প্রথম কিস্তির লিংক
কিছুক্ষণ পর ওকে চমকে দিয়ে মানুষটি পদ্মাপাড়ের ঢাল বেয়ে নদীতে নেমে গেলেন। শিশুর মতো ছুটাছুটি করছেন তীর ধরে।
এদিকটায় মানুষের যাতায়াত কম। তাই কারো নজরে পড়ছে না। নইলে এতক্ষণে একটা জমায়েত হয়ে যাওয়ার কথা শিল্পীকে ঘিরে।
সহসা তিনি লক্ষ্য করলেন জগন্ময় শীল নিজের দেহ থেকে ফতোয়া-ধুতি খুলে একেবারে দিগম্বর হয়ে পড়েছেন। তারপর সমস্ত শরীরে কাদা মেখে দেহকাণ্ডের অর্ধেকটা জলে আর অর্ধেকটা ডাঙার ঘাস-লতাপাতার ওপর এলিয়ে দিয়ে দিব্যি শুয়ে রয়েছেন। দূর থেকে মনে হবে কোন এক ডলফিন বা শুঁশুক বুঝি ক্লান্ত দেহে রোদ পোহাচ্ছে।
ঘণ্টাখানেক এরকমভাবে কেটে যাবার পর মানুষটি নড়েচড়ে উঠলেন। স্নান সেরে আবার ধুতি ফতোয়া গায়ে চড়িয়ে রেজা মাসুদের সামনে এসে বলে উঠলেন, “ফ্রেশ অইয়া গেলাম। একটা সাপ না মাছ যেন নুনুটারে চুমু খেতে চাইছিল। এইজন্য ঘোরটা কাইটা গেল। সময় পাইল না শালা। ”
একথায় রেজা হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন। আর ঠিক তক্ষুণি তিনি ফাইনাল করে ফেললেন যে এই মজার খ্যাপাটে শিল্পীটিকে এখানকার বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন।
একথা ওর এড ফার্মকে জানাতেই ওরা হৈ-হৈ-রৈ-রৈ করে কাজে লেগে গেল। আইডিয়াটা এরকম যে শিল্পী জগন্ময় শীল একটি ছবি আঁকবেন দিনভর। বিশিষ্ট লোকজন হুল্লোড় করবেন; গান-বাজনা হবে; খাওয়া-দাওয়া নাচগান সবকিছুর মাঝে শিল্পী তার ছবি আঁকবেন। এই ছবিটিই হবে রেজা মাসুদের তাঁকে এদেশে আনার মহামূল্যবান এক উপহার।
কথাটা বলতেই জগন্ময় এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। কোনো ভনিতা না করে বলে উঠলেন, “জানিস, একজন জাতশিল্পী সারাক্ষণ শিল্প রচনা করে থাকেন। শরৎ-মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কররা কয়টা গল্প আর কাগজে লিখে গেছেন বল? ওঁদের মাথায় যত গল্প তৈরি হতো এর সবগুলো যদি প্রকাশ পেত তাহলে কটা যে লাইব্রেরি হতে পারত। হাঃহাঃহাঃ। গায়ককে দেখিস না সারাদিন গুনগুন করছে? ওটা ওর প্যাশন। ওটা ছাড়া ওর চলে না। আমাকেও যেখানেই আঁকতে দিবি, ঠিক এঁকে দেব। ওসব নির্জনতা-নীরবতার সাধনা, কী যেন বলে না, যতসব গালভরা কথা। সব শিল্পীর বুজরুকি। নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলা। বুজলি না? আসলে যে কোনো অঙ্গনের শিল্পীই একজন সাধক। ওর কাছে ভূমানন্দ আর দুগ্ধভেননিভ শয্যা আসলে এক কথাই। আমি রাজি। তুই আয়োজন কর। ”
“আরে ভাই ইন্ডিয়ান শিল্পী এনে যখন শো করবারই ইচ্ছা তো এই বুড়ো ধুড়োদের কেন, অনিন্দিতা সোমদের মতো ইয়ং আর্টিস্টদের তো আনতে পারতি। গতবছর লন্ডনে দেখে এসেছি। কী রূপ রে ভাই। ” বলে এক চোখ ছোট করে ফেলল।
রেজা মাসুদ ওর কানে ফিসফিস করে বলে উঠল, “ভেতরে যা। একটা দামি জিন আছে। এই দুপুরবেলায় জিন উইথ লাইম খুব জমবে। যাঃ। ”
সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল কাজকর্ম। রেজা মাসুদের এড-ফার্মটি উঠে পড়ে লেগে ওর এই ফার্ম হাউজটিকে মাত্র চারদিনের নোটিশে এই আয়োজনের উপযোগী করে ফেলল। ভারতীয় শিল্পী জগন্ময় শীলের লাইভ আর্ট শো। অর্থাৎ তিনি আঁকবেন আর আমাদের সব বুদ্ধিজীবীরা হাসিমুখে সেসব দেখতে দেখতে চর্ব-চুষ্য-লেহ্য-পেয়-য় মজে থাকবেন।
আবৃত্তিকার আলিম খান কাছে এসে ফিসফিস করে বলে উঠলেন, “আমাদের দেশে অনেক গুণী আঁকিয়ে রয়েছেন; পাশাপাশি তাদের কাউকে রাখলে ভালো হতো না?”
তরুণ তুর্কী; যা মনে আসে ঝটপট বলে ফেলতে পারে কোনো ভণিতা ছাড়াই। সম্পর্কে রেজা মাসুদের দূর সম্পর্কের শ্যালক হয়। বেশ রসালো সম্পর্ক।
রেজা মাসুদ ঠোঁটের ফাঁকে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে উত্তর দিলেন, “রবীন্দ্রনাথের পাশে নজরুল, কী বলো?”
আলিম আর কথা না বাড়িয়ে খাদ্যের সন্ধানে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ও আসলে হন্যে হয়ে যা খুঁজছে তা হলো হার্ড ড্রিংক।
স্থপতি ইমরান ওর সমসাময়িক বন্ধু। সে জগন্ময়ের দিকে চোখ রেখে বলে উঠল, “ইন্ডিয়ানরা কি পাগল হয় নাকি দোস্ত। আঁকতে আঁকতে কিরকম পাগলের মতো করছে। কোত্থেকে ধরে আনলি একে?”
“শিল্পীরা মাঝে মধ্যে পাগল হয়। ওদের সাথে এগুলো কিভাবে যেন মিলেও যায়। ” রেজা মাসুদ মিঠা গলায় উত্তর দেন।
“আরে ভাই ইন্ডিয়ান শিল্পী এনে যখন শো করবারই ইচ্ছা তো এই বুড়ো ধুড়োদের কেন, অনিন্দিতা সোমদের মতো ইয়ং আর্টিস্টদের তো আনতে পারতি। গতবছর লন্ডনে দেখে এসেছি। কী রূপ রে ভাই। ” বলে এক চোখ ছোট করে ফেলল।
রেজা মাসুদ ওর কানে ফিসফিস করে বলে উঠল, “ভেতরে যা। একটা দামি জিন আছে। এই দুপুরবেলায় জিন উইথ লাইম খুব জমবে। যাঃ। ”
রেজা মাসুদ এসময়ে এসব কথা যে পছন্দ করছে না তা বুঝতে পেরে আর এগোয় না ইমরান। সে কিছুক্ষণ রূপার দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সম্ভবত জিনের খোঁজে বাংলোবাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। রেজা মাসুদের তাই মনে হলো।
এবার রেজা মাসুদ এসে দাঁড়াল শিল্পীর সামনে। মানুষটা তুলি চালানোর চাইতে আঁকিবুকি পূর্ণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকছেন অনেক্ষণ। হয়ত এটি তার ভেতরকার চিন্তা-প্রবাহের একটা মুদ্রা।
পাশে রেজা মাসুদকে পেয়ে হুড়মুড়িয়ে কথা বলতে শুরু করেন। বেশিরভাগ কথাই এলোমেলো, কিছুটা জড়ানো। রেজা যত ছবিটা নিয়ে কথা বলতে চাইছেন তিনি তত এড়িয়ে চলছেন। তাকে সারাক্ষণ পেয়ে বসেছে সেই পদ্মাপাড়ের অশ্বত্থ বৃক্ষটি। কাছে ঘেঁষলেই তিনি শুরু করেন বৃক্ষ আর নদীর কথা।
রেজা এড়াতে চাইলেও পারেন না। কোথায় যেন একটা রহস্যাবৃত চাদর লুকিয়ে রয়েছে মানুষটার ভেতর। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে ক্লান্ত লাগে সত্য; কিন্তু সরে গেলে টানতে শুরু করে। প্রতিটি কথাই তখন মনে হয় অদ্ভুত।
“আরে, বৃক্ষ আর নদীরে না জানলে তুই শিল্পী-লেখক চিনবি কমনে? কবি লেখকদের নেমন্তন্ন দেস নাই?”
“দিছি। ”
“হেরা কই? মদ খাওয়ায় ব্যস্ত। ” বলেই হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠেন।
“হাসছেন যে বড়। ”
“লেখক-শিল্পীরা তো সাধু-সন্ন্যাসী-দরবেশ-আওলিয়ার জাত, বুজলি না? বাইরে যতই কাঠ-খোট্টা হউক, ভিতরে-ভেতরে ঠিকই দিওয়ানা। আগেও শালারা গাজায় দম দিত। দম দিয়াই নতুন কতা শুনাইত জগদ্বাসীরে। অহনও তাই। আইচ্ছা, এরা কাছে আয়ে না কেন আমার? কবি নাই এইখানে? গদ্যকার? কই তারা? কস নাই? নাকি আমারে ইন্ডিয়ান মনে করতোছে। হাঃহাঃহাঃ। আরে আমি তো পদ্মাপাড়ের অশ্বত্থবৃক্ষ। কাদা-কুদা মাখা একলা পাগল। ” বলেই গুনগুন করে গান ধরেন জগন্ময়, “দুইজনাই বাঙালি ছিলাম, দেখো দেখি কাণ্ডখান, আজকে তুমি বাংলাদেশি আমারে কও ইন্ডিয়ান। ”
এসময় পাশে এসে দাঁড়ালেন কবি সোহাগ কবীর। তার কবিতার ধার অনেককেই স্পর্শ করছে ইদানীং। মুখ বাড়িয়ে ক্যানভাসের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে রেজাকে বলে উঠলেন, “লোকটা কি পারভার্ট?”
“কেন?”
“দেখছেন না কী আঁকছেন?”
“কী আঁকছেন?”
“সঙ্গমের দৃশ্য। একটা লোক, তাও বৃদ্ধ, উপুড় হয়ে আছে এক নারীর ওপর। ছিঃ। বুড়ো হয়েছেন; তবু ভণ্ডামী যায় না। ”
রেজা মাসুদ সরে এলেন শিল্পীর কাছ থেকে। বাংলোঘরের ভেতরে পা দিতেই ওর চক্ষু চরকগাছ। সবাই এখানে একত্রিত হয়ে সুরাপান করছেন আর এটা-ওটা দেদার ভক্ষণ করছেন। কেউ হিমেল হাওয়া ছেড়ে শিল্পীর কাছে চালতা গাছতলায় যেতে চাইছে না। রূপার গানের পর বাঁশি বাজাবার কথা হারুনের। তাকে দেখতে পেলেন বিয়ার হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। শীলা মাসুদ সঞ্চালনার দাযিত্বে রয়েছেন। ওর কাছে এসে চোখ গরম করে বলে উঠলেন, “এখন তো বাঁশির সেশন। উনি কি কম পেমন্টে নেবেন?”
“এখন বিরতি চলছে। বাইরে তো গরম প্রচণ্ড। শিল্পীদের বিশ্রাম তো প্রয়োজন। ”
“আর মূল শিল্পী যে এক একা চালতা গাছের নিচে একনাড়াড়ে এঁকে চলেছেন? তার গরম লাগছে না। তিনি কি ফেলনা শিল্পী?”
“অত টেন্স হচ্ছো কেন জান? জগন্ময়বাবু তো এসবে অভ্যস্ত। কোপাই নদীর পাড়ে কুঁড়েঘরে থাকেন। তার তো খারাপ লাগবার কথা নয়। আমাদের শিল্পী-লেখকরা তো ওরকম জীবন যাপনে অভ্যস্ত নন। ব্যাপারটা বুঝতে হবে। টেক ইট ইজি মাসুদ। আমি দেখছি। ” বলে ও বাঁশিওলার সামনে গিয়ে কানে কানে কিছু বললেন। ওমনি তিনি ঢকঢক করে পুরো গ্লাস পেটে ঢেলে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন হাতে বাঁশি নিয়ে। একটু পরই শিল্পী কথা বলতে শুরু করেন বাঁশিতে। নিমিষে চারপাশের আবহ বদলে যায়। শিল্পী জগন্ময় তুলি চালাতে থাকেন ক্যানভাসের গায়। রেজা মাসুদের মনে হলো বাইরে চৈত্রের হল্কার সঙ্গে নরম হাওয়া হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে চারপাশে। এই ভর দুপুরেও গায়ে আদুরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে যেন।
শীলা এসে দাঁড়াল ওর পাশে। মুখ ভার করে বলল, “এবারের গেস্ট সিলেকশনটা তোমার ঠিক হয় নাই জান। ” ন্যাকা গলায় জানাল রেজা মাসুদের স্ত্রী।
“কী হলে ভালো হতো?”
“গানের শিল্পী হলে ভালো হতো। আমার ফ্রেন্ডরা তো কেউ আসেইনি। ” চোখেমুখে একটা হতাশা।
“কী আঁকছে, কাছে গিয়ে দেখেছো?”
“দেখো, যত বড় শিল্পীই হউক পাগলের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে বলো না আমায়। প্লিজ। ” কাতর চোখে তাকায় স্বামীর দিকে। একসময় উপস্থাপিকা ছিল টেলিভিশনের। এখন স্বামীর অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও সঞ্চালনা করতে দেখা যায় না।
“তুমি এত বড় শিল্পীকে পাগল বলছো? উনাকে আনতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমার জানো?”
“তো আমি কী করব?”
“উনি তোমার গেস্ট। ”
“আমার নয়। তোমার। ”
“বাজে বলো না। ভেতরে গিয়ে সবাইকে বলো বাইরে আসতে। আমরা যে কীরকম লোক দেখানো বড়লোক হয়েছি। একটুখানি সময় এসির কৃত্রিম হাওয়া ছাড়া বাঁচি না। যত্তোসব। ” চাপা গলায় রেজা মাসুদ নিজের ক্ষোভ ঝাড়েন।
শীলা ভেতরে চলে গেল। রেজা ত্রিপল টাঙানো খোলা জায়গাটায় ফের এসে দাঁড়ালেন। এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন শিল্পকর্মটি। প্রথমে যেরকম লেগেছিল রেখাগুলো, এখন আরো স্পষ্ট হচ্ছে সেগুলো। একটা মানুষ ঝুঁকে বসে রয়েছে একটি লেখার খাতার উপর। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, হতাশ আর বিমর্ষ মুখাবয়ব। আঙুলের ফাঁকে উল্টো করে ধরা কলমটি। চাঁচাছোলা চেহারার বৃদ্ধ একজন মানুষ কেন এভাবে তাকিয়ে রয়েছেন রেজা মাসুদ বুঝতে পারেন না।
এসময় পাশে এসে দাঁড়ালেন কবি সোহাগ কবীর। তার কবিতার ধার অনেককেই স্পর্শ করছে ইদানীং। মুখ বাড়িয়ে ক্যানভাসের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে রেজাকে বলে উঠলেন, “লোকটা কি পারভার্ট?”
“কেন?”
“দেখছেন না কী আঁকছেন?”
“কী আঁকছেন?”
“সঙ্গমের দৃশ্য। একটা লোক, তাও বৃদ্ধ, উপুড় হয়ে আছে এক নারীর ওপর। ছিঃ। বুড়ো হয়েছেন; তবু ভণ্ডামী যায় না। ”
রেজা ফের তাকালেন ছবিটার দিকে। শিল্পী নিবিষ্ট হয়ে রয়েছেন ছবিটায়; বিড়বিড় করছেন। হাতে মুখে রঙের দাগ। গায়ে একটা ফতুয়া আর ধুতি। একসময় বেশ ফর্সা ছিলেন বোঝা যায়। সামনের পাটির দুটো দাঁত নেই। সেগুলো বাঁধানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করছেন না। চুল সাদা। শুধু চোখ দুটো অসম্ভব ক্ষুরধার। অনেকটা ক্যানভাসের ওই লোকটার চোখের মতো।
এসময় কথাকার জামাল নাসের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে বলে উঠলেন, “এ তো বাচ্চাদের ছবির মতো লাগছে। পেটে দ্রব্য পড়েনি?”
“মহুয়া ছাড়া অন্যকিছু খাননা তিনি। সাঁওতালদের সঙ্গে ভাব তো। ”
“এই একটা ম্যাদম্যাদা ছবি দেখাবার জন্য এত আয়োজন?”
রেজা মাসুদ মুখ ঘুরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। সহসা ওর মনে হলো, সে জোর করে মানুষটিকে একটা বৈরি পরিবেশের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এখানকার কেউ তাকে বুঝতে চাইছেন না। বরং তাকে ক’দিন পদ্মাপাড়ে ঘুরিয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেই ভালো হতো। কেন যে এখানে ছবি আঁকার লাইভ শো করার ইচ্ছে হলো ওর। নিজের স্ত্রী পর্যন্ত মানুষটিকে নিতে পারছে না।
জগন্ময় শীল পিছন ফিরে ওকে ডেকে উঠলেন, “রেজা, দেখে যা। ” এমনভাবে ডেকে উঠলেন যে মনে হলো ওর মরহুম আব্বাজান। একইরকম আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে শিক্ষক বাবা ওকে ডাকতেন। সেই ডাকটা এখনও ঘুম থেকে ওঠার সময় সে বুকের গহীনে টের পায়।
ও তার সামনে এসে দাঁড়াল। তিনি ওর দিকে তাকিয়ে সহসা হাতের তুলিটা আকাশের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “এইবার তর লোকজনরে ডাক। জিগাইয়া দেখ, কে বুঝতে পারে। এই নাম দিলাম। অক্ষমতা। জিগা, তাগাদা কইরা ডাক। ”
রেজা মাসুদ এগিয়ে যান শিল্পী জগন্ময় শীলের দিকে। তারপর শিল্পীর ছোটোখাটো ভাঙাচোরা বুড়োটে শরীরটিকে জড়িয়ে ধরে গভীর মমতা দিয়ে বলে উঠেন, “ভেতরে চলুন। খাওয়া লেগে গেছে। ”
সহসা ভেঁউ ভেঁউ করে কেঁদে ফেললেন তিনি, “আমরা পারি না কেন মাসুদ। আমরা ফুরিয়ে যাই কেন। আমরা কেন পদ্মাপাড়ের অশ্বত্থ বৃক্ষ হতে পারি না। কেন না? হোহোহো। ”
রেজা মাসুদকে ডাকতে হয়নি; ওর পাগলপারা আচরণে বিস্মিত সবাই ছুটে এলো সঙ্গে সঙ্গে। সবার আগে কবি সোহাগ কবীর। শিল্পী কাউকেই তেমন চেনেন না। ওকে সামনে পেয়ে উচ্ছ্বল কণ্ঠে বলে উঠলেন, “এই ছোকরা, ওই ঘরটার ভিতরে আমার একটা ঝোলা আছে। তাতে একটা মহুয়া ভরা বোতল আছে। আনবি? যা না। ”
রেজা মাসুদের জিহ্বায় কামড় দেবার মতো অবস্থা। বেশ অবস্থাপন্ন লোক এই সোহাগ কবীর। নামে কবি, ব্যবসাপাতি করে রীতিমতো বড়লোক এখন সে। তাকে এভাবে বোতল আনবার কথা, তাও যেন-তেন ভাবে, বললে কি হয়?
কিন্তু ওকে চমকে দিয়ে সোহাগ ছুটে গেল বাংলোঘরটার দিকে। তারপর সেই বোতলটা এনে বেশ সমীহের সঙ্গে হাতে তুলে দিয়ে বলে উঠল, “নিন গুরুজী। ”
জগন্ময় শীল সেই বাসী মহুয়া বেশ কিছুটা ঢকঢক করে পেটে দিয়ে জোরালো কণ্ঠে বলে উঠল, “এবার তুই বল আমি কী এঁকেছি? তুই আমাকে মহুয়া এনে দিয়েছিস। তুইই বল। ”
“আমি?” মিনমিন করে ওঠে সে।
রেজা মাসুদের হাসি পাচ্ছিল। একটু আগে যার কণ্ঠ থেকে এরকম বিশ্রী মন্তব্য ঝরছিল, এখন তাকে একই বিষয়ে মন্তব্য করতে বলছে খোদ শিল্পী। অপ্রস্তুত হতে হয় না?
কবি সোহাগ কবীর ফস করে বলে উঠল, “এ একটা পাহাড় ঝুকে রয়েছে একটা মড়া নদীর উপর। ”
“বাঃ কল্পনা শক্তি তো তোর খুব প্রখর। মা এদিকে আসতো। ” এবার ডেকে উঠলেন খোদ শীলাকে।
শীলার পরনে মিরপুরি বেনারসী। বেশ ঝলমল করছে। কাছে আসতেই জগন্ময় বলে উঠলেন, “মা বলতো এই অধম কী আঁকতে চাইছি? একটু দেইখা বল। ”
“একটা বিশাল আকৃতির বক নদীর তীরে এসে মাছ খুঁজছে নুয়ে। ”
“সবাই তো দেখি খুব কল্পনাপ্রবণ। ভালো ভালো। মা কি স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করো?”
“স্বপ্ন ছাড়া কি মানুষ বাঁচে গুরুজী?” শীলার কাটকাট উত্তর।
‘তাও তো কথা। স্বপ্নই তো মানুষকে উড়তে শেখায়। আবার স্বপ্নই মানুষকে কর্মবিমুখ করে। এই তুই আয় তো। ”
আবৃত্তিকার এবার শিল্পীর চোখের সামনে। সে এতটুকু না টসকে উত্তর দিল, “এটা তো সিম্পল। একটা আজাইরা বুড়া বসে বসে হিসাব করতেছে। ফানি। ” ঠোঁট উল্টে দেয় সে।
“হাঃহাঃহাঃ আনন্দ পেলাম। তুই কিছু বলবি?” স্থপতি ইমরানের দিকে চোখ ওর।
সে এতটুকু ইতস্তত না করে উত্তর দেয়, “এক বুড়ো স্থপতি বাড়ির প্ল্যান তৈরি করছেন। ”
“বাড়ির প্ল্যান তৈরিতেও শিল্পী হইতে হয়। বাবুই পাখি, আহা। যে শালার শিল্পবোধ নাই ও তো মতুয়া। ওইটারে কয় মতুয়ার সাতাছালা বুদ্ধি। বুঝছিস?”
এরকম ঢালাও তুই-তুকারি করায় রেজা মাসুদের কিঞ্চিৎ অস্বস্তিবোধ হলেও সবাই বেশ সহজভাবেই নিচ্ছে। কৃত্রিম মনে হচ্ছে না কিছু।
এসময় ভেতর থেকে টলতে টলতে ক্যানভাসের ঠিক সামনে চলে এলো কথাসাহিত্যিক জামাল নাসের। ঘোর লাগা চোখে ছবিটি ভালো করে দেখে বলে উঠল, “আরে এ তো ডাচ শিল্পী পাগলাটে ভিনসেনট উইলিয়েম ভ্যান গগ। আত্মহত্যার ঠিক আগেকার সময়ে মানসিক ভারসাম্য হারানো গগ। ঠিক কি না গুরুজী?”
জগন্ময় কোনো কথা না বলে হাতে ধরা তুলি আর রঙের পাত্রটি জামাল নাসেরের হাতে তুলে দিয়ে বলে উঠলেন, “তুই কী করিস রে বাবা? আমার মতো পাগলা দাশু?”
“না গুরুজী। আমি কথাসাহিত্যিক। একটু আধটু গল্প উপন্যাস লিখে থাকি। ” ওর হাতে ধরা তুলি আর ব্রাশ।
“তাইলে তোর গুরুকে তুই চিনতে পারছিস না কেন? হাতের ওগুলো ছুড়ে দে মাথার উপরে। তারপর তাকা এদিকে। ”
জামাল নাসের মধ্য বয়সী ভদ্রলোক। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে বড় চাকুরে। শখ করে গল্প-উপন্যাস লিখছেন। এ লাইনে বেশিদিন না হলেও তার প্রথম উপন্যাসটিই একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ঘোষণা করা পুরস্কার জিতে নেয়। এই লেখক অনেকদূর যাবে বলেই অনেকের আশা। তাকে আচমকা তুলি আর রঙের পাত্র শূন্যে ছুড়ে দিতে বললে তো সবারই চমকাবার কথা।
‘কী হলো হাতের ওসব ছুড়ে দে। তারপর তাকা। ঠিক তুই সাইপ্রাসের গমের ক্ষেত থেকে হুগলিতে চলে আসতে পারবি। ভাস্কোদা গামা পারলে তুই পারবি না? আলবাৎ পারবি। তাকা। ”
রেজা মাসুদের মনে হলো মানুষটার কথায় এক ধরনের যাদু মেশানো সারল্য রয়েছে যা অস্বীকার করা যায় না। সহজেই নিজের অস্তিত্ব তা নিয়ে নেয়।
জামাল নাসের এক ঝলক তাকাল শিল্পীর দিকে; তারপর অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে শূন্যে ছুড়ে দিল হাতে ধরা রং তুলি সব। ওর সঙ্গে সঙ্গে সবাই আনন্দে হৈ-হৈ করে উঠল। একটা উল্লাসের বলক সবার ভেতর।
এবার উঁচু-লম্বা মানুষটি ঢুল-ঢুল চোখে তাকায় ক্যানভাসে। সব কেমন ঝাপসা হয়ে আসে।
“গুরুজী আপনিই বলুন। ”
“আরে বাপু এই মানুষটা হলো কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শ্রীকান্ত, পথের দাবী, চরিত্রহীন, শেষ প্রশ্নের লেখক। আমি যেমন এখন পারি না। ওই লেখকও শেষ বয়সে এসে আর লিখতে পারতেন না। আমি যেমন ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিষ্ফলা সময় কাটাই, দাঁত দিয়ে নখ কাটি, ওই মানুষটাও কলম কাগজ নিয়ে দিনের পর দিন বসে থাকতেন। লেখা বেরোত না। যা আসত তা মনঃপুত হতো না, ছিঁড়ে ফেলত। আমার মতো। অবিকল আমার মতো। ” শেষের কথাগুলো কেমন বুঁজে আসে তার। এক অপরিমেয় কষ্টে ধনুকের মতো বেঁকে যায় ছোট শরীরখানা।
চারপাশ স্তব্ধ। এখানে যারা রয়েছেন এরা কোনো না কোনোভাবে শিল্পের মাধ্যমে জড়িয়ে রয়েছেন। রেজা মাসুদের মনে হলো জগন্ময় শীলের মতো ওরাও যেন কিছুক্ষণের জন্য আত্মবিশ্লেষণে মগ্ন হয়ে গেছে।
এসময় সবাইকে চমকে দিয়ে রূপা গেয়ে উঠল, “অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে প্রাণ...”
মাথার উপরকার ত্রিপল ভেদ করে চৈত্রের খরতাপ সবাইকে দগ্ধ করতে চাইলেও ভেতরে ভেতরে সবাই অদ্ভুতভাবে ভিজে যাচ্ছে। অপারগতা, অক্ষমতা, অসহায়তার এক আর্দ্র বায়ু যেন সবার বুকের গহীনে বইতে থাকে।
রেজা মাসুদ এগিয়ে যান শিল্পী জগন্ময় শীলের দিকে। তারপর শিল্পীর ছোটোখাটো ভাঙাচোরা বুড়োটে শরীরটিকে জড়িয়ে ধরে গভীর মমতা দিয়ে বলে উঠেন, “ভেতরে চলুন। খাওয়া লেগে গেছে। ”
সহসা ভেঁউ ভেঁউ করে কেঁদে ফেললেন তিনি, “আমরা পারি না কেন মাসুদ। আমরা ফুরিয়ে যাই কেন। আমরা কেন পদ্মাপাড়ের অশ্বত্থ বৃক্ষ হতে পারি না। কেন না? হোহোহো। ”
সবার পকেটের রুমাল তখন চোখের কোণায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০১ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৫