পকেটের তলানিতে এখনো দু’তিনটা বাদাম ঘাপটি মেরে বসে আছে কিছুক্ষণ আগের পার্কের স্মৃতি নিয়ে। তার থেকে একটার শরীর মড়মড়িয়ে ভেঙে বিচি দুটা মুখে গুঁজে তৈমুর সাহেব ঠোঁটের দরজা বন্ধ করে দেন।
এরকম একা হা হা করে হেসে ওঠায় রিক্সাওয়ালা উল্টোদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকে। এতে তৈমুর সাহেব খানিকটা হতচকিত হয়ে মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে যান। অবশ্য পর-মুহূর্তেই রিক্সাটা তার বাসার গেইটে পৌঁছে; এতে তার বিরক্তি উগড়ে ওঠে। সে রিক্সায় উঠেছিল চোখে-মুখে বাতাসের ঝাপটা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু সময় স্মৃতির রাজ্যে হেঁটে বেড়াতে। পার্কে শান্তার হাসি, তার কথার অলিতে-গলিতে যেসব শব্দের পাপড়ি পড়েছিল, সেগুলোকে নিয়ে সে রিক্সায় বসে বসে চেয়েছিল খানিকটা ডাংগুটি খেলতে। কিন্তু কেমন ফুড়ুৎ করে সময়টা চলে গেল।
গেইটে দারোয়ান ব্যাটার গৎবাঁধা সালাম ডিঙিয়ে বাসায় ঢুকে চোখ বাগানের দিকে যায়। একটা গাছে অনেকগুলো গোলাপ ফুটে আছে। আরেকটা গাছেও কী যেন নাম ফুলগুলোর, সেগুলো ফুটে আছে। দেখে মনে হয় ওরা নিজেদের মধ্যে ইঁদুর দৌড়ে লিপ্ত। একে অপরের দিকে মুখ চেতিয়ে, চোখ কুঁচিয়ে বসে আছে। ওদের এমন বেলেল্লাপনায় আরেক ধাপ প্রলেপ দিচ্ছে সোডিয়ামের বাতিগুলি। যেন রাস্তায় কাস্টোমার ধরার কম্পিটিশনে নেমে পড়া অনেকগুলো শরীরকে আরেকটু উগড়ে দিচ্ছে। ও! ড্রাইভার ব্যাটাও চলে গেছে? তাই মনে হলো তৈমুর সাহেবের। তাতে অবশ্য তার কিছু যায় আসে না। গাড়িটা গ্রাম্যবধূর মতো ঘোমটা দিয়ে যে বসে আছে—তাতেই সই।
ভেতরে শূন্য ভোল্টের বাতি জ্বলে থাকায় ঘরটাকে মনে হলো রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত। তৈমুর সাহেব ভেজিয়ে রাখা দরজায় ধাক্কা দিয়ে খাটটার শিয়রে চলে আসেন। তার ঘরে আসাটা, ঘরটায় একধরনের প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। তৈমুর সাহেবকে দেখে মুহূর্তেই টিউব লাইটটা জ্বালিয়ে কুসুম খাটের একপাশে এসে দাঁড়ায়। তার পায়ের শব্দ এবং আলোর ধাক্কার দ্বৈত পরিক্রমায় সোহানা মিনমিন তাকিয়ে থাকে। মহিলা দুটোর মতো ঘরটায় আটকে থাকা বাতাসও অসুস্থ গতর নিয়ে এতক্ষণ চোখ বুঁজে ছিল। টিউব লাইট জ্বলে ওঠায় ঘরটাও জেগে উঠল মনে হয়। তৈমুর সাহেবকে দেখে সোহানা ব্যগ্র হয়েই বলল, অফিসে কি খুব কাজ ছিল?
সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠে আসেন। উত্তরের জানালার একটা কপাট খোলা। ভেতরে শূন্য ভোল্টের বাতি জ্বলে থাকায় ঘরটাকে মনে হলো রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত। তৈমুর সাহেব ভেজিয়ে রাখা দরজায় ধাক্কা দিয়ে খাটটার শিয়রে চলে আসেন। তার ঘরে আসাটা, ঘরটায় একধরনের প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। তৈমুর সাহেবকে দেখে মুহূর্তেই টিউব লাইটটা জ্বালিয়ে কুসুম খাটের একপাশে এসে দাঁড়ায়। তার পায়ের শব্দ এবং আলোর ধাক্কার দ্বৈত পরিক্রমায় সোহানা মিনমিন তাকিয়ে থাকে। মহিলা দুটোর মতো ঘরটায় আটকে থাকা বাতাসও অসুস্থ গতর নিয়ে এতক্ষণ চোখ বুঁজে ছিল। টিউব লাইট জ্বলে ওঠায় ঘরটাও জেগে উঠল মনে হয়। তৈমুর সাহেবকে দেখে সোহানা ব্যগ্র হয়েই বলল, অফিসে কি খুব কাজ ছিল? কথাগুলো বলতে বলতে তার গলার বাতাস দু’তিনবার ঝাপটা দেয় ঝড়কবলিত পাখির ডানার মতো। তার মনে হয়, অফিসের কেউ যদি জেনে যায়। যদি জানে প্রায় কেরানি একজনের সঙ্গে অফিসের বসের লটরপটর, তাহলে? তারপর নিজে নিজে হেসে ওঠে। বিড়বিড় করে বলে, আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে।
তৈমুর সাহেব একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে সোহানার মাথায় হাত রাখেন। কোনো উত্তর না পেয়ে সোহানা আরো কয়েকবার গরগর করে নিঃশ্বাস টানে। তারপর বলে, তোমার কি শরীর খারাপ?
সামনে কুসুম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি একবছর স্বামীর ঘর করেছিল। স্বামীটা ছিল মাতাল, প্রায়শই ওইসব পাড়ায় যেত। যৌতুক চাইত। মারধর করত। রাতে সুখ চাইলে সুখ দিত না (বোধ হয়)। ঠিক মতো খাবার দিত না বা ওই রকম কিছু একটা। তৈমুর সাহেব কুসুম বরাবর চোখ রাখেন। মেয়েটার বুকের আঁচল পড়ে আছে। মেয়েটার চেহারায় একটা লাবণ্যের ছাপ স্পষ্ট হয়ে হারিক্যানের মতো জ্বলছে। বুকে মিনিমাম একটা টিউব লাইটের সমপরিমাণ আলোর গোলক কিছু পোককে অনায়াসে তালকানা করে দিতে পারে—তৈমুর সাহেবের সেরকমই মনে হয়। সে চোখ ঘুরিয়ে একবার সোহানার দিকে তাকায়। মহিলার চোখ বুঁজো বুঁজো হয়ে সামনের দেয়ালে আটকে আছে। ফলে তৈমুর সাহেব আশ্বস্ত হন। সঙ্গে সঙ্গে কুসুমের স্বামীর প্রতি একধরনের ক্রোধ জেগে ওঠে। তিনি প্রথম এবং দ্বিতীয়, এভাবে খুব দ্রুত পরপর চারবার কুসুমের দিকে, মূলত কুসুমের বুকের দিকে দৃষ্টি ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।
কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতে পুনরায় তৈমুর সাহেবের মাথা থেকে বিরক্তি ঠিকরে পড়ে। এ ঘরের জানালা পেরিয়ে বাগানের ঘ্রাণ অথবা ড্রইংরুমে অথবা ছাদ অথবা তালা আটকানো এতগুলো ঘর অথবা কুসুমের ঘরটা। সেসব নয়, আরেকটু রাত হলেই শুয়ে পড়তে হবে একটা অসুস্থ নারীর কিনার ঘেঁষে। যে নারী সপ্তাহের ছয় দিন দাঁত মাজে না। শীতের রাতে যার শরীর থেকে গলগলিয়ে ঘাম ঝরে পড়ে। সারাটা রাত উ, আ আর্তনাদ, অসহ্য।
তৈমুর সাহেবের পুরো মাথায় তিরতির করে একটা ব্যথা গজিয়ে ওঠে। ফলে তিনি চুপচাপ জানালার বাইরে চোখ রেখে বিছানায় বসে পড়েন। আজ রাত থেকে সে এখানে সুখনিদ্রায় থাকতে চায়। পাশের জানালা, বাগান অথবা দরজা খুলে এ বারান্দা থেকে ও বারান্দা, তার মাথা জুড়ে এমন সব স্মৃতিময় মুহূর্ত তৈরির আয়োজন খেলা করে। তখনই হঠাৎ একফোঁটা বৃষ্টির মতো জানালার বাইরে শান্তা নামটা ঝরে পড়ে।
হালকা আলোর নদীতে শান্তার মুখটা জেগে আছে একটা চরের মতো। তৈমুর সাহেব মনের অজান্তেই খানিক পর পর শান্তার ওপর চোখ রেখে বড়শির মতো ছোট ছোট সুখ আটকে নেন। পাশের টেবিলে একজোড়া, তারপাশে আরেক জোড়া, তারও পাশে দুটা মেয়ের সঙ্গে একটা ছেলে দাঁত কেলিয়ে শব্দ ছাড়ে। একটু পর পর এইসব টেবিল থেকে নানারকম হাস্যরসের হরিণ ছুটে আসছে। তৈমুর সাহেব ওদের পাশাপাশি বসে, ওদের এমনি বিচিত্র লীলাখেলার ভেতর ডুবে থেকে শান্তার খাওয়া দেখেন। সঙ্গে দু’তিনটা দাঁতের সৌজন্যমূলক উঁকিঝুঁকি আর লিপস্টিক ভেদী শব্দের নৌকায় ঘুরে বেড়ান।
- শান্তা তোমার হাসিটা সমুদ্রে জেগে ওঠা চরের মতো। রোমান্টিকভাবে বলে।
শান্তা হাসে, খিক খিক হেসে বলে, এরকম কথা এর আগে কখনো শুনিনি।
- তোমার শব্দগুলো তীরে ভেঙে পড়া ঢেউয়ের মতো ছুটে আসে।
- আপনি পাগল। শান্তা আবার টুকরো হাসির বুলেট ছোঁড়ে।
এমনি এলোপাতাড়ি কথাবার্তা শেষে তৈমুর সাহেব ঘাপটি মেরে বসে থাকেন। পাশের টেবিলের যুগলটা উঠে গেছে। শান্তা কেমন নিপাট লোভনীয় ভঙ্গিতে কথার ঢাল ছুঁড়ছে। তৈমুর সাহেব অবাক হয়ে তাই দেখেন আর সেসব কথা ফ্রাই করা পুঁটি মাছের মতো একটার পর একটা গিলে খান। তারপর শান্তার যে হাতটা খেতে ব্যস্ত নয়, সে হাতের ওপর নিজের হাতটা রেখে চুইয়ে চুইয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতে পুনরায় তৈমুর সাহেবের মাথা থেকে বিরক্তি ঠিকরে পড়ে। এ ঘরের জানালা পেরিয়ে বাগানের ঘ্রাণ অথবা ড্রইংরুমে অথবা ছাদ অথবা তালা আটকানো এতগুলো ঘর অথবা কুসুমের ঘরটা। সেসব নয়, আরেকটু রাত হলেই শুয়ে পড়তে হবে একটা অসুস্থ নারীর কিনার ঘেঁষে। যে নারী সপ্তাহের ছয় দিন দাঁত মাজে না। শীতের রাতে যার শরীর থেকে গলগলিয়ে ঘাম ঝরে পড়ে। সারাটা রাত উ, আ আর্তনাদ, অসহ্য।
এ সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাঁতস্যাঁতে, বিষণ্ণ জীবনের একটা স্মৃতি তৈমুর সাহেবের ভেতর তোলপাড় করে যায়। একটা মেয়েকে তিনি প্রেম নিবেদন করতে ডেকে আনেন এক রেস্টুরেন্টে। তখন তৈমুর সাহেব হলে থাকতেন। হলে থাকাকালে প্রতিদিন একটা সন্ধ্যার নাগাল পেতেন। অথবা একটা নীরব দুপুর বা যেকোন সময়ের বাড়াবাড়ি রকম নিস্তেজতা। তখন তার পুরো বুক জুড়ে লাগামহীন শূন্যতাকে পাড়ি দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। তা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অথবা তার পর অন্য কোনো সময় হতে পারে, চাকুরি জীবনের শুরুতেও হতে পারে, কত সময় চলে গেছে তৈমুর সাহেবের গা ছুঁয়ে, তার পুরো হিসেব কি তার কাছে আছে? যাহোক, মেয়েটাকে তৈমুর সাহেব প্রেম নিবেদন করলেন। ওই সময় তার চেহারায় বরফের মতো প্রার্থনা জমাট হয়ে ছিল। আর মেয়েটা তার প্রার্থনার বিপরীতে, হেসে হেসে, মার্বেলের মতো চোখ ঘুরিয়ে, ঠোঁট দুটাকে বাছুরের লেজের মতো খেলিয়ে, রেস্টুরেন্টের বাতাসে একধরনের তাচ্ছিল্যের স্তূপ জমিয়ে ফেলে। সে মেয়েটার নামও ছিল শান্তা। ওই সময় তৈমুর সাহেব রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে পুরো আধঘণ্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। কী অদ্ভুত-হাস্যকর ব্যাপার। তবে এমুহূর্তেও শান্তার হাতে হাত রেখে আরেকবার তৈমুর সাহেবের আয়না দেখার ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু আয়না না পাওয়ায় তিনি ঘাপটি মেরে বসে থেকে শান্তার হাত আরো শক্তভাবে চেপে ধরেন।
নদীর বুকে জেগে থাকা চরের মতোই জেগে ছিল শান্তার মুখ। কিন্তু হঠাৎ দেখতে পায় শান্তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কান্নায় লাবণ্যময় মুখটা তৈমুর সাহেবের কাছে একটা চরের বদলে দ্বীপের মতো আরেকটু বেশি আশা জাগানিয়া বলে মনে হয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রথমে তৈমুর সাহেব খানিক ভড়কে যান। কিছুক্ষণ নির্বাক বসে থেকে হাতের ওপর রাখা হাতটা সরিয়ে নেয়। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয় না। ফলে দ্বিতীয়বারের মতো তৈমুর সাহেব নির্বাক হয়ে চারদিক ইতিউতি চোখ ঘোরাতে থাকেন। তখন শান্তা জানায়, সে বাসায় যাবে।
গাড়ির ভেতর দুজন বেশি রকম চুপচাপ। শান্তার মুখে কান্নার দাগ জৈষ্ঠ্যের শুকনো খালের মতো রেখাপাত করে আছে। এর ভেতর তৈমুর সাহেব শান্তার দিকে চোখ দুটা বেশ ক’বার ব্যস্ত রেখে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। তারপর পার্কের আহ্বান বা কয়েকটা শুকানো পাতার অভিবাদন একসঙ্গে জড়ো করে শান্তার দিকে ছুঁড়ে মারবে মারবে ভেবেও থেমে যায়। তিনি পুনরায় শান্তার ওপর নীরব চোখ রেখে অনুভব করেন, একটা স্যাঁতস্যাঁতে, ঘর্মার্ত দেয়ালের প্রতিরোধ এবং বেলেল্লাপনা।
জানালার একটা কপাট খুলে দাঁড়িয়েছিলেন। সামনে বাগান, তারপর দেয়াল, তারপর রাজপথ। শান্তার কান্নাজড়িত দুটো কপোল, যেখানে জেগে আছে জৈষ্ঠ্যের শুকানো খাল—তা মুছে দিতেই তৈমুর সাহেব অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েই ফেলেন। সে সময় ঘুমজড়ানো কণ্ঠে সোহানা বলে ওঠে, কী হলো তোমার?
তৈমুর সাহেব অবশ্য কোনো কথা বলেন না। খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসে থাকেন। তার মাথায় তখন শান্তার মুখ জুড়ে বসেছে। দেখতে পান, চুপচাপ জানালার ফাঁক গলে কেমন করে যেন শান্তার সেই কান্না এ গুমোট ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। কান্নার তোড়ে তৈমুর সাহেব বিচলিত এবং অনুভব করেন, চর নয় একটা দ্বীপ স্পষ্টই জেগে উঠেছে।
সোহানা ঘুমিয়ে পড়েছে। মহিলাটা যত সহজে জাগতে পারে, তত সহজে ঘুমিয়েও পড়ে। কিন্তু তৈমুর সাহেবের ঘুম আসে না। তিনি শান্তার জন্য বিচলিত হন এবং তাতে মাথা ভর্তি ক্রোধ জ্বলে ওঠে। কী করুণ এবং স্যাঁতস্যাঁতে মুখ। তিনি মত পাল্টান। না এ মুখ নয়—এ ঘর্মার্ত দেয়ালের বেলেল্লাপনা। তিনি ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকেন মহিলার ঘুমে বুঁজে থাকা চোখ দুটার দিকে। এরপর খানিকটা ইচ্ছাও হয়...। ইচ্ছাটা একটা টুনটুনি পাখির মতো ঘুরেফিরে একই ডালে এসে বসে। ঘুরেফিরে আবার এসে বসে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পেরুনোর পর মরে যায়। তারপর ইচ্ছাটা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই যে ঘর্মার্ত বুঁজে থাকা দুটা চোখ; যার নিঃশ্বাস করুণ আর্তির মতো সুর করে ওঠানামা করছে—ওই গলাটা মাত্র কয়েক মিনিট চেপে ধরতে পারলেই হলো।
রেস্টুরেন্টের ঘটনার পর তৈমুর সাহেব ভেবেছিলেন ওটা সহসাই একটা গভীর আয়োজনের ভেতর ওদের টেনে নিয়ে যাবে। পরদিন তাই তিনি ভেবে রাখেন অফিস ছুটির পর শান্তাকে যেভাবেই হোক বুঝিয়ে শুনিয়ে পার্কের দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু শান্তা না আসায় তিনি বেশ বিচলিত হয়ে পড়েন। মোবাইল ফোনে কল করেন। বন্ধ। পরদিনও শান্তা আসে না। এর পরদিনও না। তিনি বিচলিত এবং আরো বিচলিত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তৈমুর সাহেব নিরুপায় এবং অস্থিরতার চরমে পৌঁছান। পিয়নকে ডেকে শান্তার খবর জানতে চান। পিয়ন অনেকটা নির্লিপ্তভাবে জানায়, শান্তা ম্যাডাম ছুটিতে।
ছুটিতে ঠিক আছে। কিন্তু কেন ছুটিতে? সে অফিসের বস। একজন পিয়ন কাম জুনিয়র অফিসার ছুটি নিলে তার জানার কথাও না। সে যেচে জানতে চায়ও না। পৃথিবী গোল এবং একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে বলে তৈমুর সাহেবের আর কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না। ফোন তো আছে। কিন্তু বন্ধ। তৈমুর সাহেব বারবার যোগাযোগের চেষ্টা এবং ব্যর্থতার ভেতর ঘুরপাক খান।
শেষ পর্যন্ত তৈমুর সাহেব নিরুপায় এবং অস্থিরতার চরমে পৌঁছান। পিয়নকে ডেকে শান্তার খবর জানতে চান। পিয়ন অনেকটা নির্লিপ্তভাবে জানায়, শান্তা ম্যাডাম ছুটিতে।
ছুটিতে ঠিক আছে। কিন্তু কেন ছুটিতে? সে অফিসের বস। একজন পিয়ন কাম জুনিয়র অফিসার ছুটি নিলে তার জানার কথাও না। সে যেচে জানতে চায়ও না। পৃথিবী গোল এবং একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে বলে তৈমুর সাহেবের আর কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না। ফোন তো আছে। কিন্তু বন্ধ। তৈমুর সাহেব বারবার যোগাযোগের চেষ্টা এবং ব্যর্থতার ভেতর ঘুরপাক খান।
জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে তিনি অনেকটা অবাকই হন। সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের ক্লান্তিবোধ এবং নিঃসঙ্গতাকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি অনুভব করেন পার্কের ঘাস, বেঞ্চের শরীর এবং ঢেউয়ের মতো নেচে ওঠা শান্তার গালের ভাঁজ তাকে আলোড়িত করছে এবং সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছে একটা ক্লান্তিকর মোহ। এরকম ভেবে তৈমুর সাহেব ঢুকেই গিয়েছিলেন পার্কের স্মৃতিময় বিকালে। জানালার পথ দিয়ে কিছু বাতাস হেঁটে আসছে ঘরে, আর কিছু পালাচ্ছে। তখন সোহানা একটা ভাঙ্গা আর্তনাদের মতো সুর তোলে—কী হলো তোমার, প্রতিদিন জানালার কাছে এরকম দাঁড়িয়ে থাকো কেন? কথাগুলো কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো এই যে শান্তার সঙ্গে কয়েকদিন যোগাযোগ হচ্ছে না, এর নাম তো শঙ্কা, বিরাট এক শঙ্কা।
যাহোক, ঘোরের ভেতর এরকম ক’টা শব্দ ঢুকে পড়ায় তৈমুর সাহেবের স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। ফলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং ধীরে ধীরে জমতে থাকা অসহ্যবোধ থেকে বেরিয়ে আসে দমকের মতো একটা চিৎকার। যার ফলশ্রুতিতে সোহানা ভয় এবং বিস্ময়ে চোখ বন্ধ করে দেয়।
যে কারণেই হোক—সোহানার শ্বাসকষ্ট ক’দিন ধরে বেড়ে গেছে। এতে ডাক্তারের আসা-যাওয়াও বেড়েছে। সে রাতের পর তৈমুর সাহেব অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিন সোহানার ঘর ঘুরে পাশের ঘরে ঘুমুতে যান।
দিন দিন সোহানার শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। আর তৈমুর সাহেবের চিনচিনে ব্যথা এবং নিঃসঙ্গতাও শ্বাসকষ্টের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। শান্তার কথা মনে করার চেষ্টা করেন। তিনি অফিসে তার রুমের দেয়ালের রঙ কী তা বোঝার চেষ্টা করেন। এভাবে নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ করে কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারেন না। সুতরাং শেষ বিকেলে যখন নিঃসঙ্গতাটি তেড়ে এসে তৈমুর সাহেবকে দু’ঘাঁ দিয়ে যায়। যখন তৈমুর সাহেব অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে উদগ্রীব, সে মুহূর্তে বাসা থেকে কুসুম ফোন করে বলে, খালুজান তাড়াতাড়ি আসেন।
তৈমুর সাহেব নিতান্ত অসহায়ের মতো ছুটে নিচে নেমে আসেন। তারপর ড্রাইভার রেখে নিজেই গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন।
অনেকটা ঘুরে শান্তার বাসাটা খুঁজে পেলেও শান্তাকে পান না। ছোট ছোট দুটা ছেলেমেয়ে দরজা খুলে দেয়। ছেলেটাই বড়। অথবা মেয়েটাও হতে পারে। ওরা কেমন ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে। শান্তার কথা জানতে চাইলে জানায়, আম্মু হাসপাতালে, আব্বুর অসুখ।
শান্তার স্বামী অসুস্থ, সোহানাও তো অসুস্থ। এরকম একটা বিক্ষিপ্ত অথচ সম্পর্কিত ঘটনার ফলে তৈমুর সাহেব একটু বেশি রকম অসহায় হয়ে পড়েন। তার আরো মনে হয়, এই বাসাটা বড্ড স্যাঁতস্যাঁতে। এর সঙ্গে শান্তার দেহটার অনেক ফারাক।
হাসপাতালে শান্তাকে পাওয়া গেল। একটা হাড্ডিসার লোক উপুড় হয়ে শুয়ে চোখ বুঁজে গোঙাচ্ছে। লোকটার মাথার কাছে শান্তা। তৈমুর সাহেবকে দেখে শান্তার কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। তৈমুর সাহেব খুবই অবাক হয়। কেউ একজন এসেছে টের পেয়ে উপুড় হওয়া লোকটা অতিকষ্টে ঘাড় ফেরায়। শান্তা ভাবলেশহীনভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়।
পরিচয় পেয়ে মনে হলো স্বামী লোকটা আরেকটু কুঁচকে গেল। লোকটা কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে শান্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। শান্তা আগের মতোই নির্লিপ্ত।
বহুদিনের ব্যবধানে আবার একটা আয়নার প্রয়োজন অনুভব করেন তৈমুর সাহেব। তখন সোহানার কথা মনে পড়ে যায়। সোহানা এতক্ষণে হয়ত শ্বাসকষ্টে গোঙাচ্ছে। অথবা...। তৈমুর সাহেব কেঁপে ওঠেন। এখন তার বাসার দিকেই যাওয়া উচিত। খুব উচিত। সোহানাকে ঘিরে হঠাৎই অনেক সুখস্মৃতি, অনেক আবেগ একসঙ্গে তৈমুর সাহেবকে দোলা দিয়ে যায়।
এ মুহূর্তে কেরানি শান্তাকে তার অসহ্য মনে হয়। ফলে তিনি হাসপাতাল থেকে শরীরটা রাস্তায় বের করে নিয়ে আসেন। তারপর গাড়িটা দ্রুতবেগে চালিয়ে দেন রাজপথে।
গাড়ি চলছে, দ্রুত। আর এর মধ্যে আশ্চর্য ঘুর্ণিপাকে ফিরে আসে সোহানা, শান্তা বা কুসমের মুখ। অথবা এর সঙ্গে আসে অন্য শান্তা, ময়ূরী, আলপনা, ঝুমুর—এরকম জানা বা নাম না জানা আরো অনেক মুখ। অবশ্য এখন প্রথম তিনটা মুখই আসছে, ঘুরেফিরে আসছে। আর তাই নিয়ে তৈমুর সাহেব ছুটতে থাকেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৫