শৈশবে, স্কুল শিক্ষকের মুখেই সম্ভবত প্রথম শুনেছি যতীন স্যারের নাম। ব্যাকরণ ক্লাসে যতিচিহ্ন বসিয়ে, ব্লাকবোর্ডে সমাস, কারক-বিভক্তির সাদা অক্ষর মুছতে মুছতে পড়ানোর এক অদ্ভুত তৃপ্তিতে স্যার আমাদের চোখের সামনে দাঁড়াতেন।
সেই কুয়াশা ভেজার এক সন্ধ্যারাতে আমি যতীন স্যারকে আবিষ্কার করি। দেখি, মঞ্চে ধূতি পরা বিদ্যাসাগর সাইজের একজন মানুষ বক্তৃতা করছেন। বক্তৃতার কী তেজ! কী স্বর! ভাষার কী স্রোত! বাক্যের ভেতরে আবেগ ঢালার প্রকৌশলে মাঠের প্রায় সমস্ত লোকই তখন বক্তৃতা মঞ্চের দিকে। বক্তৃতার ভেতরে ঢুকে মগ্নতার এই চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট শ্রোতৃমণ্ডলিরা হয়ত কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামাই দেখছিলেন। হাততালি দিচ্ছিলেন। শ্রোতারা হয়ত বক্তার উইট ব্যবহারে হাসছিলেন, আবার চোখের সাথে সাথে মনটাকে স্থির করে রেখেছেন কথার ভেতর।
নেত্রকোণায় প্রতিবছর তখন খুব জমজমাট পৌষমেলা। সার্কাসের গোলাকার বিশ্বকে দেখতে, ঢাকার কবি-সাহিত্যিকদের কথা শুনতে, শিল্পীদের গান শুনতে ডিসেম্বরের এই রাতে ছোট শহরের মানুষেরা মোক্তারপাড়ার মাঠে আসে। কবি-শিল্পীদের মুখ দেখতে মেলার আশেপাশে ঘুর-ঘুর করে। আমরা কলেজ পড়ুয়ারা হয়ত কারণ ছাড়াই ঢুকেছি। রবীন্দ্রনাথের ‘হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোন খানে’র মুড নিয়ে ঢুকেছি। উদ্দেশ্যহীনভাবেই টিউবলাইটের নিচে দাঁড়িয়ে বাদাম খাচ্ছি। একে-তাকে দেখি আর কুয়াশায় ভিজি। সেই কুয়াশা ভেজার এক সন্ধ্যারাতে আমি যতীন স্যারকে আবিষ্কার করি। দেখি, মঞ্চে ধূতি পরা বিদ্যাসাগর সাইজের একজন মানুষ বক্তৃতা করছেন। বক্তৃতার কী তেজ! কী স্বর! ভাষার কী স্রোত! বাক্যের ভেতরে আবেগ ঢালার প্রকৌশলে মাঠের প্রায় সমস্ত লোকই তখন বক্তৃতা মঞ্চের দিকে। বক্তৃতার ভেতরে ঢুকে মগ্নতার এই চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট শ্রোতৃমণ্ডলিরা হয়ত কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামাই দেখছিলেন। হাততালি দিচ্ছিলেন। শ্রোতারা হয়ত বক্তার উইট ব্যবহারে হাসছিলেন, আবার চোখের সাথে সাথে মনটাকে স্থির করে রেখেছেন কথার ভেতর। বক্তৃতা শোনার সেই মগ্ন মুহূর্তেই শুনেছি ইনি যতীন সরকার। জীবনে এই প্রথম একজন বক্তাকে দেখলাম, কী পরম তার উচ্চারণ! যিনি কথা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, নিজের অর্জিত বিশ্বাস দিয়ে মানুষকে কাছে ডাকছেন। কাছে ডাকছেন মানে একজন সৎ এবং বিবেকবান মানুষ জীবনাভিজ্ঞানকে চিন্তার ইতিহাস দিয়ে, ইতিহাসের ইতিহাস দিয়ে বিশ্লেষণ করছেন।
মেলার কুয়াশায় ভিজতে ভিজতে কণ্ঠস্বরের তীব্র স্রোতে অবগাহন করতে করতে যতীন সরকার আমার মনে বসে ছিলেন। মনে যিনি বসে থাকে তিনিই মনের মানুষ। মনের মানুষকে বাইরের আলোকে দেখতে ইচ্ছে করে। বাইরের আলোয় মনের মানুষের প্রকৃত পরিচয়। স্যার তখন নাসিরাবাদ কলেজের কর্মজীবন শেষ করে নেত্রকোণায় আবাস গেড়েছেন। বাড়ির নাম দিয়েছেন ‘বাণপ্রস্থ’। স্যারের বাসা থেকে আমার বাসা দু’মিনিটের পথ। একদিন দ্বিধা, সংকোচ, আড়ষ্টতা অতিক্রম করে স্যারের বাসায় যাই। চলে যাই অন্তরের কাছে। চুপ করে বসে থাকি। কথা শুনি। অনুভব করতে চেষ্টা করি একজন শ্রীমানের প্রজ্ঞা ও অর্জনের জগৎ। প্রথম সাক্ষাতেই বুঝি, স্যার তারুণ্যের সাথে মিশতে জানেন। নিজেকে মেশাতে জানেন। যতীন সরকার মাটি ভেদ করা উদ্ভিদের মতো অর্জিত আলোকে, অর্জিত প্রজ্ঞাকে বাইরের আলোকে ছড়িয়ে দেন। এই ছড়িয়ে দেয়াকে তিনি দায়িত্ব মনে করেন। এই ছড়িয়ে দেয়াটাকে তিনি মাস্টারির কাজ মনে করেন। তিনি মাস্টার হতে চেয়েছেন। মাস্টার ছাড়া আর কিছুই হতে চাননি।
২.
যতীন স্যারের প্রধান পরিচয় তিনি লেখক। একজন পূর্ণাঙ্গ খাঁটি লেখক। কিন্তু তিনি বলেন, “আমার প্রথম এবং প্রধান পরিচয় আমি মাস্টার। আমি মাস্টার হতে চেয়েছি। মাস্টার হয়েছি। মাস্টারি ছাড়া আমি আর কিছুই করতে চাইনি। আমার বক্তৃতা কিংবা লেখালেখি এসবই মাস্টারির অংশ। ” এখন প্রশ্ন হতে পারে যতীন স্যারের মাস্টারিটা আলাদা আবার কী জিনিস? এই মাস্টারি জিনিসটা তাঁর কাছে এত প্রিয়ই বা হবে কেন? কেন তিনি লেখালেখি কিংবা বক্তৃতাকে মাস্টারির অংশ বিবেচনা করছেন? লোকজন তাঁকে বলে তিনি ‘বামপন্থী লোক’, ‘মার্ক্সবাদী লোক’। এটা লোকজনের আখ্যা ও বলা। তিনি নিজেকে বলেন “আমি ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী’ লোক। আমার বিশ্বাস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে। ”
তিনি বলেন, সময় ও পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করার এই মন্ত্রটা তিনি গোপাল হালদার, সত্যেন সেন, রণেশ দাশ গুপ্ত, মনোবিদ ধীরেন্দ্র নাথ গঙ্গোপাধ্যায়দের কাছে শিখেছেন। এই মন্ত্রে তিনি প্রাচীন ভারতের সাম্যবাদী সমাজ থেকে শিক্ষা নিতে বলেন। ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’ গ্রন্থে তিনি সাম্যবাদী ঋত সমাজের কথা বলেন। বরুণের যে সমাজ, মানবিক যে সমাজ, বুদ্ধ-মহাবীরের যে সমাজ—সেই সমাজের সত্যগুলো আমাদের সামনে উন্মোচন করেন।
মার্ক্সবাদ ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পার্থক্যটা খুবই স্পষ্ট। ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে’র অর্থ ব্যাপক ও চিরায়ত। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী শুধু মার্ক্সবাদী নন—বরং তিনিই—যিনি সকল বাদের ভেতর থেকে সত্য অন্বেষণের মন্ত্রটা জানেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মন্ত্র দিয়ে সময় ও পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করা যায়। তিনি বলেন, সময় ও পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করার এই মন্ত্রটা তিনি গোপাল হালদার, সত্যেন সেন, রণেশ দাশ গুপ্ত, মনোবিদ ধীরেন্দ্র নাথ গঙ্গোপাধ্যায়দের কাছে শিখেছেন। এই মন্ত্রে তিনি প্রাচীন ভারতের সাম্যবাদী সমাজ থেকে শিক্ষা নিতে বলেন। ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’ গ্রন্থে তিনি সাম্যবাদী ঋত সমাজের কথা বলেন। বরুণের যে সমাজ, মানবিক যে সমাজ, বুদ্ধ-মহাবীরের যে সমাজ—সেই সমাজের সত্যগুলো আমাদের সামনে উন্মোচন করেন। সমাজতন্ত্রের হাত ধরে যতীন সরকার আসলে শ্রেণিহীন ঋত সমাজের বার্তা বহন করেন।
তিনি যান্ত্রিক ও তাত্ত্বিক মার্ক্সবাদী নন। একটা আদর্শিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী চিন্তার ভেতর দিয়ে শোষণমুক্ত মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিত্য লড়াই করছেন তিনি। এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আদর্শের প্রজ্ঞা জন থেকে জনে বোঝানোর জন্য, সময় থেকে সময়ে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যই তিনি শিক্ষকতা করেন, বক্তৃতা করেন, লেখালেখি করেন। যতীন সরকারের ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ হচ্ছে তাঁর আদর্শ ও মূল্যবোধ। এই আদর্শ ও মূল্যবোধের স্পিরিট থেকে তিনি বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যও পুনর্নবায়নের চেষ্টা করেন। কবি কুৎসের মতো যতীন সরকারও এই সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধার করতে চান। আসলে লেখক তার সমগ্র লেখায় এই দর্শনকেই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের এই চেষ্টা খুব কম সংখ্যক বাঙালি লেখকই করেছেন।
৩.
একটি গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক জনসংস্কৃতির জল হাওয়ায় জন্মেছেন তিনি। আত্মপরিচয় অনুসন্ধানী প্রকৃতির সন্তান তিনি। প্রকৃতির সত্যকে তিনি স্বীকার করেন। কৃষকের সংস্কৃতিকেই ভাবেন মূলধারার সংস্কৃতি। জাতির কানে কানে তিনি পুরুষ পরম্পরায় বহমান এই মূলধারার স্বর ও সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিতে চান। তিনি জানেন এগিয়ে চলাই জীবন। এক্ষেত্রে তিনি ‘চরৈবেতি চরৈবেতি’ সংস্কৃতির উত্তর সাধক। প্রকৃতির প্রাকৃতিক মতবাদকে তিনি পছন্দ করেন। প্রকৃতির মতবাদে দৌড়বিদদের রেকর্ড করার প্রবণতা—প্রাকৃতিক মতবাদ হচ্ছে নিয়মের মতবাদ। এই মতবাদকে নিয়ে কাজ করেন বলেই তিনি প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির এই সন্তান প্রকৃতিকেই সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন। তিনি প্রকৃতির চলমান সংস্কৃতিকেই রক্ষা করে যাচ্ছেন। তিনি সংস্কৃতির সাথে সংস্কৃতির সেতু বেঁধে যাচ্ছেন।
এই দায়ে তিনি ‘প্রাকৃতজনের জীবন দর্শন’ লেখেন। এই দায়ে কৃষকের সংস্কৃতিকে তিনি মূলধারার সংস্কৃতি বলেন। নজরুল, জালাল কিংবা জসীমউদ্দীনের কবিতাকে বলেন মূলধারার কবিতা। এই দায়ে তিনি তরুণ থাকতে চান। বেঁচে থাকতে চান শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আঙুলে শক্তি চান। লিখে যেতে চান। শেষ পর্যন্ত তিনি তরুণের পাশেই থাকতে চান। তরুণের পাশে থেকে তারুণ্যের কথা বলতে চান।
বাঙালি প্রগতিশীলরা যখন ইকবালকে দূরে ঠেলেন, তখন ইকবালের পঙক্তির ভেতর থেকে লেখক তুলে এনেছেন শ্রেণিহীন মানবিক সমাজের পাঠ। তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে, প্রগতিশীলরা ইকবালকে ত্যাগ করেছে বলেই ইকবাল প্রতিক্রিয়াশীলদের ব্যাখ্যার পুতুল হয়েছেন। অথচ ইকবালের সাহিত্যে আছে সত্য ও আলোর প্রত্যয়। স্বাধীনতার পর সবাই যখন ইকবালের কবিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে তখন তিনি লেখেন ইকবাল আমাদের। বরং একটি বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে লেখক বলেছেন ইকবাল আমাদের, ইকবাল মুক্তির দূত। —“শিল্প-সাহিত্য তথা সভ্যতার সংকটমুক্তির জন্য আজকে প্রত্যয়ের সাহিত্য-দর্শনের প্রয়োজন বড় বেশি। ইকবালের দর্শনে ও সাহিত্যে সেই প্রত্যয়ের আলোই দীপ্যমান। সে আলোর জন্যই ইকবালকে আমাদের একান্ত আপন করা চাই। আর তার জন্যই চাই প্রতিক্রিয়াশীল ভাষ্যেও রাহুগ্রাস থেকে ইকবাল-সূর্যের মুক্তি। ”
৪.
যতীন সরকার একজন উদারপন্থী প্রজ্ঞাবান মানুষ। পুঁজিবাদী ও কর্পোরেট দুনিয়ার বিপুল ঝাঁকুনিতে আমরা সবাই প্রায় আত্মমোহে নিবেদিত। কিন্তু আত্মমোহের বাইরে তিনি নিভৃত ও একাকী বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারে লড়াই করে যাচ্ছেন। সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের এই লড়াইটাই যতীন সরকারের রাজনীতি। ফুকোর মতো তিনিও জানেন, জ্ঞান হচ্ছে ক্ষমতা। জ্ঞানের এই ক্ষমতা দিয়েও তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে রাস্তায় পরিভ্রমণ করতে চান না। মাস্টারিটা তিনি দায় নিয়ে করেন। সময়ের উত্তরাধিকারের কাছে তাই তিনি ওয়াদাবদ্ধ। এই দায়ে তিনি ‘প্রাকৃতজনের জীবন দর্শন’ লেখেন। এই দায়ে কৃষকের সংস্কৃতিকে তিনি মূলধারার সংস্কৃতি বলেন। নজরুল, জালাল কিংবা জসীমউদ্দীনের কবিতাকে বলেন মূলধারার কবিতা। এই দায়ে তিনি তরুণ থাকতে চান। বেঁচে থাকতে চান শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আঙুলে শক্তি চান। লিখে যেতে চান। শেষ পর্যন্ত তিনি তরুণের পাশেই থাকতে চান। তরুণের পাশে থেকে তারুণ্যের কথা বলতে চান। যতীন সরকারের তারুণ্যের কথা মানেই বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কথা। সাম্যবাদী ঋত সমাজের কথা। প্রাকৃতজনের জীবন দর্শনের কথা। এই কথা লোক থেকে লোকে, কাল থেকে কালে পৌঁছে যাক—এটাই তিনি চান। এই পৌঁছে দেয়ার কাজটাই যতীন সরকারের মাস্টারি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৫