ঢাকা, শনিবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অ্যান সেক্সটনের একগুচ্ছ কবিতা | অনুবাদ ও ভূমিকা: কল্যাণী রমা

অনুবাদ কবিতা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৫
অ্যান সেক্সটনের একগুচ্ছ কবিতা | অনুবাদ ও ভূমিকা: কল্যাণী রমা

‘কনফেশনাল’ কবি অ্যান সেক্সটন। ব্যক্তি জীবনের কথা, কষ্ট কবিতা হয়েছে তাঁর কলমে।

জীবনের বেশির ভাগ সময় মানসিক রোগের শিকার ছিলেন অ্যান সেক্সটন। থেরাপিস্ট ড. মার্টিনের উৎসাহে কবিতার ভিতর দিয়ে নিজের অসহনীয় আবেগ আর যন্ত্রণার কথা বলে গেছেন তিনি।

এই আমেরিকান কবির জন্ম ১৯২৮ সালের ৯ই নভেম্বর ম্যাসাচুসেট্‌স্‌-এর নিউটনে আর কবি বড় হ’য়ে উঠেছেন ওয়েস্টনে।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে হাই স্কুল ডিপ্লোমা আর একটা দু’টো কলেজ এক্সটেনশন কোর্স, কিন্তু কবিতা প্রকাশ হবার পর টাফ্‌ট্‌স্‌, র‍্যাডক্লিফ, আর হার্ভার্ড থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দেওয়া হয় তাঁকে। অ্যান সেক্সটন ক্রিয়েটিভ আর্টস্, ইউ এস অ্যান্ড কানাডা থেকে গুগেনহাইম ফেলোশিপ পান। অ্যানটিঅক রাইটার্স কনফারেন্সের জন্য স্কলারশিপ পান ১৯৫৭ সালে। ১৯৫৯ সালে পান অডিয়েন্স পোয়েট্রি পুরস্কার। ১৯৬৫ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচারের ফেলো হিসাবে নির্বাচিত হন।

‘লিভ অর ডাই’ বইটির  জন্য অ্যান সেক্সটন পুলিৎজার পুরস্কার পান ১৯৬৭ সালে। একই বছর পান শেলী মেমোরিয়াল পুরস্কার। হার্ভার্ড চ্যাপ্টারের দীর্ঘ ইতিহাসে অ্যান সেক্সটন হচ্ছেন প্রথম মহিলা যিনি সুবিখ্যাত ‘ফাই, বিটা, কাপ্পা’ পাওয়ার সম্মান পান ১৯৬৮ সালের জুন মাসে।

আরো অজস্র সম্মানের মধ্যে আছে ব্রেড লোফ রাইটার্স কনফারেন্সের জন্য ফ্রস্ট ফেলোশিপ(১৯৫৯), র‍্যাডক্লিফ ইন্‌স্‌টিটিউট্‌ ফেলোশিপ(১৯৬১), লেভিনসন পুরস্কার(১৯৬২), আমেরিকান একাডেমি অফ্‌ আর্টস্‌ এন্ড লেটারস্‌ ট্র্যাভেলিং ফেলোশিপ(১৯৬৩), হার্ভার্ড-এ ‘মরিস গ্রে’ পাঠের জন্য নিমন্ত্রণ, ফোর্ড ফাউন্ডেশন গ্রান্ট। ১৯৭৩ সালের মধ্যে বোস্টন ইউনিভার্সিটির ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর অধ্যাপক হন অ্যান সেক্সটন। পান কোলগেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকের পদও। কবিতার জন্য তিনটা ‘অনাররি ডক্টরেট’ ডিগ্রি দেওয়া হয় তাঁকে।

কিন্তু সাহিত্যিক জীবনের সাফল্য, যশ আর খ্যাতি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে নি, বিষণ্ণতার হাত থেকে মুক্তি দেয় নি। ১৯৭৪ সালের ৪ঠা অক্টোবর আত্মহত্যা করেন অ্যান সেক্সটন।



৪৫ নম্বর মার্সি স্ট্রীট

আমার স্বপ্নের ভিতর,
আমার পুরো
হাড়-মজ্জাটুকুর ভিতর ফুটো করে,
আমার প্রকৃত স্বপ্ন,
বীকান হিলের এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটছি
রাস্তার একটা সাইনবোর্ড খুঁজে বেড়াচ্ছি—
“মার্সি স্ট্রিট”।
নাহ্‌, ওখানে নেই।

ব্যাক বে-র দিকে চেষ্টা করলাম।
নাহ্‌, ওখানে নেই।
নাহ্‌, ওখানে নেই।
তবু আমি নম্বরটা জানি।
৪৫ নম্বর মার্সি স্ট্রিট।
ঢুকবার মুখের
স্টেইনড্‌ গ্লাস জানালাগুলো
আমি চিনি,
নকশা কাটা কাঠের মেঝের তিনতলা বাড়ি।
আসবাবপত্রগুলো চিনি আর চিনি
মা, ঠাকুমা, বড়মাকে,
বাড়ির ভৃত্যদের।
আলমারি ভর্তি বিলাতি চীনা-মাটির বাসন,
বড় মেহগনি কাঠের টেবিলটায়
বরফ ভর্তি বাটি, খাঁটি রুপার,
অজানা দৈত্যের দাঁতের মতো নিখুঁত আর চারকোণা
করে কাটা মাখন রাখা আছে তাতে।
খুব ভালো করেই জানি
ওখানে নেই।

কোথায় গেলে?
৪৫ নম্বর মার্সি স্ট্রিট,
বড়মা তিমি মাছের হাড় দিয়ে তৈরি কর্সেট পরে
হাঁটু গেড়ে বসে বেসিনের কাছে
প্রাণপণ প্রার্থনা জানিয়ে যাচ্ছে
ভোর পাঁচটায়।
দুপুরবেলায়
ঝিমিয়ে পড়ছে তাঁর উদ্ভট রকিং চেয়ারে,
ঠাকুরদা ভাঁড়ার-ঘরে
এটা সেটায় এক কামড় বসাচ্ছে,
ঠাকুমা নিচতলার ঝি-কে ডাকতে ঘণ্টা বাজাচ্ছে,
দিদিমা মাকে দোল দিচ্ছে,
কোঁকড়ানো চুলগুলোকে ঢেকে
কপালে একটা বিরাট ফুল—
যখন সে ভালো মেয়ে ছিল কিংবা যখন সে...
জন্ম হয়েছে তাঁর, সে তখন শিশু
কিন্তু এক পুরুষ যেতে না যেতেই সেই জন্মদাত্রী
আমার,
তৃতীয় সন্তান
জন্ম নিল অজানা বীজ থেকে বিকট এক ফুল।

একটা হলুদ জামা পরে ঘুরে বেড়াই
সাদা ব্যাগটা সিগারেটে ভর্তি,
তাতে যথেষ্ট পরিমাণে বড়ি, পয়সা রাখবার পার্স, আমার চাবি,
আঠাশ বছর বয়স, নাকি পঁয়তাল্লিশ?
আমি হাঁটছি। কেবলই হাঁটছি।
অন্ধকার বলে রাস্তার সাইনবোর্ড ম্যাচ জ্বালিয়ে দেখি, সে আঁধার
মৃতের মিশমিশে কালো চামড়ার মতো কালো।
চামড়া মিশমিশে কালো হ’য়ে যাওয়া মৃতের মতো কালো।
আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার সবুজ ফোর্ড গাড়ি,
শহরতলিতে আমার বাড়ি,
দু’টো ছোট বাচ্চাকে আমার ভিতরের মৌমাছি
যেন পরাগের মতো শুষে নিয়েছে
আর একজন স্বামী
যে কিনা তার দু’চোখের পাতা থেকে আমাকে মুছে ফেলেছে
আমার ভিতরটা আর যেন দেখতে না হয়
আমি হাঁটছি আর দেখে চলেছি
এটা কোনো স্বপ্ন নয়
এ শুধু আমার পিচ্ছিল জীবন
যেখানে মানুষেরা অ্যালিবাই
আর যেখানে রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না
পুরোটা জীবন ধরে।

পর্দাগুলো টেনে দাও—
আমার কিছুতে কিছুই যায় আসে না!
দরজায় হুড়কা লাগাও, দয়া কর,
নম্বরটা মুছে ফেলো,
আমার রাস্তার সাইন খুলে ফেলো,
কী আর হবে,
কী আর হবে এই ফালতু মেয়েটার
যে কিনা অতীতটাকে নিজের হাতের মুঠোয় চায়?
যে অতীত এক মৃত জাহাজে করে চলে গেছে
রেখে গেছে শুধু কিছু কাগজ?

ওখানে নেই।

ব্যাগটা খুলি,
যেভাবে মেয়েরা ব্যাগ খুলে থাকে,
মাছেরা টাকা আর লিপ্‌স্টিকের মাঝ দিয়ে
সামনে পিছনে সাঁতার কাটে।
আমি ওদের ধরে
একটা একটা করে
রাস্তার সাইন-বোর্ডের দিকে ছুঁড়ে দিই,
ছুঁড়ে দিই নিজের ব্যাগটা
চার্লস নদীতে।
তারপর স্বপ্নটাকে টেনে হিঁচড়ে তুলে
যে কদাকার ক্যালেন্ডারের পাতায়
জীবনটা কাটাচ্ছি
তার সিমেন্টের দেয়ালে আছড়ে পড়ি,
আমার জীবন,
আর তার টেনে টেনে বয়ে বেড়ানো
নোটখাতা।


[“45 Mercy Street” কবিতাটির বাংলা ভাষান্তর। কবিতাটি “45 Mercy Street”(১৯৭৬) বইটি থেকে নেওয়া। এই বইতে কবির জীবনের ব্যক্তিগত কথা বড় বেশি উঠে এসেছে বলে অ্যান সেক্সটন বেঁচে থাকতে বইটি প্রকাশিত হয়নি। ]
 

ডাক্তার মার্টিন, তুমি

ডাক্তার মার্টিন, তুমি
সকালের খাবারের পর থেকে উন্মাদনার দিকে হেঁটে যাও। আগস্টের শেষ,
আমি ছুটে যাই এন্টিসেপ্টিক টানেলের ভিতর দিয়ে
ওখানে এখনো নড়াচড়া করছে যে মরা মানুষগুলো
তারা নিজেদের হাড্ডিগুলোকে ঠেলেঠুলে সুস্থতার দিকে
নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। গ্রীষ্মাবকাশের এই হোটেলের
আমিই মক্ষিরাণী কিংবা মৃত্যুর বৃন্তে এক হাস্যকর

মৌমাছি। দাঁড়িয়ে থাকি ভাঙাচোরা লাইনে
আর দরজার তালা খুলে রাতের খাবারের
ওই বরফ-শীতল দরজার কাছে গুনে গুনে
আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। সঙ্কেত-ধ্বনি উচ্চারিত হয়
আর আমরা আমাদের হাসি ঝুলিয়ে
ঝোলভরা গামলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে
চিবাতে থাকি, আমাদের প্লেট স্কুলের চক-খড়ির মতো

কিচকিচ করে আর্তনাদ করে ওঠে। গলা
কেটে ফেলবার মতো কোনো ছুরি এখানে নেই। সারা সকাল
মোকাসিন জুতা বানিয়েছি। প্রথমদিকে
আমার হাত খালিই থাকত, খালি থাকত যে সব
জীবনের জন্য তারা আগে কাজ করত তাদের কথা ভেবে।
যে ক্রুদ্ধ আঙুল দাবি জানায়, আজকাল শিখে গেছি সে হাত ফিরিয়ে নিতে,
মেরামত করে ফেলতে কাল যা ভেঙে ফেলবে আর কেউ,

তোমাকে নিশ্চয়ই ভালোবাসি; তুমি নত হ’য়ে
প্লাস্টিকের আকাশটার উপর থেকে দেখো,
আমাদের ব্লকের ঈশ্বর, সব ধূর্তদের রাজকুমার।
জ্যাক যে পড়েছিল সেই ভঙ্গুর মুকুটগুলো নতুন ছিল।
তোমার তৃতীয় নয়ন
আমাদের মাঝে ঘুরে বেড়ায় আর যেখানে আমরা ঘুমাই কিংবা কাঁদি
সেই আলাদা আলাদা বাক্সে আলো জ্বালায়।

এখানে আমরা কী সব বয়স্ক শিশু। সবচেয়ে ভালো ওয়ার্ডটায়
মোটের ওপর আমিই সবচেয়ে লম্বা হ’য়ে বেড়ে উঠি। তোমার কাজ
মানুষ নিয়ে, পাগলা গারদে তুমি খোঁজ নাও,
আমাদের আখড়ায় তুমি এক দেবদূতের চোখ।
বাইরের হলে তোমাকে পেজ করে।
তুমি নীহারকণার ভিতর জীবনের বন্যায় ঝাঁপিয়ে
পড়া মানুষগুলোর টানাপোড়েন সামলাও।

আর আমরা নিজেরাই নিজেদের সাথে কথা
বলে যাওয়ার ভোজবাজি, কোলাহলপূর্ণ আর একা।
আমি আমার ভুলে যাওয়া সব পাপের রাজরাণী।
তাও কি আমি হারিয়ে গেছি?
একসময় সুন্দর ছিলাম। এখন আমি নিজের মতো,
নিশ্চুপ ওই তাকে অপেক্ষা করছে যে মোকাসিন জুতা
তার এই সারি আর সেই সারি গুনে চলেছি।

[“You, Doctor Martin” কবিতার বাংলা ভাষান্তর। কবিতাটি “To Bedlam and Part Way Back”(১৯৬০) বইটি থেকে নেওয়া। ]


তিনটা সবুজ জানালা

রবিবার দুপুরে আধো ঘুমের ভিতর
তিনটা সবুজ জানালা দেখতে পাই
তিন রঙের আলোয়—
একটা পশ্চিমে, একটা দক্ষিণে, অন্যটা পূর্বে।
আমি ভুলে গেছি যে পুরনো বন্ধুরা মারা যাচ্ছে।
ভুলে গেছি যে আমিও মাঝ-বয়সের কাছাকাছি।
প্রত্যেকটা জানালায় এমন খস্‌খস্‌ শব্দ!
গাছগুলো টিকে থাকছে, ছত্রাক গজাচ্ছে গায়ে, লাবণ্যময়ী গাছ,
সন্ত-সন্ন্যাসীর মতো ঘন।
দেখি তিনটা, ভেজা গার্গয়েল পাখিতে পাখিতে ঢাকা।
ওদের শরীর সূর্যের আলোয় চামড়ার মতো চক্‌চক্‌ করছে।

আমি নিজের বিছানায় স্পঞ্জের মতো হালকা
কিছুদিন পরই গরমকাল আসবে।
আমার মা, আমাকে গল্প শোনাবে,
ঘুম পাড়িয়ে রাখবে নিজের
নরম তুলতুলে চামড়ার পাশে।
শুধু পাতা দেখি—
ভেসে আসা পাতা, পরিষ্কার পবিত্র যে পাতা
যে পাতা কোনোদিন মাটির নিচের ঘর দেখেনি।
নিজেদের সবুজ রক্তের ভিতর জন্ম ওদের
মৎস্যকন্যাদের হাতের মতো।

চলার পথে জং পড়া গাড়িটার কথা আমি ভাবি না।
বাড়ির পাশে যন্ত্রের মতো লাফ দিয়ে ওঠা
লাল কাঠবিড়ালিগুলোর দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই আমার।
জানালার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা
আর্টিচোকের মতো মোটা
সত্যিকারের গাছের গুঁড়িগুলোর কথা মনে পড়ে না।
আমি দৈত্যের মতো ঘুরে দাঁড়াই,
গোপনে লক্ষ্য করছি, গোপনে জেনে নিচ্ছি,
গোপনে নাম রাখছি প্রত্যেক মনোরম সমুদ্রের।

আমি কোথায় যেন রেখেছি ভ্যান অ্যালেন বেল্ট,
পয়ঃপ্রণালী, নালা-নর্দমা,
নাগরিক পুনরারম্ভ আর উপনগরিক কর্মচঞ্চল স্থান।
আমি ভুলে গেছি সাহিত্য সমালোচকদের নাম।
আমি শুধু জানি যা আমি জানি।
আমি যে শিশু ছিলাম তাই আজ,
কাটাচ্ছি সেই জীবন যা আমার ছিল।
আমার বয়স অল্প, আমি আধো ঘুমে।
এ জলের সময়, এ সময় গাছেদের।

[“Three Green Windows” কবিতার বাংলা ভাষান্তর। কবিতাটি লেখা হয় ১৯৬২ সালের জুন মাসে। এই কবিতা বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যতের ছবি। একজন বৃদ্ধা দুপুরের আধো ঘুমের ভিতর স্বপ্ন দেখছে। আর একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আসলে লেখক তুলে ধরতে চেয়েছেন একজন মাঝবয়সী মহিলার আর একটু ভালোভাবে জীবন যাপনের আকাঙ্ক্ষাটুকুর কথা। মহিলাটি মনে করবার চেষ্টা করছে অতীতের দিনগুলোকে আর স্বপ্ন দেখছে ভবিষ্যৎ কেমন হবে তার। ]

 
মনে পড়ে

আগস্টের প্রথম দিন নাগাদ
অদৃশ্য গুবরেপোকাগুলো নাক ডাকতে শুরু করল আর ঘাস
ছিল শণের মতো শক্ত এবং
বর্ণহীন—বালির যতটা রঙ থাকে
তার থেকে কম রঙ তার আর আমরা
খালি পায়ে, খালি পা আমাদের বিশে জুন থেকে
কখনো কখনো এমন হতো যে আমরা তোমার ঘড়িতে
এলার্ম দিতে ভুলে যেতাম আর কোনো কোনো রাতে
পুরানো জেলি গ্লাস থেকে
গরম নির্জলা জিন পান করতাম
ছবির লাল টুপির মতো সূর্য
দৃষ্টির বাইরে চলে যেত এবং
একদিন আমি আমার চুল পিছনে
ফিতা দিয়ে বেঁধেছিলাম আর
তুমি বলেছিলে আমাকে দেখতে
প্রায় এক গোঁড়া মহিলার মতো লাগছে
আর আমার যা খুব বেশি করে মনে আছে তা হ’ল
তোমার ঘরের দরজাটা
আমার দরজা ছিল।

[“I Remember” কবিতার বাংলা ভাষান্তর। কবিতাটি “All My Pretty Ones”(১৯৬২) বই থেকে নেওয়া। ]


বিয়ের রাত

বোস্টনে সে এক সময় ছিল
তখনও বসন্ত আসেনি—ছোটখাট এক অনুষ্ঠান—
আর তারপর তা শেষ হয়ে গেল।
যেদিন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, আমি মার্লবোরো স্ট্রিট ধরে হেঁটেছিলাম
চামড়ার মতো একঘেয়ে গাছের ডালের নিচ দিয়ে
ড্রাইভারের হাতের গ্লাভস্‌-এর মতো শক্ত গাছের ডালের নিচ দিয়ে
আমি বলেছিলাম, (শুধু তুমি চলে গিয়েছিলে বলে)
“ম্যাগনোলিয়া ফুলে কেমন যেন এক দখিনা শব্দ ঝংকার আছে,
একেবারেই বোস্টনের মতো নয়,”
আর যা কিছুই ঘটেছিল, সব গোলাপি,
আর সব খুব অল্প সময়ের জন্য,
অবিশ্বাস্য সব ঘটনা, মনে গেঁথে আছে।

একবারের মতো ম্যাগনোলিয়ারা বসেছিল, প্রত্যেকে গোলাপি পোশাকে,
নিশ্চিতভাবে বলা যায় সবাই ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে ছিল।
সপ্তাহের পর সপ্তাহ কুঁড়িগুলো সুঠাম শরীরে দাঁড়িয়ে
ঠিক যেমনভাবে এডনা পিসির বিয়েতে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম
ফ্লাওয়ার গার্ল হয়ে, বারো বছর বয়স।
ফুলগুলোর নিচ দিয়ে তোমার দিকে যেতে যেতে,
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “ওরা কি নত হবে?”
দুইজন নত হ’য়ে একটা ডালের মাঝে,
গাল, কপাল, কাঁধ মেঝেতে?
কাউকেই বেমানান বলে মনে হয় নি আমার।
কেউই নেতিয়ে পড়ে নেই।
কারো শরীর থেকেই চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে না—
শঙ্খচিলের চকচকে ঠোঁটের মতো অপেক্ষা করছে ওরা,
সেরকমই রুদ্ধ।

আমি রাতের পর রাত ওদের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলাম, দ্বিধান্বিত,
আর তারপর আমার গাড়ি চালিয়ে চলে গিয়েছিলাম।
তবুও এক রাতে, এপ্রিলের রাতে
কেউ একজন (কেউ একজন!) প্রত্যেকটা কুঁড়ি ফুটিয়েছিল—
ভুল প্রমাণ করতে, ব্যঙ্গ করতে, তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে ছিদ্র করে দিতে!
পরেরদিন ফুলগুলো সব তীব্র রঙের,
ভেজা ভেজা, সত্যি বলতে কী কোনো খুঁত নেই ওদের।
তারপর তারা আর গাদাগাদি ক’রে নয়।
তারা ভুলে গেল কিভাবে লুকাতে হয়।
কী ম্রিয়মাণই না তারা ছিল,
এখন জমকালো, বাতাসে দুলে দুলে।
আর এই সবকিছুর মধ্যে এমন এক পরিবর্তন!
জমে উঠছিল আমোদ-প্রমোদ।

তারপর, যেমন হয় আর কী—
প্যারেডের মুখগুলোর মতো,
আমি তোমাকে হারানো কিংবা ওদের হারানোর মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পেলাম না।
অনুষ্ঠানের পর ওরা একে একে ঝরে পড়ল,
একটা একটা ক’রে বাছাই করা,
একের পর এক আর্টিচোকের পাতার মতো।
তারপর আমি আমার গাড়ির দিকে হেঁটে গেলাম—এলোমেলো পায়ে
রাস্তার পাশে ইঁটের সাইডওয়্যাকে পড়ে থাকা বেদনাদায়ক অবশেষটুকুর উপর দিয়ে,
আর এইটুকু জেনে যে কেউ একজন এক রাতে
বিপন্ন পায়ে এ পথ পেরিয়ে গেছে,
সময় হওয়ার আগেই।

[“The Wedding Night” কবিতার বাংলা ভাষান্তর। ১৯৬৪ সালের ২৭ শে এপ্রিল থেকে ১লা মে-এর মধ্যে লেখা। কবিতাটি “Live or Die” (১৯৬৬) বই থেকে নেওয়া। ]



বাংলাদেশ সময়: ১৪০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।