউ এক কথায় বলে দিতে পারবে সেখানে জীবিত কেউই ছিল না, বেশির ভাগ সময়ই এর চারপাশটা এমনই থাকে, কারণ এটা এমন একটা চার্চ যেখানে লোকজনের যাতায়াত একেবারেই কম। সদর দরজা থেকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ জমকালো একটা কুঞ্জপথ রয়েছে, খোলা থাকলেও সেটা এতটাই সরু যে কোনো বাহন যাতায়াতের জন্য যথেষ্ট নয়, অন্যদিকে সবদিক থেকে গির্জাটা ঘরবাড়ির ভাঙ্গা দেয়াল দিয়ে ঘেরা যে আমি সেখান দিয়ে ঢুকবার সময় ঈশ্বর হয়ত আমাকে দেখে থাকবেন এমন কথা ভাবলেও মনে বিস্ময় জাগে, নতুবা এমনও হতে পারে তিনি নিজেই এর অস্তিত্ব সম্বন্ধে অবহিত নন বা এর কথা ভুলে বসে আছেন। বিকেলের শুরু থেকে সান্ধ্য প্রার্থনার আগপর্যন্ত উত্তপ্ত আরো কতগুলো দীর্ঘ ঘণ্টা পার করতে হবে, যে সময়টাতে, একরাশ রোদের আলোয় ছেয়ে থাকা আকাশের নিচে, কেবল পুলিশ আর ষড়যন্ত্রকারীদের পাথরে বাঁধানো তাপে দগ্ধ পথের ওপর স্পর্ধ ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাবে। কিন্তু অভ্যাসবশতই লোকেদের খোঁজার ব্যাপারে আমি একজন পাকা শিকারি এবং সাহসের সঙ্গে আমি একথাও বলে দিতে পারি, পেশার কারণেই; আমি আমার শিকারের উপস্থিতি টের পাই, বিশেষ করে ওরা যখন লুকিয়ে থাকে, ঠিক যে বোধশক্তির কারণে শিকারের সময় কুকুর গন্ধ শুকে তার শিকারকে খুঁজে পেতে পারে, সেকারণেই আমিও বুঝতে পারি, চারিদিকে সুনসান নীরবতা টের পাবার পরও, চার্চটা মোটেই খালি নয়। চলাচলের পথের সবটা খুঁটিয়ে দেখি, বন্ধ চ্যাপলসমূহের গরাদগুলোর ভেতর খুব কাছ থেকে উঁকি মেরে দেখি, পেছনে কেউ কিছু ফেলে গেল কিনা তা দেখতে বেঞ্চিগুলো সব চষে ফেলি, একটা রুমাল, একটা হাত পাখা, অথবা হতে পারে একটা রঙতুলি; অন্যভাবে বলতে গেলে আমি যেটা আগে থেকেই জানতাম তা আদৌ সত্য কিনা প্রচলিত পদ্ধতিতে সেটা খতিয়ে দেখতে চাইছিলাম, যে, সেই ক্যাভালিয়েরে ক্যভারাডোসি, সেই বিখ্যাত চিত্রকর এবং কুখ্যাত দুষ্কৃতকারী, এখানকার দেয়ালের আড়ালে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে কিনা, নাকি আমার পায়ের শব্দে সচকিত হয়ে ব্যাটা এরই মধ্যে ভেগেছে। সত্যি বলতে কী, কোনো পাপী এখান থেকে চলে যাবার পরও কিছু সময়ের জন্য সেই অধিভৌতিক ঘ্রাণ থেকে যায়, একারণেই এরইমধ্যে আমি অনেক পাপীকে বিচারের জন্য হস্তান্তর করে স্বর্গীয় অনুকম্পার প্রতি তাদের আত্মাকে বিশ্বাস স্থাপন করাতে পেরেছি, এবং আমি এখন নিঃসন্দেহে ক্যাভালিয়েরে ক্যভারাডোসির ঘ্রাণ পাচ্ছি, অথবা এমন কিছু একটার গন্ধ যা এখন এমন একটা জিনিসের ভেতর থেকে প্রবাহিত হয়ে আসছে যা তার খুব অন্তরঙ্গ ছিল। যদিও সে সম্পর্কে আমি কেবল এইমাত্র নিশ্চিত হলাম।
আমি প্রথম চ্যাপলের বাম পাশের বসার জায়গাটার কাছে একটা গেট খোলা দেখতে পাই, এবং, যাতে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে না উঠে তাই যতটা সাবধানে পারা যায়, আমি ভেতরে ঢুকি; সেখান থেকে, গরাদের ভেতর দিয়ে, সেগুলো একটা থেকে আরেকটা বিচ্ছিন্ন আর খানিক দূরে দূরে অবস্থিত হওয়াতে, আমি দৃষ্টির বাইরে অবস্থান করেও, চ্যাপেলের পুরো সারিটা দেখতে সক্ষম হই। অন্ধকারের কারণে আমাকে কোনো সমস্যা পোহাতে হয় না, কারণ এটাই আমার স্বভাব, যদিও এর মাঝে তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তিসম্পন্ন কুকুরের মতো একটা দিক আছে, বাকিটা বিড়াল এবং এর অন্যান্য প্রজাতির ধূর্ততার সঙ্গে অনেক বেশি মিলবে, আর তাই আমি আমার পার্থিব কাজকারবার খুব সহজেই করতে পারি, ঈশ্বর আমাকে এমন এক জোড়া চোখ দিয়েছেন যার সাহায্যে আমি অন্ধকারেও সব কিছুর অবয়ব আর নড়াচড়া টেরপাই। গেট পার হবার পরপরই আমি বুঝতে পারি যে এই অংশগুলোর সাহায্য নেয়া আমার দরকার হবে না: লাগোয়া চ্যাপলে বেদির পাশে প্রদীপের দীর্ঘ সারি, এবং প্রথম বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে বসে থাকা, মহিলার মুখটা প্রায় শিখা ছুঁই ছুঁই অবস্থা, এই কি সেই, ফ্লোরিয়া টোসকা, সেই গায়িকা। সম্ভবত ক্যভারাডোসি তার রঙতুলি, রুমাল বা ব্যবহৃত কোনো কিছুর বদলে ওকেই এখানে ফেলে রেখে গেছে। আমি একে অনুকূল একটা সুযোগ হিসেবে গণ্য করি, কেননা বোবা কোনো আলামতের চেয়ে কথা বলতে পারে এমন একটা আলামত থেকে নিঃসন্দেহে দ্বিগুণ সুবিধা পাওয়া সম্ভব, যদি ভালোভাবে সেটা কাজে লাগানো হয়।
আমি ওকে আগেও কোথাও দেখেছি, পথেঘাটে, নতুবা অভিজাত বাড়িগুলোর কোনো অভ্যর্থনা কক্ষে যেখানে সে তার স্বরের প্রতিভা কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, কিন্তু ওর সঙ্গে কখনোই আমার কথা হয়নি, সেইসব মোহগ্রস্ত লোকেদের ভিড়েও আমার যোগ দেয়া হয়ে ওঠেনি যারা প্রতিবার নাটকের টিকেটে তার নাম দেখার পর ওর প্রশংসা করার জন্য থিয়েটারের দিকে ছুটেছে। এবার ঘটনাক্রমে আমাকে ওর মুখোমুখি হতে হবে এবং ওকে প্রশ্ন করতে হবে। এর সঙ্গে দায়িত্ব পালনের বিষয়টিও জড়িত। সেইসঙ্গে, এই চিন্তাও আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে না, অবশ্য আগে থেকেই সেটা আমার জানা কিভাবে ওর মন্ত্রমুগ্ধ স্বরের যাদু প্রতিরোধ করতে হবে, সেটা জয় করে, তারপরই কেবল ওর গোপন করতে চাওয়া সব কথা আমার কাছে প্রকাশের জন্য প্ররোচিত করার নিগূঢ় কৌশল প্রয়োগ করা যাবে।
এমনকি ওর বাইরের ঠাটবাটের মাদকতাও আমাকে খুব একটা সমস্যায় ফেলতে পারেনি; এর সব কিছুই আমাকে সব সময় নিরুৎসুক রেখেছে, এবং প্রচলিত ধারণা থেকেও দূরে রেখেছে, এমনকি তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করবার কাজটাও আমি নিজের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। নারীর সৌন্দর্য হলো ঐকতান, সৃষ্টির ঐকতানের এক নির্মল আয়না, কিন্তু সেই তুলনায় টোসকা পুরোটাই অনৈক্য আর অস্থির। কালো চুলের কারণে অতিমাত্রার এক আভাস যা ওর মলিন মুখের ওপর মুকুটের মতো অবস্থান করে, সেই কৃষ্ণতা এতই গভীর যেন যারা এর দিকে তাকিয়ে থাকবে তারা নিজেদের ভেতরকার নির্দিষ্ট এক বিস্বাদকেই প্ররোচিত করবে, তাঁর আকুল চোখের আভাস তাদের কাছে অনেকখানি বেড়ে যাবে, যেন সে অদৃশ্য কোনো সহচরকে সঙ্গে নিয়ে বল্গাহারা প্রবল অনুরাগে সর্বদাই একাগ্রচিত্তে গেয়ে চলেছে। এর সব কিছুকে যেন আমাদের সময়ের সঙ্গে মানানসই বলেই মনে হয়: এমন মনে হচ্ছে, যেন স্বাভাবিক গুণের সাবলীলতার প্রতি, লোকেদের একটা বিবমিষা রয়েছে, যা কোনো অরুচিকর বোধের মতো নিদারুণ তাচ্ছিল্য, এবং তা খুঁত, ভালো ব্যবহারের সীমা ছাড়ানো আচরণ এবং কোনো আভ্যন্তরীণ বিকৃতির বদলে ব্যাধিগ্রস্ত আকর্ষণের খোঁজ করে বেড়ায়।
...তার এই উচ্ছৃঙ্খল কাজকারবার, ঈশ্বরভীতি আর অনুশোচনার মাঝে গমনাগমনের মাধ্যমে, সম্ভবত সে নিজেকে এমনভাবে ঠকাচ্ছে যেন এভাবে সে পরম পিতাকে ধোঁকা দিতে পারছে, অথবা সম্ভবত এরই মধ্যে যারা তার স্বভাবের, তাদের থেকেও নতুন কোনো পার্থক্য যোগ করার মাধ্যমে সে কেবল নিজস্ব আবেদন বাড়াবার আশা করছে, যাতে নিঃসন্দেহে বিক্ষিপ্তচিত্তে, কৃত্রিম উপায়ে তার স্রষ্টার নজর কাড়ার উদ্যোগটাকে চাঙ্গা করতে পারে...
এবং তারপরও সেই মুহূর্তে, ওকে প্রার্থনায় মগ্ন দেখতে পেয়েও, আমি ভিন্ন দৃষ্টিতে টোসকাকে অবলোকন করা থেকে নিজেকে সংবরণ করতে পারি না। আমি পা টিপে গরাদের সামনে গিয়ে হাজির হই, যেন সে আমার উপস্থিতি টের না পায়। তার অবয়ব অন্ধকারের মাঝে বিলীন হয়ে আছে, বেদির সামনে জড়ো হয়ে থাকা দীপ সারির লালচে আভায়, কেবল তার মিলিত হাত জোড়া আর মুখটা বেরিয়ে রয়েছে, এবং সেই দৃশ্য দেখে আমার মনে হতে থাকে সেখানে যেন আমি এমন এক অভিব্যক্তির খোঁজ পেয়েছি যা নির্মল স্বর্গসুখের অনন্য মিষ্টতায় ভরপুর।
আমি এই টোসকার কথাই শুনেছি, যে অনৈতিক জীবন সে যাপন করে আসছে, আগে সে খুবই ধার্মিক ছিল, এক সময় বিবেকের তাড়নায় নিয়মিত সে চার্চে যেত, যদিও এই বিচারে সব সময়ই আমি এধরনের একটি অঙ্গভঙ্গি, এমন একটি মেকি আচরণের প্রতি সন্দিহান। তার এই উচ্ছৃঙ্খল কাজকারবার, ঈশ্বরভীতি আর অনুশোচনার মাঝে গমনাগমনের মাধ্যমে, সম্ভবত সে নিজেকে এমনভাবে ঠকাচ্ছে যেন এভাবে সে পরম পিতাকে ধোঁকা দিতে পারছে, অথবা সম্ভবত এরই মধ্যে যারা তার স্বভাবের, তাদের থেকেও নতুন কোনো পার্থক্য যোগ করার মাধ্যমে সে কেবল নিজস্ব আবেদন বাড়াবার আশা করছে, যাতে নিঃসন্দেহে বিক্ষিপ্তচিত্তে, কৃত্রিম উপায়ে তার স্রষ্টার নজর কাড়ার উদ্যোগটাকে চাঙ্গা করতে পারে, যখন তিনি তাকে মায়াবী এক জোড়া চোখ, গাঢ় কালো চুল আর এমন ধবধবে সাদা চামড়া দিয়েছেন। এখন এর বদলে আমি তার একটা বিশ্বাসের সত্যিকার স্ফুলিঙ্গকে চিহ্নিত করতে পেরেছি আর আমার মনে হতে থাকে যে তার ধর্মানুরাগ অর্জিত হয়েছে অসংখ্য পাপের ক্ষমা পাবার জন্যে, যাতে একদিন, সেই মহান যার অমূল্য মহিমার প্রত্যাশা করে তার অপরিবর্তনীয় বাক্যে আমি নিজেকে বিচার করার অপেক্ষায় থেকে, ফ্লোরিয়া টোসকা, সেই গায়িকা, ক্যভারাডোসির প্রেমিকাকে খুঁজে পাই, যিনি আশীর্বাদ প্রাপ্ত আত্মাসমূহের বৃত্তের মাঝে, কৌমার্যের খাদহীন স্ফুলিঙ্গ সহকারে বসে রয়েছেন।
আমি ওর দিকে এগোতে থাকি, সিদ্ধান্ত নেই এবার তার সঙ্গে তাদের থেকেও পুরোপুরি আলাদা স্বরে কথা বলব, যাদের আমি সবার প্রথমে কাজে লাগাবার কথা ভেবেছিলাম: যে তার দুষ্কর্মের স্বীকারোক্তিতে আহত হয়ে অশ্রদ্ধেয় হবার কথা বলে বেড়ায় তার বিচারক হিসেবে নয়, বরং একজন ডাক্তার তার রোগীকে যেভাবে সম্বোধন করে, অথবা একজন বোনের ভাই হিসেবে যে কিনা পতিত হবার পরও তার বোনের প্রতি খুবই প্রীতিভাজন থেকে যান। প্রার্থনার সময় তাকে বিরক্ত করব না বলে আমি সিদ্ধান্ত নিই, এবং সে আপনা থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসার আগপর্যন্ত গির্জার বসার জায়গাটাতে শ্রদ্ধাভরে অপেক্ষা করব বলে ঠিক করি।
চ্যাপেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় তার উপস্থিতি টের পাবার পর আমি এর ভেতরকার দৃশ্য দেখা বন্ধ করি। টোসকা তখনও ওর হাঁটুর ওপর, স্থির ভঙ্গিতে প্রার্থনাসঙ্গীত পাঠে ব্যস্ত। তার অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে আমি তার কাঁধ আর বেদির দিকে তুলে ধরা উঁচু মাথার আবছা একটা রেখা দেখতে পাচ্ছিলাম, বেদির কার্নিশের ওপর একটা চিত্রকর্ম দীপের আলোক প্রতিফলনে আলোকিত হয়ে আছে। প্রার্থনার একপর্যায়ে সে তার স্বর খানিকটা চড়া করে, এই শব্দগুলোর ওপর স্পষ্ট জোর দেয়, “বেনেডিকটা টু ইন মুলিয়েরিবুস—নারীকুলের মাঝে ধন্য হে তুমি,” কণ্ঠে উষ্ণতা ধরে রেখে গভীর ধ্বনিমুদ্রা সহকারে ও কথাটা বলে, যা প্রথমবারের মতো আমাকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়। অবশ্যই সেই অভাগী নারীর প্রার্থনা পুণ্য কুমারীর প্রতিচ্ছবিকে উদ্দেশ্য করে, এবং সত্যিই, খুব মনোযোগ দিয়ে তাকাবার পর, আমি বেদির ওপরকার ক্যানভাসে স্বর্ণের আলখাল্লা পরা এক নারীর অবয়ব উপলব্ধি করি। ভালো করে দেখবার জন্য আমি কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যাই।
সম্ভবত টোসকা সেটা শুনতে পায়; আমার মনে হয় সে নড়েচড়ে বসেছে কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারি না, তার উপাসনার মাঝে প্রবেশ করে সমস্যা তৈরির কথা চিন্তাও করতে পারি না। আমি অবিশ্বাস আর ক্ষোভের সঙ্গে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকি, আমার ভেতরে তখন শীতল রক্ত বইছে, অবাক হই কিভাবে ক্যভারাডোসি ঈশ্বর মাতাকে এমন একজন নারীর অবয়ব দেবার সাহস দেখাতে পারল যে কিনা তার অবৈধ ভোগসুখের সঙ্গী, এবং কিভাবে সেই একই নারী তার নিজের প্রতিকৃতির সামনে হাঁটুগেড়ে বসে প্রার্থনা জানাবার সাহস দেখাতে পারে। কেননা বৃথাই মারিয়ার পবিত্র নাম ধারণ করে, সেই ছবিটা বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, টোসকার এই ছবির মাঝে চূড়ান্ত আনুগত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, দাঁড়কাক রঙা চিকন কালো দীর্ঘ চুল বয়ে নিচের দিকে নেমে এসেছে, ফ্যাঁকাশে ধবল মুখের চারপাশে যার উপস্থিতি যে কোনো অবগুণ্ঠনের দ্বারাই উন্মোচিত হয়ে পড়তে বাধ্য এবং ঘন নীলচে ছোপের আবরণ এতটাই অন্ধকারময় দেখাচ্ছে যে সেটাকে কালো বলেই মনে হতে থাকে। নান্দনিকতার প্রকাশে চিত্রকর কুমারীর যে অবয়বটাকে এখানে জীবন্ত করে তুলেছেন, আমি সেই একই মহিলাকে চিনতে পারি, একবার যখন টোসকার ওপর গোয়েন্দাবৃত্তি করছিলাম তখন আমি এরকম কিছু একটাই উপলব্ধি করেছিলাম, কিন্তু কেবল এখনই সেই নান্দনিকতা তার স্বভাবের প্রকাশ ঘটাল, যেহেতু তার কৌমার্য ব্রতের কোনো সম্ভাবনাই নেই। প্রতিটা খুঁটিনাটির মাঝেই প্রচণ্ড উল্লাস, ইন্দ্রিয়সুখকাতরতা এবং অপার আপন-সুনজর প্রদর্শিত হচ্ছিল: হৃষ্টপুষ্ট এক জোড়া মাংসল ঠোঁট, অতিরঞ্জিত বাস্তববাদিতায় চিত্রিত হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে তা যেন একটি দ্ব্যর্থক হাসিতে উন্মুক্ত হয়ে রয়েছে, এবং উজ্জ্বল আকর্ষণীয় চোখের ওপর নেত্র পল্লবগুলো অর্ধনিমীলিত হয়ে আছে। আমার পক্ষে এটা বুঝে নেয়া মোটেই কষ্টকর নয় ঠিক কোন পরিস্থিতিতে, ঠিক কেমন কামুক মিলনের সময় চিত্রকর মডেলের চেহারার এমন অভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ করেছেন।
...প্রকাণ্ড কাঠের দরজাটার কাছে পৌঁছাবার পর আমি থামি; তখনই দেখতে পাই টোসকার মুখোমুখি না হয়ে জায়গাটা ছেড়ে আসার কোনো উপায় নেই, অন্তত এক মুহূর্তের জন্য তার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়া ছাড়া। আমার আত্মসম্মান, একজন পুরুষ হিসেবে আমার মর্যাদা, সেখানে অবস্থান করা এবং তার জন্য অপেক্ষা করাকে অপরিহার্য করে তোলে...
“বেনেডিকটা টু ইন মুলিয়েরিবুস—নারীকুলের মাঝে ধন্য হে তুমি,” আমি ক্ষোভের সঙ্গে ফিসফিস করে কথাটা বলি, আর নিশ্চিতভাবে টোসকাও তা শুনতে পায়, তাই সে দ্রুত গোলাপ আর ক্রসচিহ্ন আঁকে। এভাবে তার মুখোমুখি হয়ে আশ্চর্যজনকভাবে আমি আমার আবিষ্কারের বোঝা বইতে অক্ষম হয়ে পড়ি এবং, যে কারণটা আমাকে আজ এই চার্চে টেনে এনেছে তা পুরোপুরি ভুলে যাই, আমি প্রবেশপথের দিকে এগোতে শুরু করি, বলতে গেলে অনেকটা দৌড়ে। প্রকাণ্ড কাঠের দরজাটার কাছে পৌঁছাবার পর আমি থামি; তখনই দেখতে পাই টোসকার মুখোমুখি না হয়ে জায়গাটা ছেড়ে আসার কোনো উপায় নেই, অন্তত এক মুহূর্তের জন্য তার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়া ছাড়া। আমার আত্মসম্মান, একজন পুরুষ হিসেবে আমার মর্যাদা, সেখানে অবস্থান করা এবং তার জন্য অপেক্ষা করাকে অপরিহার্য করে তোলে। আমি নিজেকে পবিত্র জলের সামনে জায়গা করে দিই, তাতে করে বেরোবার সময় তাকে আমার পাশ দিয়ে যেতে বাধ্য হতে হবে। স্তম্ভশ্রেণীর মাঝে সরু পথ দিয়ে নেমে আসার সময় আমি ওর দিকে চোখ রাখি। তখনই আমি ওকে হোঁচট খেতে দেখি, আর বুঝতে পারি আমাকে ও চিনতে পেরেছে; সেও আপাতদৃষ্টিতে এমন একজোড়া চোখের অধিকারী যা অন্ধকারে আকৃতি পেতে সক্ষম, বিড়ালের মতো, নিশাচর কোনো প্রাণীর মতো। যে ঘনরঙা পোশাক ও পরে আছে আর যে অবগুণ্ঠনে নিজেকে আবৃত করেছে তার নিচে উপলব্ধি করা যায় এমন দাঁড়কাকরঙা তমিস্র চুলের প্রাচুর্যের কারণে, চার্চের অন্ধকারের চাইতেও ওকে আরো বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে মনে হচ্ছিল, ঠিক যেমন করে নক্ষত্রেরা আকাশে আলোক বিচ্ছুরণ ঘটায় যেন ঠিক তেমনি করে সেও নিজের সেই ছায়াটাকে উদ্ভাসিত করে তুলেছিল।
ইচ্ছাকৃতভাবে, আমি আধো খোলা প্রবেশ দরজা থেকে সরে দাঁড়াই যাতে সূর্য রশ্মি ঢুকে টোসকার মুখটা আলোকিত করে তুলতে পারে। দেখতে পাই একটা হাত দিয়ে সে চোখ দুটাকে ছায়া দিতে থাকে; তারপর আবারও হাঁটতে শুরু করে, তবে খুব ধীরে। সম্ভবত ভয় পাবার কারণে, যদিও ওর আচরণ উদ্ধতই থেকে যায়, অনেকটা তাচ্ছিল্যের চাহনিতে। যে ইচ্ছেটা আজকে আমাকে এখানে টেনে এনেছে ঠিক এমনই কোনো অনুভূতি থেকে, সব আশঙ্কা দমন করে, ও পেছন ফিরবে না, আমি নিশ্চিত, দরজার কোনো একটা কোণের দিকেও ও তাকাবে না, ও সোজাসুজি আমার দিকে আসবে। দৃঢ়সংকল্পবোধ তার আচার-আচরণকে এমনই এক রাজকীয়তার অধিকারী করেছে, এবং বরাবরের মতো ওকে আমি যেমনটা দেখে এসেছি তা এই নারী নামক উদ্ধত জন্তুর মাঝে খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর যে কিনা খুব সহজেই নিজেকে ক্যভারাডোসি আর তার পূর্বসূরিদের কাছে সঁপে দিতে প্রস্তুত ছিল। বরং আমি তাকে পুণ্যবান চিহ্নিত কৌমার্য চর্চাকারী বলে ধরে নিই অথবা বরং এমনও ভাবি এটা সেই প্রতিমূর্তি যার ভেতরে এক সীমাহীন ঔদ্ধত্যের অন্তঃসলিলা ঝর্ণাধারা বয়ে চলেছে।
আমার কাছাকাছি আসার পর টোসকা আমাকে না দেখার ভান করে এবং সামনে এগোতে নেয়, কিন্তু দ্রুত আমি ওর পথ আগলে দাঁড়াই। আমি আমার হাতটা পবিত্র জলাধারে ডুবাই এবং নিবেদন অর্পণ করবার মতো করে ওর সামনে তা মেলে ধরি, যাতে করে ও পবিত্র জল গ্রহণ করবার জন্যে আমার সামনে আসতে বাধ্য হয়। শীঘ্র আমার হাত থেকে ও আর নিজের হাতটা সরিয়ে নিতে পারে না, আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকায় দৃষ্টিও নামাতে পারে না; ও স্থির হয়ে থাকে, যদিও আমি ঠিকই ওর হাতে মৃদু একটা শিহরণ টেরপাই। অবশেষে আকস্মিকভাবে ও সেটা সরিয়ে নেয়, এবং বুকে ক্রুশ না এঁকেই চার্চ ছেড়ে বেড়িয়ে যায়।
___________________________________
ইতালীয় ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক, এবং সাহিত্য সমালোচক পাওলা ক্যপ্রিওলো (Paola Capriolo) ১৯৬২ সালে পহেলা জানুয়ারিতে ইতালির মিলানে জন্মগ্রহণ করেন, এবং এখনও সেখানেই বসবাস করছেন। তিনি ইউনিভারসিটি অব মিলান থেকে দর্শন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। তার প্রথম গল্প গ্রন্থ লা গ্রান্ডে ইউলালিয়া ছাপা হয় ১৯৮৮ সালে। তার লেখায় বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা, স্বরূপ বিষয়ক প্রশ্ন, এবং কোনো কিছুর মানে বদলে যাবার দর্শন এবং অধিবিদ্যাগত প্রশ্নের পর্যালোচনা খুঁজে পাওয়া যায়। এতে শৈল্পিক রীতিতে কল্পনার মিশেলে মিথ, জার্মান সাহিত্য এবং দর্শনের ঐতিহ্য চিত্রিত হয়েছে। তার লেখায় মুখ্য চরিত্রের একাকীত্বের মাঝে সঙ্গীতের অনুপ্রেরণাও দেখতে পাওয়া যায়। এপর্যন্ত তার বারোটি উপন্যাস এবং অসংখ্য ছোট গল্প, এবং শিশুতোষ গল্প প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একাধারে, জার্মান লেখক গোথে, কেল্লার, মান, স্নিটসলার, কাফকা, সিমেল, ক্লেইস্ট, স্টিফটার এর ফিকশনেরও একজন অনুবাদক। তিনি কোরেরে ডেল্লা সেরা পত্রিকার সংস্কৃতি পাতার একজন নিয়মিত লেখক। ইংরেজি, ড্যানিশ, ডাচ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, হাঙ্গেরিয়ান, জাপানিজ, পর্তুগিজ এবং স্প্যানিশসহ তার লেখা বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। নিজের পোষা বিড়ালকে তিনি খুবই ভালোবাসেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১৫