“কই, কেক এসেছে?”
“হ্যাঁ। ডাইনিং টেবিলে দেখো।
তমা টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। কেকের বাক্সটা খুলে তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। “এই তোমাকে না ভ্যানিলা কেকের অর্ডার দিতে বলেছিলাম। এটা কী!”
“চকলেট কেক। ”
“আমি তো বললাম ভ্যানিলা!” তমার চোখে বিরক্তি জ্বলে ওঠে।
“চকলেট কেক তো বাচ্চারা বেশি পছন্দ করে। ভ্যানিলা কেক তো পানশে লাগে। ”
“খাওয়াটাই তোমার কাছে বড় হলো। পার্টিতে প্রেজেন্টেশনটাই মুখ্য। ভ্যানিলা কেকে সাদার উপর বিভিন্ন রঙের কারুকাজ দেখতে বেশি আকর্ষণীয় হয়। ”
আনিস চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। তমা বারবার করে তাকে বলে দিয়েছিল কিন্তু বেকারিতে অর্ডার দেয়ার সময় ওর একদম মনে ছিল না। “এটাও দেখতে তো সুন্দর লাগছে। ”
“আমার ইচ্ছের তোমার কাছে কোনো মূল্য নেই। তোমার সাথে কেন আমি তর্ক করছি—অহেতুক? ও গড!” বিরক্তিতে তমার মুখের পুরু মেকাপ করা ত্বক ভাঁজ হয়ে যায়।
আনিস কথা বাড়ার আগে সরে পড়ে।
আজ বাড়িতে পার্টি। কাছের আত্মীয় স্বজন চলে এসেছে অনেকে। বন্ধু বান্ধবরা আসতে শুরু করেছে—আনিস ঘড়ি দেখে, এখন তিনটে। সে বাড়ির ছাদের দিকে এগোয়। এখন একটা সিগারেট খাওয়া দরকার। অতিরিক্ত মানসিক চাপে মাথা যেন ধরে আসছে। পার্টি, মানুষের ভিড় তার একদম ভালো লাগে না। বেশি মানুষের মাঝে তার নিজেকে বেশি একা একা লাগে। ছাদে গিয়ে সিগারেট খাওয়ার আর সুযোগ হলো না। সেখানে বাচ্চারা খেলা করছে। বাড়ির ছাদময় চাইনিজ ঘাসের প্রাকৃতিক মাদুর। এভাবে ছাদে মাটি বিছিয়ে ঘাস চাষের আইডিয়াটা আনিসের বাবারই ছিল। ঢাকার খিলগাঁওয়ে ছোট্ট একটা ডুপ্লেক্স। বাবা তার শখ করে নাম দিয়েছে ‘শান্তি আশ্রম’। পঁচিশ বছর আগে অনেক কষ্টে অর্থকড়ি যোগাড় করে তিনি এটা তৈরি করেছিলেন। ভালোভাবে যত্ন নেয়া হয়নি বলে এখন মনে হয় একশ’ বছরের পুরনো। বাড়ির কাজ শেষ করে বাবা তার বলেছিলেন, “এবার শান্তিতে আমার শান্তি আশ্রমে বসবাস করব। ” কিন্তু বাবা বছর না ঘুরতেই কঠিন অসুখে পড়ে গেলেন। ব্লাড প্রেসার কোনোভাবেই কন্ট্রোল হচ্ছিল না। শেষে হার্ট অ্যাটাক। অল্প কিছু জমি ছিল তা বিক্রি করে বাবাকে নিয়ে এই হাসপাতাল থেকে ঐ হাসপাতাল দৌড়াদৌড়ি। আনিস তখন এম.এ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.ফিলে ভর্তি হয়েছে। বোন তিথি কলেজে পড়ছে। অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাবার পুরান ঢাকার কাপড়ের দোকানটা প্রায় বন্ধ থাকত। আনিস দোকানে বসবার কথা বললেও বাবা তা চাইতেন না। তাঁর কথা, আনিস নিজের মতো গড়ে উঠুক। সে মেধাবী। তার এগিয়ে চলা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়।
অতঃপর বাবা তো চলে গেলেন। বোনের বিয়ে দিল আনিস। তিথি এখন ভালোই আছে। ওর হাজব্যান্ড সরকারি চাকরি করে। তিথি নিজেও একটা বিদেশি এনজিও-তে আছে। ওদের এক ছেলে অরিন। বিয়ের পর তিথি চলে গেল শ্বশুর বাড়ি। মা এবার আনিসের পেছনে লাগলেন—বিয়ে কর, বিয়ে কর। তুই একটা বিয়ে কর বাবা। আমার একা একা দম বন্ধ হয়ে আসে। আনিসের মা স্বামীর শোকটা ঠিক মতো কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। তাঁর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকত না। এই থেকে হার্ট ফেলিওর। এক বছর ধরে একদম বিছানায়। নড়াচড়া কথাবার্তা সব বন্ধ। অক্সিজেন দিতে হয় মাঝে মাঝে। ক’দিন ধরে শ্বাস কষ্টটা ভয়ানক বেড়ে গেছে। অক্সিজেন ছাড়া চলছেই না। মার এই অবস্থায় বাড়িতে পার্টি। তমাটা যে কী!... টবে বেড়ে ওঠা বনসাইয়ের মতো বেটেখাটো পেয়ারা গাছটায় একটা টুনটুনি বৃথা আশ্রয় খুঁজছিল। সেদিকে আনিস তাকিয়ে থাকলেও তার দৃষ্টি কোথায় হারিয়ে গেছে সে কি জানে?
“আরে! তুমি ছাদে বসে বাচ্চাদের সামনে সিগারেট ফুঁকছো। আর ওদিক তোমার বন্ধুরা বসে আছে। ফোনটাও তো ধরছো না?”
“আরে তাই তো!” আনিস চমকে ওঠে। বাচ্চাদের সামনে কখন সে সিগারেট ধরাল? এমনটা তো সে কক্ষণো করে না।
বাচ্চা ছেলে-মেয়েগুলো ছাদের একটি মাত্র দোলনায় পালাকরে দোল খাচ্ছে। তাদের মধ্যে আনিস ও তমার আট বছরের একমাত্র মেয়ে বাঁধনও আছে।
আরিফ, আনিসের কলিগ ফিসফিস করে তার বউ হেনাকে বলে, “দেখো তমা ভাবীকে আজ একেবারে অপ্সরার মতো লাগছে। ”
হেনা বলে, “তোমার তো নিজের বউ ছাড়া সব মেয়েকেই ভালো লাগে। ”—কিছু দিন আগে হেনার বাড়ির কাজের বুয়া অভিযোগ করেছিল, “ভাবী আফনের সাহেবের নজর ভালো না। আফনাদের বাড়িতে আমি কাজ করব না। ” হেনা বুয়ার কথা অস্বীকার করে তাকে বকাবকি করে বিদায় করলেও আরিফকে ছাড়েনি। এই নিয়ে ওদের সংসারে কম অশান্তি হয়নি।
২.
“দুজনে একসাথে নাইফটা ধরুন। আরেকটু ক্লোজ। ” একের পর এক স্ন্যাপ নিয়ে চলেছে অনিসের বন্ধু অমল—শৌখিন ফটোগ্রাফার।
“ভাবী ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে একটু হাসুন”—অমল বলে। কেকের চারপাশ দিয়ে ‘Happy Marriage Anniversary’ বাঁকা চাঁদের মতো করে লেখা। মাঝ বরাবর লেখা—‘Ten years’। কেকের চারিপাশে দশটি রঙবেরঙের মোমবাতি মিটিমিটি জ্বলে চলেছে। মানুষের চাপাচাপিতে টেবিলটা যেভাবে নড়ছে ঠিক যেন একটা ছোটখাটো ভূমিকম্প। মোমবাতিগুলো যেকোন সময় পড়ে যেতে পারে। আনিস ভাবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওগুলো নিভিয়ে ফেলা দরকার। তমার শরীরের পরিচিত ঘ্রাণটা মানুষের ভিড়ে আজ অনেক অচেনা ঠেকছে আনিসের কাছে। তমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়ার চেষ্টা করল আনিস। উত্তরে তমা নির্জীব চোখে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করল। ফুঁ দিয়ে ওরা দু’জনে মোমবাতি নেভাল—কেক কাটল। করতালিতে মুখরিত নৈঃশব্দের সাথে সাথে সন্ধ্যাটাকেও যেন গিলে খাচ্ছে উপস্থিত জনারণ্যে। ক্যামেরার ফ্লাশের আলো আনিসের চোখে এসে পড়ছে। সব মেকি! সব যেন মেকি। প্লাস্টিকে মোড়া প্যাকেজ জীবন। জীবন হলেও এ জীবনে স্পন্দন নেই। আনিসের এমনটি মনে হয়। কেন মনে হয়? স্ত্রী হিসেবে তমার সততার কি কোনো ঘাটতি আছে? নাহ, সে তো নেই। সন্তান, স্বামীর প্রতি দায়িত্বে কোনো অবহেলা? নাহ, তবে কেন? দুজনে এত দূরত্ব?...
আরিফ, আনিসের কলিগ ফিসফিস করে তার বউ হেনাকে বলে, “দেখো তমা ভাবীকে আজ একেবারে অপ্সরার মতো লাগছে। ”
হেনা বলে, “তোমার তো নিজের বউ ছাড়া সব মেয়েকেই ভালো লাগে। ”—কিছু দিন আগে হেনার বাড়ির কাজের বুয়া অভিযোগ করেছিল, “ভাবী আফনের সাহেবের নজর ভালো না। আফনাদের বাড়িতে আমি কাজ করব না। ” হেনা বুয়ার কথা অস্বীকার করে তাকে বকাবকি করে বিদায় করলেও আরিফকে ছাড়েনি। এই নিয়ে ওদের সংসারে কম অশান্তি হয়নি।
হেনার উত্তরে আরিফ দমে যায়। চুপচাপ হাতের খাবারের প্লেটে মনোযোগ দেয়।
আনিসকে সবাই ঘিরে ধরেছে। আনিসের এক কলিগ প্রফেসর তারেক বলে, “আরে ভাই, কাজটা ভালো করেন নাই। দাওয়াত করলেন কিন্তু হেতু কইলেন না। বললে অন্তত ভাবীর জন্য ক’টা রজনীগন্ধার স্টিক তো আনতে পারতাম। ”
“একটু রহস্য রাখলে সমস্যা কী? এসে জানলেন সেটাই ভালো হলো না?” উপলক্ষ না জনিয়ে অতিথিদের নিমন্ত্রণ করতে আনিস পছন্দ করে। এবারও তেমনটি করেছে। তমা তার বান্ধবী অনিলাকে একটু বেশি সময় দিচ্ছে—অনিলা কাস্টমসের এক কর্মকর্তার বউ। তমার জন্য একটা দামি নেকলেস নিয়ে এসেছে। পার্টিতে একজন গেস্টকে এভাবে বেশি গুরুত্ব দেয়া ঠিক না, কিন্তু সে কিভাবে বোঝাবে তমাকে? কী বোঝাতে কী বুঝে বসে। ভাগ্যিস অনিলার কাস্টমস অফিসার স্বামী আজ আসেনি। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বললে আনিসের শরীরে শীতেও ঘাম আসে। দেশ-বিদেশে ভ্রমণ আর দামি দামি অ্যানটিক পিস সংগ্রহে তার নেশা—সেই সব নিয়েই সে বকতে থাকে অনর্গল। আনিসের এসব গল্প একেবারে ভালো লাগে না।
৩.
বাঁধন খাবারের একটি প্লেট নিয়ে দোতলায় তার দাদুর ঘরে এলো। ক’দিন ধরে তার দাদির শ্বাস কষ্টটা বেড়েছে। সর্বক্ষণ অক্সিজেন চলে। দাদুর চোখ দুটো মাছের চোখের মতো ভাবলেশহীন। ঘুমিয়েছে কি জেগে আছে বোঝা যায় না। বাঁধন বলে, “দাদি, আব্বু-আম্মুর ম্যারেজ ডে’র কেকটা তুমি খাবে না?” উত্তরে তার দাদুর চোখের তারাটা নেচে ওঠে। স্যুপ ছাড়া অন্য কিছু খাওয়া হয়নি ক’দিন তার। ইশারায় কথা বলছে সপ্তাখানেক হলো। শেফালি সকালে দাদুকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে একটা নতুন শাড়ি পরিয়ে দিয়ে গেছে তারপর সে একটি বারও এ ঘরমুখো হয়নি। পার্টির আয়োজন নিয়ে সে বন্ধনের মায়ের সাথে ব্যস্ত। “দাদু সারা দিন তোমার কিছু খাওয়া হয়নি। খাবে কিছু?”
উত্তরে দাদি তার কিছু বলতে পারে না। সে সিলিংয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। “এত সময় ধরে উপরে তাকিয়ে থেকে কী দেখো দাদু”—অনেকবার এ প্রশ্ন করেছে বাঁধন। উত্তর পায় নি। মাঝে মাঝে শুধু চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। তা দেখে বন্ধনের কষ্ট হয় ভীষণ। শেফালিটা যে কী? দাদুর একেবারে খেয়াল রাখতে চায় না। খালি ফাঁকি দিয়ে টিভি দেখে। দাদুর খবর নেয় না। কিছু বলতে গেলে মা বলে, “শেফালি চলে গেলে আরেকটা শেফালি কোথায় পাবে তুমি? তখন তোমাকে সব করতে হবে। তুমি তো ছোট পারবে তো? পারবে কিনা ভেবে দেখো?” বাঁধন জানে যেদিন দাদু ভালো হয়ে যাবে সেদিন বাঁধন আর দাদু মিলে শেফালিকে অনেক বকবে।
“দাদু—বাইরে অনেক মানুষ—আমি ছাদে খেলা করছিলাম—হঠাৎ মনে হলো তুমি একা একা কষ্ট পাচ্ছ তাই চলে এলাম—বাড়িতে অনেক অনেক মানুষ, আমার সব বন্ধুরা এসেছে—তুমি তো কিছুই দেখতে পেলে না। ”
হঠাৎ বাঁধন আর অরিন কোথা থেকে দৌড়ে এলো উপরে। “আরে তোমরা কী করছো এখানে? যাও অন্য কোথাও খেল গে। তোমাদের দৌড়াদৌড়িতে অক্সিজেনের মাস্কটা খুলে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ” তিথি বিরক্ত হয়ে বলে।
“কী হবে ফুপুনি?” বাঁধন জিজ্ঞেস করে।
“তোমার দাদু অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে। সাবধান! তখন কোথায় দাদু পাবে?
৪.
পার্টির শেষ মুহূর্তে আনিসের বোন তিথি এলো হন্তদন্ত হয়ে। গিফট টেবিলে রেখে সরাসরি উপরে মায়ের ঘরে চলে গেল। সঙ্গে ছিল তার স্বামী আহাদ, ছেলে অরিন। আহাদ আনিসের সাথে নিচে ড্রইং রুমে বসল। অরিন বয়সে বন্ধনের দুবছরের ছোট। ওরা একে অপরকে পেয়ে আনন্দে সে কি ছুটোছুটি। আনিস ওদের দুজনের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল।
তিথি উপরে গিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকল—বাড়ি থেকে সে মায়ের জন্য স্যুপ এনেছিল। সেটা নল দিয়ে মায়ের মুখে তুলে দিতে দিতে ওড়নার কোণে নিজের চোখ দুটো মুচ্ছিল বারবার, “গত বছরও তো মা তুমি ভাইয়ার বিবাহ বার্ষিকীতে বাঁধন, অরিনের সাথে কত আনন্দ করেছিলে—অসুস্থ ছিলে কিন্তু উঠে বসতে পারতে, আস্তে আস্তে কথা বলতে পারতে—আমাদের ভাই-বোনের কপালটাই খারাপ—অকালে বাবাকে হারালাম এখন তোমার এই অবস্থা। মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মানো কত যে কষ্ট মা—ইচ্ছে থাকলেও তোমার সেবা করতে পারছি না—রাতে ঘুমাতে গেলে বুক ধুক ধুক করে—সকালে উঠে কি মাকে দেখার সুযাগ হবে—মাঝরাতে কি কান্নাভরা কণ্ঠে ভাইয়ার ফোন পাব—মা আর নেইরে তিথি। ” তিথির কথা শুনে মায়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দিয়ে স্যুপ গড়িয়ে গাল মেখে যায়। “সাত দিনের ট্যুরে বিদেশ যাচ্ছি মা—ফোনে তোমার খবর নিব—যেতে তো ইচ্ছে করে না মা—কিন্তু কী করব চাকরি যে। ”
হঠাৎ বাঁধন আর অরিন কোথা থেকে দৌড়ে এলো উপরে। “আরে তোমরা কী করছো এখানে? যাও অন্য কোথাও খেল গে। তোমাদের দৌড়াদৌড়িতে অক্সিজেনের মাস্কটা খুলে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ” তিথি বিরক্ত হয়ে বলে।
“কী হবে ফুপুনি?” বাঁধন জিজ্ঞেস করে।
“তোমার দাদু অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে। সাবধান! তখন কোথায় দাদু পাবে? যাও নিচে। অরিন নিচে যাও তোমার আপুর সাথে খেলো গে। ”
৫.
তমা পার্টি-ড্রেসেই শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে। ওকে দেখে আনিসের ভীষণ লোভ হচ্ছে, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। সে দুদিন আগে বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে বায়তুল মোকাররাম মার্কেট থেকে তমার জন্য একটা নেকলেস কিনে এনেছে কিন্তু এখনো সেটা তমাকে দেয়ার সাহস হচ্ছে না। ক’দিন ধরে দুজনের কথা বলাবলি প্রায় বন্ধ। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনিসের পিএইচডি করার একটা সুযোগ এসেছিল তমার শত অনুরোধের পরও সে সেটা রিফিউজ করেছে। অথচ পিএইচডির এই স্কলারশিপটার জন্য দুবছর আগে কত না দৌড়াদৌড়ি করেছে আনিস—কিন্তু তখন তো মা তার সুস্থ ছিল। এটা আনিসের জন্য বিরাট একটা সুযোগ ছিল। হয়ত জার্মানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তার একটা চাকরিও জুটে যেতে পারত। তমা তার দিক থেকে ঠিক আছে কিন্তু অসুস্থ মাকে ফেলে সে যায় কিভাবে? কে দেখবে তার মাকে। তমা ভুলেও তার মায়ের ঘরটাতে একবারও যায় কি না আনিসের সন্দেহ আছে। আগে দুয়েকবার যেত। তিথিটা এসে মায়ের ঠিকমতো যত্ন হয় না—এই প্রসঙ্গ তুলে তুলকালাম কাণ্ড করে গেল। তারপর থেকে তমা ও ঘরে পা মাড়ায় না। আনিস সাহস করে কিছু বলতে পারে না। বললে আরেকটা কুরুক্ষেত্র হবে বাসায়। সবচেয়ে বড় কথা একমাত্র ছেলের বউয়ের এই অবহেলা মাকে কী ধরনের মানসিক যন্ত্রণা সেটা ভেবে আনিসের মন খারাপ হয়ে যায়। মায়ের এই যন্ত্রণাটা যে কী ভয়াবহ কেউ না বুঝলেও আনিস তা বোঝে। কিন্তু তার কী করার আছে। সেদিন বুঝিয়ে বলছিল তমাকে, “দেখো মা যেভাবে বিছানায় পড়েছে, আজ আছে কাল নাই অবস্থা। তিথির ওপর রাগ করে তুমি মায়ের ঘরে যাচ্ছো না। কিন্তু মা কত কষ্ট পাচ্ছে ভেবে দেখো? নিজেকে আরো বেশি অসহায় ভাববে। মা ভাববে বউ আমাকে বোঝা ভাবছে। এমনিতেই মা কত কষ্টে আছে একবার হৃদয় দিয়ে অনুভব করে দেখো। তুমি যদি তার শিয়রে দাঁড়িয়ে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। তোমার কি কোনো ক্ষতি হবে? অসুস্থ মানুষ অন্তর থেকে দোয়া করবে। ”
আনিসের কথা শুনে তমার চোখ জলে ভরে ওঠে, “আমি কি চাই না শাশুড়ির কাছে যেতে, তার সাথে কথা বলতে—একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে? কিন্তু সেসব পুরনো কথাগুলো আমার বারবার মনে পড়ে যায়। চুন থেকে পান খসলেই তোমার মা আমাকে কত না কথা শোনাত। তিথি এসে উল্টোপাল্টা কথা বলে তোমার মায়ের কান ভারী করত আর তোমার মা সেসব কথা শুনে আমাকে মানসিক যন্ত্রণা দিত। তোমার মার জন্য আমি যতই করি সে কখনো আমাকে আপন ভাববে না। পরের বাড়ির মেয়ে সব ছেড়ে এসেছে তাকে নিজের মেয়ের মতো আপন করে নিতে চায়নি কখনো। ”
“আমার মা একটু পুরনো ধরনের। সে অনেক কষ্ট করে সংসার করেছে। তার মধ্যে জমে থাকা পুরনো ক্ষোভ আর সেকেলে ধ্যান-ধারনাগুলোর কারণেই তোমার সাথে ঝামেলা হয়েছে। আমি কী করব বলো। আগের ওসব কথা মনে রেখে লাভ কী তমা?”
“মনে তো আমি রাখতে চাই না কিন্তু বারবার তোমার বোন এসে আমাকে মনে করিয়ে দেয়। ”
নিষ্প্রাণ চোখে সিলিংয়ে তাকিয়েছিল তমা। “পার্টির পোশাক খুলে ফ্রেশ হয়ে নাও। ” আনিস বলে।
“তোমার বোন ইংল্যান্ড যাচ্ছে, শুনেছো?” স্থির পাথরের মতো শুয়ে থেকে তমা বলে।
“শুনেছি সাত দিনের ট্যুর। ”
“সপরিবারে। ”
“হ্যাঁ। সারা দিন তো অনেক ধকল গেল। যাও, পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ” তমার কথায় অভিমানের ঝাল অনুভব করে আনিস আবার বলে।
“তোমার মতো আমারও এখন আর পার্টি ভালো লাগে না। ”
“হুম। ” বিছানার বিপরীত পাশে আনিস শুয়ে পড়ে।
“কিন্তু বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনরা মনে রাখে দিনটা। ওদের কারণে পার্টি না দিয়ে পারা যায় না। মনের মধ্যে শান্তি না থাকলে এসবে কি আনন্দ আসে বলো? আরো কষ্ট—বার্ডেন মনে হয়। ”
“হুম। ”
“তোমার বোন কিন্তু অসুস্থ মাকে ফেলে দিব্যি ট্যুরে চলে যাচ্ছে। অথচ তুমি ক্যারিয়ারের প্রয়োজনেও গেলে না। তোমার বোনের মুখেই শুধু বড় বড় কথা। আমারে বলে কী, ‘মাকে দেখো ভাবী। ’ আমি যেন তার আদেশের গোলাম। ”
“আজকের দিনে অন্তত এসব বাদ দাও। ”
“বাদই তো দিয়ে দিচ্ছি চির দিনের জন্য। ” কথাটা বেশ জোরেই বলে তমা। বাঁধন আজ নিজের ঘরে না গিয়ে বাবা-মায়ের পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তমার চিৎকারে ওর ঘুম ভেঙে গেল। বাবা-মা ঝগড়া করলে ভয়ে তার বুকে ধুকধুকি শুরু হয়ে যায়। ভীষণ ভয় পায় সে এ বিষয়টিকে। তমা শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “ভাইয়া আজকে আমেরিকা থেকে ফোন করেছিল—আমাদের কংগ্র্যাচুলেট করার জন্য। আজ ভাইয়াকে সব খুলে বলেছি। ভাইয়া তো আমেরিকা যাবার আগেই সব জানত। তোমার মা-বোনের আগের সব ব্যবহারের কথা দেশে থাকতেই তো শুনেছে। আর তোমার নির্জীব নিষ্ক্রিয় আচরণ—হা করে চেয়ে বউকে অপমানিত হতে দেখা। আমি আর পারছি না আনিস। ভাইয়া আমাকে আর বাঁধনকে আমেরিকায় নেয়ার ব্যবস্থা করবে। এমএ.টা যখন করেছি, সেখানে গিয়ে টুকটাক কাজ করে জীবন চালিয়ে নিতে পারব। তোমার সাথে এভাবে ধুকে ধুকে বেঁচে থাকা আর না। ” তমা হু হু করে কেঁদে ওঠে।
“আম্মু তুমি তোমার ঘরে যাও। ” মেয়ের কপালে চুমু খেলো আনিস। বাঁধন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আনিস বলে, “আমার কথাটা কি একবারও ভাববে না?”
“তোমার কথা ভেবে তো এতদিন মুখ বুঁজে পড়ে ছিলাম। আর পারছি না। আমি পাগল হয়ে যাব—না হয় আত্মহত্যা করতে হবে। তুমি চাইলে আরেকটা বিয়ে করো। আমি যাবার সময় অনুমতির কাগজে স্বাক্ষর করে দিব। ”
“আচ্ছা এখন ঘুমাও পরে দেখা যাবে। আনিস লাইটটা নিভিয়ে দেয়। ”
আম্মু আবার আব্বুর সাথে তোমাকে নিয়ে ঝগড়া করছে—না দাদু, এবার ঝগড়া তেমন না। আম্মু বলল, আমাকে নিয়ে আমেরিকায় মামার কাছে চলে যবে—বলো তো দাদু বাবার কী হবে—বাবা আমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না—আমিও আব্বুকে ছাড়া থাকব কী করে—তুমি কেন সেরে ওঠো না দাদু—কথাও বলতে পার না—বেশি বেশি করে ঔষধ খেতে পার না—তুমি সেরে উঠলে আম্মু এ বাড়ি ছেড়ে যেত না।
৬.
বাঁধন কিন্তু নিজের ঘরে যায়নি। সে দরজার আঁড়ালে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল। তার ভীষণ ভয় হচ্ছে। বাবাকে ছাড়া সে তো থাকতে পারবে না—মাকে ছাড়াও না। বাবাকে রেখে মা ওকে নিয়ে আমেরিকা চলে গেলে বাবা তো মরেই যাবে—তাকে না দেখে এক মুহূর্ত থাকতে পারে না তার বাবা। মা কেন এমন করছে? এখন তো তার দাদি অসুস্থ আর তো দাদি তার মায়ের সাথে রাগারাগি করে না...। এসব ভাবতে ভাবতে বাঁধন সিঁড়ি ঘরে চলে আসে। সিঁড়ি ঘরের ছোট ছোট ঘুলঘুলি দিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করে। দেখতে পায় না কিছুই। বাইরে ভূতুড়ে অন্ধকার। ভূত-পেতি, ঘোস্টরা যেন আড়ালে লুকিয়ে ওকে দেখছে। ওদের ভয়ানক চেহারাগুলো ওর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওরা কালো চাদরে মুড়ে হাওয়ায় বসে বসে বাঁধনের কষ্ট নিয়ে পরিহাস করছে। তবু নির্বিকার নিরাসক্তের মতো সে ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। অন্য সময় হয়ত সে ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিত। তার ভেতরের আতঙ্ক তার ভয়কে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে। ...দাদু অসুস্থ হলে বাবার কী দোষ? ফুপি বিদেশ গেলে বাবার কী দোষ? মা কেন বাবাকে এভাবে বলে? বাঁধন দোতলায় দাদুর ঘরে এসে ঢোকে। বাঁধনের মন খারাপ হলে এ ঘরে এসে দাদুর সাথে গল্প করলে তার মন ভালো হয়ে যায়। যদিও ক’দিন ধরে দাদু কথা বলতে পারছে না। তবে তার কথা যে শুনতে পায়, বাঁধন তার চোখের দিকে তাকিয়েই তা বুঝতে পারে। বাঁধন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। নিজের মুখ সে নিজ হাতে চেপে ধরে—মা বাবার ঘরে যেন তার কান্নার শব্দ না যায়। তার দাদুর মাছের চোখের মতো স্থির চোখ দুটো হঠাৎ কেঁপে কেঁপে ওঠে। সে চোখের ভয়ানক যন্ত্রণা শিশু বাঁধনও স্পষ্ট বুঝতে পারে।
আম্মু আবার আব্বুর সাথে তোমাকে নিয়ে ঝগড়া করছে—না দাদু, এবার ঝগড়া তেমন না। আম্মু বলল, আমাকে নিয়ে আমেরিকায় মামার কাছে চলে যবে—বলো তো দাদু বাবার কী হবে—বাবা আমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না—আমিও আব্বুকে ছাড়া থাকব কী করে—তুমি কেন সেরে ওঠো না দাদু—কথাও বলতে পার না—বেশি বেশি করে ঔষধ খেতে পার না—তুমি সেরে উঠলে আম্মু এ বাড়ি ছেড়ে যেত না।
দাদুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। “তুমি কাঁদছো দাদু?” ঘরটির এক কোণে কাজের মেয়ে শেফালি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। বাঁধনের কাছে সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে ভীষণ আতঙ্কিত। বাঁধন দাদুর গালে চুমু খায়। বাঁধনের চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ে। দাদু যখন তার সুস্থ ছিল তাকে নিয়ে স্কুলে যেত। তাকে মজার মজার গল্প শোনাত। দাদা ভাইয়ের কথা বলত। বাবা ছোটতে কী কী দুষ্টুমি করত তাও বেশ মজা করে বলত। আর এখন পাথরের মতো শুয়ে থাকে।
দাদুর গালে সে আরো একটা চুমু খায়। দাদুর মুখের সাথে লাগানো অক্সিজেনের মাস্কটা দুহাতে নাড়াচাড়া করতে থাকে বাঁধন। তার ফুপুনি বলেছিল, এটা অক্সিজেনের মাস্ক। দাদু ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারে না তাই এটার সাহায্যে শ্বাস নেয়। এটা সরিয়ে ফেললে দাদু মারা যাবে। তখন তো দাদু দাদার মতো ঐ আকাশের তারা হয়ে যাবে। তাহলে কি আম্মু বাবাকে ছেড়ে আর আমেরিকা যাবে না?
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৫