মহুয়া বৃষ্টিতে আমি ভিজে চলি
এসেছিলে তুমি আমার পাশে একলা বিজন গাছের শ্বাসে
রোদ্দুরের ঝুঁটি ধরে মেঘের শিথিল মুঠি ধরে
আমায় তুমি নিবিড় করে জড়িয়ে ধরতে
পায়ে পায়ে ঢুকে পড়তে ছোট্ট আঁধার গহন ঘরে
একইসঙ্গে ধুলো ঢুকত, ধুলোয় আমার বন্ধু ছিল।
তুমি যখন আসতে একা সঙ্গে আসত অনেক পাখি
তোমার হাতটি ছুঁয়ে দিলেই পাখির ডানার গন্ধ পেতাম
যে বাড়িতে পুকুর ছিল নিশুতি রাতে সেই বাড়িতে
তোমাকে ছাড়াই একা একা আমিও ঠিক ঢুকে পড়তাম
বাড়ির পাশেই একলা যে মাঠ উদাস বাউল
বাউরি বাতাস দিগঙ্গনার কান্না ঝরত কী কলতান
সেইখানেতে পরীরা এসে আমার বুকে তোমার মতোই
ঝাপিয়ে পড়ত, তারই মাঝে নীলপরীটা তুমিই ছিলে,
ছিলে নাকি! হয়ত ছিলে নক্ষত্রের ওই নিখিলে।
তুমিই যখন নাচের তালে ঘরে ঢুকতে ঘরও নাচত
বইগুলিও তোমার হাতের ভঙ্গি দেখে ঝিলমিলিয়ে হেসে উঠত
যে-কণ্ঠে আজ আবৃত্তি করো, যে-হাতে আজ কবিতা লেখো,
সেই হাতেই তো গন্ধকুসুম কত না গোলাপ পদ্ম ফুটত।
আজও আমি একা বৃষ্টিতে ভিজি তোমার শহরে তুমিও বুঝি
মেঘের তাঁবুতে উদাস মানুষ বর্ষাতি নিয়ে তোমাকেই খুঁজি
আকাশের বুকে কান্না তোমার গিয়েছো মেখে
কত যে বৃষ্টি কত যে অশ্রু ঝরো ঝরো ঝরে অঝোর ঝালরে
ভুল করে তুমি সবই করেছিলে, ভুল করে শুধু
সূর্যকে তুমি যাওনি রেখে।
চলেছি, তোমারই দিকে
[তুমিও পাখির মতো পরম পবিত্র তাই…]
যদি কিছু উড়ন্ত সারস
ডানা নিয়ে আসে
তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাব
সুদূর আকাশে।
মৃত্যু যদি তোমাকেই চায়
রৌদ্রে মুখ ঢেকো
সন্তানের মুখে চুমু খেয়ে
মেঘ বৃষ্টি এঁকো।
ঘুমন্ত ঝর্ণার জলস্রোতে
চলেছো কোথায়
চিতাভস্ম এই সসাগরা
ধীরে লুপ্তপ্রায়
একাই চলেছি স্বপ্নবীজে
ডানাটুকু দিও
জিভে বিষ শুষে নিয়ে
ছোঁব অঙ্গুরীও।
স্মৃতি
স্মৃতি বলে আমার কিছু নেই, ছিল শুধু একটা অশরীরী কালো ঘোড়া,
ওই দীপ্র ঘোড়ার পিঠেই একদিন এক নিভন্ত সুন্দর এসে বসেছিল।
বৃষ্টিসিক্ত চাবুকের চুম্বন থেকে ওষ্ঠ সরিয়ে আমি তাকে একটা
রঙিন কমলালেবুর বনে নিয়ে গিয়ে আমার খসড়া আত্মজীবনীর
কিছুটা অংশ শোনাতেই সে তার অশ্বারূঢ় সোনালি দ্রাঘিমা ছেড়ে
একটা শামুকের গুহায় ঢুকে পড়ল। চাঁদ তখন তার গতিপথ
বদলে ফেলে একাই বৃহস্পতির অক্ষে ছুটে চলেছে। কালো ঘোড়াটাও
বিরামহীনভাবে পেরিয়ে গেল তেপান্তরের পর তেপান্তর। কেউ
তখনও খেয়ালই করেনি, দেয়াল ঘড়ির কাঁটায় ঝুলে আছে একটা
শালিকের লাশ। অনেকেই বলতে থাকল, বেঁচে উঠবার আগে সে
আরেকবার স্ফটিকসবুজ দিগন্তের মধ্যে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল।
স্মৃতি বলে কিছু নেই, ছিল শুধু সাপের খোলসের মতো পাল্টে ফেলা
ফিনফিনে কিছুটা সময়, অপসৃয়মাণ হ্রেস্বা, রোমশ কয়েকটা দিন
আর একটা কালো ঘোড়ার পিঠে মৃত পাখির পালকে লোবানের গন্ধে
মাখামাখি করে সূর্যাস্তের মধ্যে ডুবে থাকা একটা রক্তাপ্লুত হৃৎপিণ্ড
নিয়ে ছুটে চলা লিবিডোতাড়িত দিকচিহ্নহীন দিগভ্রান্ত নিষ্প্রভ সুন্দর।
একটা নীলপাহাড়ের গল্প
বনের পাশেই একটা শাদা বাড়ি। প্রতিদিন তুমি ওই শাদা বাড়িটার মধ্যে
নিঃশব্দে ঢুকে পড়ো। বাড়ির চারপাশে সব মন-ভালো-করা গাছ।
গাছগুলোর গায়ে ঝাঁকড়া পাতার সবুজ ডানা। বাতাসের একটু ছোঁয়া
লাগলেই ওই ডানার ওপর ভর করে গাছগুলি ফরফর করে উড়তে থাকে।
একটু দূরেই খুশি-খুশি একটা পাইনের ঝাড়। খুশি-খুশি, কারণ, ওরা তোমাকে
দেখলেই লম্বা লম্বা শরীর দিয়ে একজন আরেকজনকে আলিঙ্গন করে, চুমু
খায়, বাতাসে তখন সর…সর…শব্দ ওঠে।
বাড়ির ভেতর থেকে বেরুবার একটাই পথ। পথটা একেবেঁকে নীলপাহাড়ের
দিকে উঠে গেছে। উপরে ঝর্ণা, পাইন, পপলার। পাহাড়টাতে উঠলেই শাদা
আর বাদামী সব মেঘ তোমার শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়। মেঘগুলোকে ছুঁয়ে
দিতে গিয়ে তুমি ঠিক চমকে ওঠো, আমার চিবুক ছুঁয়ে দিচ্ছো না-তো!
আরো উপরে পাহাড়চূড়া, ওখানে উঠলেই পৃথিবীটাকে মনে হয় এত্তটুকুন,
বিন্দুর মতো। কোথায় ছিলে তুমি, কোথায় এলে। এরকম একটা বাড়ির
স্বপ্নই তুমি দেখেছিলে। পাহাড়ের চূড়া থেকে পাইনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া
ঝর্ণা, তিতির, বুনোফুল আর দু-একটা হরিণ। চারিদিকে এভাবেই বিকেল
ঘনিয়ে আসে, সন্ধ্যা নামে।
তখনই, ঠিক তখনই চূড়া থেকে শূন্যে ঝাঁপ দেওয়ার আগে একবার
মনে পড়ল সেই প্রিয় মুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৫